আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

স্মৃতি অমলিন : নুর উদ্দিন লোদি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১১-১৪ ২০:৩০:২১

খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নাম যদি জীবন হয় তাহলে বলতে পারেন বিলেতে ভালোই আছি, কিন্তু এই ভালো থাকাটাই মেনে নিয়েছে, মনে নিতে পারিনি।

মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে আসছে এদেশের সরকার যুগ যুগ ধরে। শূন্য হাতে বাড়ী ছেড়েছি আজ দেড় যুগেরও কাছাকাছি হয়েছে। এমন কোনদিন যায়নি মাথায় ছাদ ছিল না,  দুবেলা দুমুটো খাবার নিয়ে কিংবা সন্তানের শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হয়নি কখনো, ভাবতে হয়েনি ডাক্তারের ফি অথবা ঔষধের পয়সা নিয়ে (ভাবনায় শুধু-ই বাংলাদেশ)। সম্প্রতি বিশ্বমন্দায় বিলেতের অর্থনীতি কিছুটা গতিহীন হলেও সরকারের সহযোগী সংস্থার পদক্ষেপ আইনের সু-শাসন সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে অবিরত।

স্মৃতিকাতর মানুষ আমি জীবনের সোঁনালী সময়গুলি কাটিয়েছি জন্মস্থান বলি আর তীর্থস্থান বলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট বিয়ানীবাজারের মাথিউরা বড়বাড়ী গ্রামে। জীবনের পূর্ণতা নিয়ে এসেছি বলে অমলিন কিছু স্মৃতি বারবার ফিরে আসে চোখের সামনে। বিশাল জনসম্পদ আর আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানুষের মনে এত ধর্মভীরুতার দেশটা কেন যেন আজ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে পারছে না, এ প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয় মনের গহীনে, কি নেই আমাদের তারপরেও কেন মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় না, কেন সম্পদের সুষম বন্টনের ব্যবধান কমাতে পারে না মানুষের মাঝে। " কেন মানুষ দেশ ছাড়ে কাঙ্গাল মুসাফিরের মত"

স্মৃতির পাতা থেকে আমার কিছু ব্যক্তিগত মূল্যায়ণ আমাদের পশ্চাৎপদতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই আমার আগামী প্রজন্মের স্বার্থে। কেন আমার দেশের মানুষ সততার আশ্রয় নিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলে নিজেকে নিয়ে থাকতে চায় স্বাচ্ছন্দ্যে, কেন  মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না চরম অবক্ষয়ের কালে। শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সবার মাঝে তার নিজের চিন্তার এবং ক্ষমতার পরিধি অনুযায়ী প্রতারণার অপচেষ্টা, মনে পড়ে গ্রামের বাজারে যখন শসা কিংবা কমলা কিনতে যেতাম এগুলি বিক্রিয় হতো হালি ধরে, নিচের তিনটি যে কোন সাইজের হোক না কেন উপরেরটা থাকতো মানানসই ।

কবি শাহীন রশিদের ভাষায় স্মৃতির সুতার টানে জীবনের নোঙর আজ নরকের হিমাগারে। সম্প্রতি সময়ে এ  প্রজন্মের মানুষ আমার বিবেচনায় আগের মতো আর শিকড় সন্ধানী নয়। প্রতিকূলতার আর প্রতিবন্ধকতার কারণে মানুষ আর আগের মতো দেশমুখী নয় বললেই চলে। বিমান থেকে অবতরণের পর পরই মানুষের দুর্ভোগ শুরু হয় আর তা শেষ হয় হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের পরে। যখন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট তার হাতে নেওয়ার পরপরই তার চেহারায় যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাতে মনে হয় পূর্বজন্মে তার শত্রুতা ছিল প্রবাসীদের এই মানুষদের প্রতি, আর স্বজনদের সবকিছু অপেক্ষায় আটকে থাকে প্রবাস ফেরত এ মানুষটির প্রত্যাশায় যে কারণে বর্তমানে অনেকে এখন হলিডে করতে চলে যায় ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা কিংবা মধ্যেপ্রাচ্যে কোন দেশে ।

প্রবাসে বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে আসছে center for nrb নামের একটি সংগঠনের সাথে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। নতুন প্রজন্মদেরকে তাদের শিকড় সন্ধানে আগ্রহ করে তুলতে আমার প্রচেষ্টা থাকবে অনাগতকাল।

● স্থায়ীভাবে থাকার জন্য প্রথম যেদিন প্রবাসে (লন্ডনে) আসলাম। এই অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ,  বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন বর্ণের, কি সুন্দর রাস্তাঘাট যেখানে নেই কোন ধুলাবালি, রাস্তায় চলছে হাজার হাজার গাড়ি, নেই কোন গাড়ির শব্দ, চোখ বন্ধ করে দিয়ে একবার কল্পনা করি আমার বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা আর এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা কোথায়, যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান train station, bus stop  অফিস আদালত যত জায়গায় জনসাধারণের ভীড় সব জায়গাতেই কেমন সুশৃঙ্খলভাবে মানুষ তার জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন, সবকিছু যেন নিজের কাছে এক অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এইসব দেখে নিজের মনে প্রশ্ন জাগতো এদেশের মানুষ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে কোথাও কি জীবনযাত্রার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। না কি আল্লাহ এদেশের মানুষকে আলাদা করে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন যাহা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকরী হয়ে যায়। এখানে কিছুদিন থাকার পর আস্তে আস্তে নিজেকে এই সভ্যতার মানুষের সাথে মিশিয়ে নিতে পেরেছি।

বছর কয়েক পরে যখন নিজের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করলো তখন বুঝতে পারলাম ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে কোথাও কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ নাই, এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এদেশের রাষ্ট্র করে দিয়েছে। ছেলে মেয়ের যখন দুই বছর হয় তখন থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। যেখানে নেই রাজনৈতিক কোন অস্থিরতা, বিভিন্ন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কি সুশৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করছে এদেশের সকল মানুষেরা। এই যে গাড়ি বাড়ি পরিবার পরিজন সবকিছু থাকার পরেও কেন যেন মনে হয় কিছুই নেই, আজ নিঃসঙ্গ। জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় এই মাটিতেই কাটিয়ে দিলাম তবুও যেন এ মাটিকে আপন করে নিতে পারলাম না। কেন যেন মনে হয় এদেশ আমার নয়, এ মাটি আমার নয় এদেশের কোনো কিছুই আমার নয়, সবকিছুই পর পর মনে হয়। আমার সবকিছুই মনে হয় সেখানে।
     "যেখানে আমার সোঁনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"

জানিনা কেন শত চেষ্টা করেও ভুলে থাকতে পারিনি। পৃথিবীতে মনে হয় বাংলাদেশীরা-ই এক মাত্র জাতি স্বদেশপ্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পারে। এই  পরবাসে নানান রঙের, বহুজাতের মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত জীবন চলার পথে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মতো এতো দেশপ্রেম আছে বলে মনে হয় না। নিজের কাছে কখনো কখনো মনে হয় লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত আর ৩০ লক্ষ শহীদের আত্নহুতিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড তাই বুঝি এতো দেশ প্রেম আর ভালবাসা। প্রবাসীদের মুখে যখন দেশ প্রেমের কথা আমাদের দেশের মানুষেরা/ আত্মীয় স্বজনেরা শুনেন তখন তাদের কাছে মনে হয় ভুতের মুখে রাম রাম। এই কথাগুলি তাদের হাসির খোরাক হয়ে যায়।
দেশের ভালবাসা এক মুহূর্তের  জন্য ভুলতে পারিনাই, পারবো না জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। জীবন জীবিকার সবকিছু থাকার পরেও কেন যেন এক অভাবনীয় অফুরন্ত  সৈন্যতা  নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত, যে মাটিকে মুহূর্তের জন্যও মন থেকে ভালোবাসতে পারলাম না, সেই মাটিতে-ই অপরিচিত মানুষের সাথে পরকালের যাত্রা  শুরু হবে অনন্তকালের জন্য ।

"তবে কি আমার এ যাত্রা স্বেচ্ছায় নয় মেনে নেয়া নিয়তির নিষ্ঠুরতা, চাওয়া পাওয়ার  চরম ব্যবধানে সময়ের বিশাল শূন্যতা "। আমাকে এখানেই সমাধিত করিও প্রবাসের এই একটুকরো মাটি-ই হবে বাংলাদেশ !!

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা-বর্তমান যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি নেতা।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন