আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ক্যামপাসে ধরণিকন্যা- এ-কেবল ইতিহাস নয়; স্বপ্নজাগরণ!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-৩০ ০০:৫১:৪৬

আবুল ফতেহ ফাত্তাহ :: দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি। মদনমোহন কলেজ তথা সিলেটবাসীর জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এ কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে পদার্পণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধরণিকন্যা শেখ হাসিনা। কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর আগমন ঘিরে। কলেজ গভর্নিংবডির সভাপতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এই লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে ২২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য জাতীয় সংসদভবনে তাঁর দপ্তরে সাক্ষাৎ করে। এই সাক্ষাৎকারপর্বটি কলেজ-পরিবারের জন্য অত্যন্ত স্মৃতিকাতর ও আনন্দের। ধরণিকন্যা শেখ হাসিনাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে কলেজের ইতিহাস এবং কলেজ-সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীদের কথা স্মিত হেসে শুনছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি বললেন, যেহেতু এটি অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কলেজ এবং একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আমি আপনাদের ক্যামপাসে যাব। সেই থেকে প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবের কর্মযজ্ঞ অন্য মাত্রা পায়। কলেজ-পরিবার তখন অনেকটা আবেগে শিহরিত। কখন, কীভাবে ধরণিকন্যা আসবেন এবং কথা বলবেন এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না।

অধ্যক্ষের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যের প্লাটিনাম জুবিলি উৎসব কমিটি গঠিত হয়। আবার উৎসবকে কার্যকর পন্থায় এগিয়ে নেবার জন্য উপাধ্যক্ষ সর্ব্বানী অর্জ্জুনকে আহ্বায়ক করে প্লাটিনাম জুবিলি উদ্যাপন কর্মপর্ষদ নিরন্তর কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে উৎসবকে সফল করে তোলে। এই পর্ষদের আওতায় উপপর্ষদগুলোর সদস্যবর্গ দিনরাত প্রচ- শ্রম স্বীকার করেন। সবার লক্ষ্য ধরণিকন্যার শুভ পদার্পণে কলেজ-ক্যামপাস আনন্দ-উচ্ছ্বাসে হেসে উঠুক। ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হোক এ কলেজের সুনাম-সুখ্যাতি। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিভাষণে সেদিন কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক ও কর্মচারীদের মনে স্বপ্নজাগরণের ছোঁয়া অনুভূত হয়। এ স্বপ্ন, এ জাগরণ ধরণিকন্যার স্মিতহাসি, ঔদার্য ও প্রাণের আবেগের সঙ্গে একীভূত। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকাতরতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্তর স্পর্শ করে। তাই তাঁর ভাষণে কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শহিদ সোলেমানের দুবড়ি-হাওর ট্রাজেডির কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়িয়ে আসে। এ কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মননচর্চার সুদূরপ্রসারী কর্মউদ্যোগের সঙ্গে তাঁর অভিভাষণ উৎসবে সমাগত সুধীবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর এজন্যেই ধরণিকন্যার আগমন মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসের জন্য যত না ঐতিহাসিক এরচেয়ে বরং স্বপ্নজাগরণের অমিয় উৎস। উদ্দীপনার ফল্গুধারা। যুগ যুগ ধরে এ ক্যামপাসে যত শিক্ষার্থীর আগমন ঘটবে ধরণিকন্যার অক্ষয় স্মৃতি ইতিহাসের অমিয় ধারায় অমলিন থাকবে। একইসঙ্গে অনাগতকালের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তরে স্বপ্নজাগরণের নিরন্তর ছোঁয়া অনুভূত হবে। যাকে আমরা আলো দিয়ে আলো জ্বালাবার চেতনাপ্রবাহের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসে প্রধানমন্ত্রীর আগমনস্মৃতির সুদূরপ্রসারী চেতনা দুটি পঙ্ক্তিতে এভাবে ধরা পড়েছে : ‘ক্যামপাসে ধরণিকন্যাÑ / এ-কেবল ইতিহাস নয়; স্বপ্নজাগরণ!’

দুবছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেট আগমন উপলক্ষে তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান মদনমোহন কলেজজুড়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ফল্গুধারা বয়ে যায়। প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবের স্মৃতিকাতর কিছু স্থিরচিত্রের সঙ্গে ধরণিকন্যার মনোরম চিত্রপট এবং এরসঙ্গে কাব্যিক উপস্থাপনা শিক্ষার্থীদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। পথচারীদের আকর্ষণের মাত্রা বেড়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে স্থিরচিত্রের দিকে তাকিয়ে পথচারীদের উচ্চারণ করতে শোনা যায়,
‘ধরণিকন্যা শেখ হাসিনার সিলেট আগমন
দুটি পাতাÑ শীতলপাটির স্বপ্নজাগরণ।’

শুধু কি তাই, গত ২১ জানুয়ারি ২০১৮ মদনমোহন কলেজ প্লাটিনাম জুবিলি উৎসব ও ধরণিকন্যার ক্যামপাসে আগমনের দুবছর পূর্তি পালন করল আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে। ‘ক্যামপাসে ধরণিকন্যা’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রস্তাব আসে, ধরণিকন্যার ক্যামপাসস্মৃতি একটি ফটো অ্যালবামের মাধ্যমে যেন কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে ‘ক্যামপাসে ধরণিকন্যা’ শীর্ষক ফটো অ্যালবাম প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মর্মে কলেজ কর্তৃপক্ষসূত্রে জানা যায়। এ কাজটি সুসম্পন্ন হলে মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসে দেশের প্রধানমন্ত্রীর আগমনচিত্র ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করবে। একইসঙ্গে এই ফটো অ্যালবাম অনাগতকালের শিক্ষার্থীমনে দীপ্ত আশার সঞ্চার করবে।

বলছিলাম, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারির প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবের কথা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপির পরামর্শ অনুসারে উৎসব উদ্যাপন কমিটি কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। সময় যত ঘনিয়ে আসে বিভিন্ন সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ আমাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। বিশেষত এসএসএফ, ডিজিএফআই, র‌্যাব, এনএসআই, এসবিসহ আরও অনেক সংস্থার লোকজন প্রধানমন্ত্রীর সফর নিশ্চিত করার কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন। এসব সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে অধ্যক্ষের সার্বক্ষণিক সংযোগ কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মনে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছিলেন। দিন যত ঘনিয়ে আসছে আমাদের আবেগ-উৎকণ্ঠা তত বেড়ে চলে। সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসন, এসএমপির পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক সংযোগ কলেজ-পরিবারকে উৎসাহিত করে। তাঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমাদের কর্মউদ্যোগকে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। কলেজ গভর্নিংবডির সদস্যবর্গ, গণপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রাক্তন ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীবৃন্দ নানাভাবে আমাদের এ উদ্যোগ-আয়োজনকে সফল করে তোলার জন্যে সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, সিলেটে কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ, এ কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিশেষত প্রবাসী শিক্ষার্থীদের কথা এই মুহূর্তে স্মরণযোগ্য। তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস-প্রচেষ্টা প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবকে মহিমা দান করে।

মদনমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহে সৃজনশীল চেতনা ধারণ করে আসছে। ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম প্রভৃতিক্ষেত্রে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের গৌরবময় অবদান সবমহলে স্বীকৃত। এর সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয় কর্মপ্রবাহ অঞ্চলসাধনার ধারাকে পুষ্টি দান করে। আবার জাতীয় চেতনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কলেজের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলছে। সিলেট বিভাগের প্রথম শহিদমিনার মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসে প্রতিষ্ঠা পায়। সংগত কারণে সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলরূপে কলেজ-ক্যামপাস সকলের নিকট আদৃত হয়। সেই লক্ষ্যে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন এবং প্লাটিনাম জুবিলি উৎসব উদ্যাপন  কলেজের কৃতিত্বের স্মারক। উদ্যাপন পর্ষদ একটি স্মারকস্তম্ভ স্থাপনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে আগ্রহী। এই লক্ষ্যে কলেজ গভর্নিংবডি স্মারকস্তম্ভের নকশানির্বাচন অনুমোদন করেছে। এই স্মারকস্তম্ভ মদনমোহন কলেজ ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী ও চেতনাসঞ্চারি উৎসরূপে ক্রিয়াশীল হবে।

আজ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মদনমোহন কলেজ ক্যামপাসে আগমনের পর বিকেলে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর অভিভাষণের দুবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মদনমোহন কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারীদের মনে ধরণিকন্যার আগমনস্মৃতি অনির্বাণ, অবিনশ্বর। যদিও এ সফরে কলেজ-ক্যামপাসে তাঁর আগমনের কোনও সুযোগ নেই তারপরও কলেজ-পরিবারের আবেগ-অনুভূতি আর উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্ত নেই। কলেজ-ক্যামপাস তাই ধরণিকন্যার আগমনস্মৃতির আলোকচিত্রে ভরে উঠেছে। সম্মেলক প্রাণের অর্ঘ্য দিয়ে ধরণিকন্যার আগমনস্মৃতি আমরা এভাবেই যাপন করতে চাই। তাঁর আসা-যাওয়ার পথের ধারে আমাদের এ ক্যামপাস যদি তাঁর একপলক দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয় তবে আমরা অনুপ্রাণিত হব, উজ্জীবিত হব। এই স্বপ্ন-আশার দীপাবলি সাজিয়ে মদনমোহন কলেজ ধরণিকন্যার স্মিতহাসির শুভদৃষ্টি কামনা করছে।

লেখক : ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, কবি ও লোকসংস্কৃতি গবেষক; অধ্যক্ষ, মদনমোহন কলেজ, সিলেট।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন