আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আওয়ামী লীগ কি তার অতীত ভুলে গেছে?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১১-১৫ ০১:০৪:৪৯

পীর হাবিবুর রহমান :: মাঝে মাঝে মনে হয় আওয়ামী লীগ নামের দলটি তার অতীত ভুলে গেছে। আওয়ামী লীগ জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু তার নির্বাচনী এলাকার এক জনসভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় ঘটে গেছে।

তিনি বলেছেন, ‘আশি পয়সা নিয়ে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবেন, ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। ক্ষমতায় যেতে হলে এক টাকা লাগবে, সেখানে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি, ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল মিলেই এক টাকা হবে, তখন ক্ষমতায় যেতে পারবেন’। কথাটি বাংলাদেশের শাসক দল ও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেছেন। এই বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়িত্বশীল বক্তব্যই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নির্বাচন করলে ফলাফল কী হবে তা ইনু ভালোই জানেন। ’ জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনা সরকারে তথ্যমন্ত্রী হলেও তিনি যেমন সত্য বলেছেন, তেমনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ওবায়দুল কাদের মিথ্যা বলেননি। একক নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ যেমন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তেমনি জাসদের ইনু জিতলেও তার দল ভোট ও ক্ষমতার লড়াইয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জোটযুদ্ধের লড়াই শুরু হওয়ার পর এককভাবে কারও ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর জাতির বুকে চেপে বসেছিল, দীর্ঘ ২১ বছর লেগেছে সেই অপশক্তিকে সরাতে।

অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের হটাতে এই লড়াইয়ে আদর্শিক রাজনীতির পথহারা আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মীরা জীবন দিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শিক অনুসারীরা আত্মদান করেছেন। ঢাকা মহানগরী ছাত্রলীগ নেতা বাবু গুম হয়ে আর কোনো দিন ফেরেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সৈকত, সেলিম, দেলোয়ার, নূর হোসেন, বসুনিয়া যেমন জীবন দিয়েছেন তেমনই কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড তাজুল, জাসদের শাজাহান সিরাজ, মুনীর তপন, ওয়ার্কার্স পার্টির ডাক্তার জামিল, রিমুসহ অসংখ্য তরুণ শহীদ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পতিত আওয়ামী লীগ রাজনীতির মধ্যমণি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন মরহুম আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, তোফায়েল আহমেদ, সাজেদা চৌধুরীসহ অনেক নেতা।
সেই অন্ধকার সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই শুধু দেওয়া হয়নি, রাজনৈতিকভাবেও পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। সেই সময় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কার্যত একা নিঃসঙ্গ একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল। নেতৃত্বের লড়াইয়ে মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ যেমন নূরে আলম সিদ্দিকীদের নিয়ে দল ভেঙে ব্রাকেটবন্দী হয়েছিল, তেমনি একদিকে সামরিক শাসকদের দমন-নির্যাতন, অন্যদিকে উগ্রপন্থি হঠকারী জাসদ ও অতিবিপ্লবী চীনাপন্থিদের আক্রোশের শিকার হয়েছিল আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমানতালে চলছিল অপপ্রচার।

জাসদের বিভ্রান্ত রাজনীতির সঙ্গে আমি একমত নই, রাশেদ খান মেননের রাজনীতির পথকে আমি সমর্থন করি না। আমরা যখন ’৭৫-উত্তর দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে পথে নেমেছিলাম তখন তাদের রাজনৈতিক শক্তি মহান মুজিবের প্রতি যে অন্যায় অসম্মান প্রদর্শন করেছে তা স্বৈরশাসক ও ’৭১-এর পরাজিত শক্তির পাল্লাকেই ভারী করেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের সামনে কখনোসখনো আন্ডারগ্রাউন্ড শক্তির ওপর নির্ভর করে শত্রুর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে পিতৃহত্যার প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ’৭১-এর বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কাদেরিয়া বাহিনীই ছিল আমাদের অদৃশ্য শক্তি ও প্রেরণার উৎস। কিন্তু সুমহান মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে মেনন-ইনুদের অবস্থান নিয়ে আমার কখনই সন্দেহ-সংশয় ছিল না। ’৮১ সালের ইডেন কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণজাগরণ ঘটে। গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের সূচনাও ঘটে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় ঐক্যজোট ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। সেই লড়াই-সংগ্রাম সামরিক শাসনের অন্ধকার যুগ থেকে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের আলোর পথে নিয়ে এসেছিল। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের বাতিঘর। কিন্তু দলীয় নেতৃত্বের একটি অংশের দম্ভ, অহংকারের কারণে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। তেমনি পারেনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য। এতে করে ১৬ বছর পর ’৯১ সালে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের মুখে পরাজয়ের বেদনা গ্রহণ করতে হয় আওয়ামী লীগকে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ। সেই সংসদে ইনু আসতে না পারলেও রাশেদ খান মেনন চলে আসেন। চলে আসেন বিভক্ত জাসদের শাজাহান সিরাজ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থান ঘটালেও ’৯৬ সালের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জাসদের আ স ম রব ও জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির সমর্থনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করে।   ১১৬ আসন নিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বিরোধী দলের আসনে বসে। তারা উপলব্ধি করে আওয়ামী লীগ বিরোধী সব শক্তিকে এককাতারে দাঁড় করাতে না পারলে ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। মরহুম রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদের প্রেসক্রিপশনে গঠিত হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট।

২০০১ সালের নির্বাচনে সুশাসন ও উন্নয়নের ওপর ভর করে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৫৭ আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। দলের বাঘা বাঘা নেতা পরাজয়বরণ করেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের ওপর দমন-নির্যাতনই নয়, কঠিন দুঃসময় আবার নেমে আসে, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। আর জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের একলা চলো নীতি পরিহার এবং বিএনপি-জামায়াতের দলবাজি, ক্ষমতাবাজি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের বক্তব্য-বিবৃতির ধারা অব্যাহত রাখেন। ২১-এর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২০০৫ সালে ইনু-মেননদের ঐকান্তিক চেষ্টায় গড়ে ওঠে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪-দলীয় ঐক্যজোট। সেই ঐক্য গড়তে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের পরিশ্রম ও আন্তরিকতা উল্লেখ করতেই হয়। আর সেই ১৪ দলে ঐক্য গড়তে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মরহুম সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক পরবর্তীতে রহস্যজনক আগুনে মৃত্যুবরণকারী নুরুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াসহ অনেকে। ১৪ দলের রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি-জামায়াত শাসন ও দমননীতির বিরুদ্ধে জোট রাজনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দেয়। বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক শক্তির নবজাগরণ ঘটায়। বিএনপির অভ্যন্তরে জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক ক্রিয়া ঘটায়। কঠোর নির্যাতন, অপমান, প্রতিহিংসার আক্রোশের মুখে বিকল্পধারা নিয়ে বেরিয়ে আসেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। হামলার মুখে দাঁড়িয়ে যান এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। বিএনপির একসময়ের মন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদের বাড়িতে আগুন হামলা চালানো হয়। তারাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক স্রোতে শরিক হন।

দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিতে বিএনপি জোট জোর তৎপরতা চালায়। আত্মগোপনে থেকে এরশাদ যেদিন শেখ হাসিনার পল্টন মঞ্চে উঠে গেলেন সেদিন ১৪ দল মহাজোটে রূপ নিল। বিএনপি-জামায়াত একঘরে হয়ে গেল, পল্টনের জনজোয়ার এরশাদের উপস্থিতিতে তুমুল স্লোগান, করতালি ও আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ল। সেদিনের সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটে এখনো এরশাদের জাতীয় পার্টি, ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল রয়ে গেছে। খালেদার বিএনপির সঙ্গে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াত রয়ে গেছে। ছোট ছোট দল মিলে সেটি হয়েছে এখন ২০-দলীয় ঐক্যজোট। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে তার অনুসারীদের ঢল নেমেছে। এ কথা সত্য, দমন-পীড়নের মুখে পতিত বিএনপি নেত্রীর চট্টগ্রাম সফর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে জনজোয়ার সৃষ্ট হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিতর্কিত বক্তৃতায় আলোচিত-সমালোচিত হলেও একটি গ্রহণযোগ্য সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেওয়া তার কাছে সময়ের দাবি। আদর্শিক রাজনীতির আরেক বরপুত্র বাসদ আহ্বায়ক আ ফ ম মাহবুবুল হক কানাডায় দীর্ঘদিন অচেতন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেছেন। আশির দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা, বাসদের একনিষ্ঠ কর্মী সুনামগঞ্জের আ ত ম মিসবাহর (পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেওয়া) সঙ্গে একবার জিপিওর সামনে আ ফ ম মাহবুবুল হকের দলীয় অফিসে আড্ডা দিতে গিয়ে তার পথের সঙ্গে একমত না হলেও নির্লোভ, সৎ, দেশপ্রেমের রাজনীতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে নগর পরিবহনে ঝুলতে ঝুলতে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। সবখানে, ঘরে-বাইরে প্রতারিত আ ফ ম মাহবুবুল হক তার আদর্শ, দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা লালন করতেন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচন বানচাল না হলে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তিনিই হতেন ডাকসু ভিপি।

সেই সময় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিয়েছিল লেনিন-গামা পরিষদ। স্লোগান তুলেছিল গামারে গামা মাহবুবরে থামা। ডাকসু নির্বাচন কলঙ্কিত করে মস্কোপন্থিদের প্রেসক্রিপশনে সেই গণরায় ছিনতাইয়ের নাটক আওয়ামী লীগ রাজনীতির পক্ষে যায়নি। সিপিবি সভাপতি স্বাধীনতা-উত্তর ডাকসু ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই সময়ে এসে সত্যকে স্বীকার করলেও সেদিনের অপকর্মের দায় আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা বা ক্রসফায়ার সামাজিক স্বস্তি এনে দিলেও বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। আওয়ামী লীগের নয় বছরের শাসনামলে সেই ঘটনায় ধারাবাহিকতার নিখোঁজ বা গুমের ঘটনা যুক্ত হয়েছে, যা সংবিধান, আইন ও মানবাধিকার পরিপন্থী। আমাদের সংবাদকর্মী উৎপল দাসসহ অনেক নিখোঁজ। হদিস মিলছে না, একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রে এটি কখনই কাম্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে যাওয়ার লড়াই চলছে। পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে, সীমান্ত চুক্তির সমাধান হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পশ্চিম দুনিয়াকে চমকে দিচ্ছে। মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের স্বৈরশাসকদের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তবু আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট চ্যালেঞ্জের মুখে। সব দলের অংশগ্রহণে আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব জনআকাঙ্ক্ষার এমন নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান যেমন আমার মিত্র হতে পারেনি তেমনি একাত্তরের আশ্রয় সাহায্য ও রক্তে লেখা প্রেমে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতই আমার বন্ধু। ভারত পাশে ছিল, পাশে আছে বন্ধুর মতো। পানিসহ সব ন্যায্য দাবি নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেনদরবার চলছে চলবে কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ’৭১-এর শত্রু পাকিস্তানের কালো হাত কেন তৎপর হয়ে ওঠে? সেই হাত গুঁড়িয়ে দিতে সমস্বরে কি চিৎকার করি? কখনো বলি, আমার পাওনা ফিরিয়ে দাও, কখনো কি বলি আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নাও।

সব হিসাবের খাতা খুললে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক শক্তির আশার বাতিঘর হিসেবে শেখ হাসিনাই শেষ কথা। নয় বছরে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের একাংশের উন্নাসিকতা, ক্ষমতার দাম্ভিকতায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় মানুষকেই ক্ষুব্ধ করেনি, দলের অভ্যন্তরে বিভক্তিই আনেনি, জোট শরিকদেরও খেপিয়ে তুলেছে। আওয়ামী লীগের গণমুখী মিডিয়াবান্ধব নেতা মোহাম্মদ নাসিম যখন বলেন ইনুকে চিতল মাছ ও পাঙ্গাশের পেটি দিয়ে খাওয়াতে, তখন তিনিও পাল্টা জবাব দিয়ে এ কথা বলতে ভোলেন না যে পাঙ্গাশ-চিতলের পেটি নয়, শরিকদের সম্মান চাই। ভোট যদি হয় গ্রহণযোগ্য লড়াই হবে জোটের যুদ্ধ, ভোটের যুদ্ধ। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যদি ছোট ছোট দলের সমমনাদের নিয়ে ২০-দলীয় জোট করতে পারেন তাহলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কেন দলের বিতর্কিত উন্নাসিক গণবিচ্ছিন্ন নেতা-কর্মীদের দমন করে মহাজোটের শরিকদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে ঐক্য সুসংহত করতে পারবেন না?

কেন সুশাসন নিশ্চিত করে সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন এটি কার্যকর করতে পারবেন না? কেন মহাজোটে যুক্ত করতে পারবেন না মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের গৌরবগাথা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা রাখা সিপিবি, গণফোরাম, বাসদসহ ছোট দলগুলোকে। সত্যের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ইনু যেমন সত্য উচ্চারণ করেছেন কাদের তেমনি মিথ্যা বলেননি। মহাজোটের বড় ছোট সবার বোধোদয় হওয়ার সময় এখন। বিএনপির অভ্যন্তরে দেশ ও দশের কথা ভাবা ইতিবাচক চিন্তাশীল নেতাদের হয়রানি ও মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার এখনই সময়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির দর্শনই নয়, অমরকাব্যই নয় সে সময় বিদেশি গণমাধ্যম ছন্দময় এই বক্তৃতার জন্য তাকে পোয়েট অব পলিটিক্স বা রাজনীতির কবি বলেছিল। একটি ঘুমন্ত জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উন্মাদনা ছড়িয়েছিল। একালে এসে ইউনেস্কো প্রামাণ্য শাখায় স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বসম্পদে পরিণত করেছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকদের এক সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্লিজ, আপনারা মফস্বলে যান দেখবেন ওখানে কোনো সাংবাদিকতা নেই, সাংবাদিকরা এখন এই পেশাটাকে যে কী অবস্থায় নিয়ে গেছে! আমার এলাকার আশপাশে এক সাংবাদিক আছে, জানি না সে এক লাইন শুদ্ধ বাংলা লিখতে পারে কিনা, সে একটি কাগজের সাংবাদিক। ’ ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অস্বীকার করার কোনো পথ নেই, লজ্জা-গ্লানি ও বেদনার সঙ্গে বলতে পারি এ দায় কেউ এড়াতে পারেন না। মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ের রাজনীতিতে গোটা দেশ ও সমাজ এখন ক্যান্সারের ভাইরাসে আক্রান্ত। দলবাজিতে ডুবে গেছে সবকিছু, সবখানে রাতারাতি বিত্ত-বৈভবের অস্থির প্রতিযোগিতায় কাদের হাত ধরে ছুটছে সমাজ তা কি চিন্তা করেছেন? ২৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখে কার লাভ, কার ক্ষতি হয়েছে? হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে গেছে? মানুষের শ্রদ্ধার আসন থেকে ছাত্রনেতা, লেখক-সাংবাদিক, আমলা, রাজনীতিবিদ কি সরে যাননি? রাজনীতবিদরা যদি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দী ও কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলার গণমুখী, মানবকল্যাণের নির্লোভ আদর্শিক রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব বহন করতেন তাহলে সংবাদকর্মীরা কি মানিক মিয়া, জহুর চৌধুরীদের পথ অনুসরণ করতেন না? আসলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত রাষ্ট্র কেন এখনো আমাদের নাগালের বাইরে?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন