আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং
:: মুনজের আহমদ চৌধুরী ::
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টায় বুধবার এক বাংলাদেশীকে কারাগারে পাঠিয়েছে ব্রিটেনের একটি আদালত। এর আগে কথিত জিহাদের নামে সিরিয়ায় পথে ইস্ট লন্ডনের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত স্কুলছাত্রীদের হিড়িক নিয়ে নিউজগুলো আসলেই করতে চাইনি। কারন, ঘটনাগুলো বড়ো গ্লানিময়, লজ্জার। তবু পেশা যেহেতু সংবাদ লেখা, বেতনের টাকাগুলি দেশের একাউন্টে সংসার চালাতে লাগে, তাই লিখতে হয়।
উদাহরন আর ঘটনা উল্লেখের দিনপঞ্জি লিখে বেদনা বাড়াতে চাই না, প্রিয় পাঠক। শুধু এটুকু বলি, যাদের কথা বললাম, তাদের জন্ম ব্রিটেনে, সরকারি ফ্রি হাসপাতালে, এদেশের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বেনিফিট সিস্টেম শতকরা নিরানব্বই জনের খাবার, ওষুধ, কাপড়-চোপড় যুগিয়েছে। এদেশের সরকারের ফ্রি স্কুলেই তাদের লেখাপড়ার হাতে-খড়ি। তবু তারা খুন করতে যায় জিহাদের নামে মানুষ, তার দেশেরই মানুষ। যুদ্ধ করে জিহাদের নামে নিজ জন্মভুমির বিরুদ্ধে। সবশেষ দেখলাম, আক্রান্ত করতে চায় নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এ দেশে তাদের জন্ম। এ দেশ কল্যান রাষ্ট্র হিসেবে রীতিমত খাইয়ে-পরিয়ে তাদের মানুষ করার সবটুকু চেষ্টা করেছে।
ভ্রান্তিময় জিহাদের নামে, সিরিয়ায় সেক্সী রোমান্টিসিজমের নামে তারা যে শুধু নিজেরা নিজেদের বা পরিবারকে অাক্রান্ত করছে, সেটাই নয়। ব্রিটেনের বহুজাতিক বহুবর্নের সমাজে তাদের নামের আগে খবরের কাগজে বা টিভিতে বলা হয় 'ব্রিটিশ-বাংলাদেশী'। তাদের ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের দায় শুধু ধর্মকে নয়, প্রবলভাবে আক্রান্ত করছে দেশটিতে প্রায় শত বছর ধরে স্বকীয় মর্যাদায় বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটিকে। ব্রিটেনের বহুজাতিক সমাজ ব্যবস্থাতেও যে বর্ণবাদ নেই, সে কথা অত্যুক্তি হবে। কিন্তু, অামাদের সন্তানরা এখন ব্রিটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটিকে এমন এক সন্দেহের তালিকায় পৌছেঁ দিচ্ছেন, যেখানে অতীতে কেবল ছিলেন 'ব্রিটিশ পাকিস্তানীরাই'।
আজকে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তিন তিনজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী এমপি। আআমাদের সন্তানরা এদেশে রীতিমত সব সেক্টরে মূলধারায় ঈর্ষনীয় অবস্থানে পৌছেছেন শুধুমাত্র নিজেদের শ্রম আর চেষ্টার গুনে। সেখানে ধর্মের নাম ভাঙ্গানো বিকৃতির রেসিজমের রেস আক্রান্ত করছে আজ পুরো বাংলাদেশী কমিউনিটিকে। ব্রিটেনে বড় বেতনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমনিতেই চলে প্রার্থীর চুলচেরা অতীত আর হিস্ট্রি বিশ্লেষন। কিন্তু এখন 'কান্ট্রি অব অরিজিনের' স্থানে যখন ব্রিটিশ বাংলাদেশী লেখা থাকে তখন নিয়োগদাতা নাকি দ্বিতীয় বিকল্প খোজাঁতেই স্বাচ্ছন্দের মনে করেন!
ব্রিটেনে আজকে বাংলাদেশীদের জয়-জয়কার কারো দান বা আনুকুল্যে আসেনি। আমাদের পুর্বসূরী আলতাব আলীরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে, জীবনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের সংহত ভীত গড়েছেন। ব্রিকস্টন রায়টের পর ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের চেয়ে বর্ণবাদ বিরোধী আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের ইতিহাস আর কোন দেশের মানুষের নেই।
সেই দেশটির এদেশে জন্ম নেয়া প্রজন্মের কিছু ভ্রান্ত আর পথ ভ্রষ্টদের কারনে পুরো কমিউনিটিকে যদি দাড়াতে হয় সন্দেহের কাঠগড়ায়, সে বড্ড লজ্জার, হতাশারও। স্বীকার করে বলি, ব্রিটেনের সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান কিছু বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কাজে লাগায় সন্ত্রাসের হোতারা। রাজনৈতিক সাম্যহীনতা, সামাজিক বঞ্চনা, অদৃশ্য বর্নবাদকে যদি জঙ্গিবাদ থেকে একেবারে আলাদা করতে চাই ব্রিটেনের প্রেক্ষিতে, তবে সে বিশ্লেষন অপুর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। আবার, ধর্মের অপব্যাখার সমান্তরালে ধর্মকে উপজীব্য করে অভিবাসীদের নিয়ে ক্ষমতাবানদের রাজনীতিও এই অস্থিরতার প্রধানতম উপসর্গ। ফলাফলে, এখন কার্যত পাঠা হচ্ছেন কেবল আমাদের সন্তানরা। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে দায় এড়াবার পথ খোলা নেই। আমার, আমাদের সন্তানদের যেন ব্রিটেনে 'ব্রিটিশ বাংলাদেশী'র গর্বের পরিচয়টি নিয়ে আগামীদিনে না দাড়াতে হয় সন্দেহের কাঠগড়ায়, সে দায়ভারের সবটুকু আমাদেরই। ব্রিটিশ বাংলাদেশী সন্তানের পিতা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সে দায় এড়াবার পথ খোলা নেই আর।
আমার সন্তানকে 'মুসলমান' এবং 'বাংলাদেশী' এ দুই পরিচয়েই ব্রিটেনে প্রশ্ন বা উদ্বেগের চোখের মুখোমুখি হতে হবে বা হচ্ছে, এ শংকাটুকু ভয়ার্ত বেদনাবহ। অক্ষর বা বাক্যের শক্তি নেই সে যাতনাকে শব্দবন্দি করবার।
ব্রিটেনের আকাশ প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের দেশের তুলনায় বিষন্ন। এখনকার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রশস্তিহীনতার টের মেলে এখানকার বাস্তবতায়। বুধবারের খবরটি যেন আরও একদফায় বিষন্নতা ছড়িয়েছে ভাবনার আকাশে।
লন্ডন ৭ ডিসেম্বর
লেখক: সদস্য রাইটার্স গীল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন।