আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

বিএনপির কেন এই বিপর্যয়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০২-১১ ০১:০৮:৪৮

নঈম নিজাম :: আঘাত কোথা থেকে আসবে আমরা কেউই জানি না। আপন পর শব্দগুলো আজকাল আপেক্ষিক। আজ যিনি আপন কাল তিনি পর। দুঃসময়ে পাশে থাকা মানুষগুলোকে সুসময়ে আমরা কাছে রাখি না। ভালো সময়গুলো চলে যায় দ্রুত। খারাপ সময়গুলো যেতে চায় না। চারপাশ আঁকড়ে ধরে। দীর্ঘ কষ্টকে লালন করে রাখলে এক সময় তা বের হয়ে আসে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় একসঙ্গে দক্ষতা, সততা,  ন্যায়পরায়ণতা পাওয়া যায় না। এই অল্প সময়ে বড় বেশি দেখা হয়ে গেল।  বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। নেতা-কর্মীরা বিপর্যস্ত। প্রতিষ্ঠার পর দলটি বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়ল এই প্রথম। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দলটি অতীতে এমন অবস্থায় কখনো পড়েনি। অবশ্য ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের কথা আলাদা। একটি রাজনৈতিক দলকে উত্থান-পতন নিয়েই রাজনীতি করতে হয়। মোকাবিলা করতে হয় টানাপড়েন। বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতিতেই বেশি ছিল। এ কারণে রাজপথের রাজনীতির অনেক কৌশলী অবস্থান তাদের অজানা। আর অজানা বলেই এক জটিল অবস্থায় তাদের পড়তে হলো। তারপরও বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর মনে হয়তো এই মুহূর্তের প্রশ্ন— কেন এমন হলো? তাদের বুঝতে হবে এমন পরিস্থিতি একদিনে আসেনি। দীর্ঘদিনের ভুল রাজনীতি ও অহমিকাতেই সর্বনাশ হয়েছে তাদের। এই সর্বনাশ থেকে বের হতে হলে আগে ভুলগুলো জানতে হবে। বদলাতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

বছরখানেক আগে বিএনপির এক বন্ধু আমাকে ফোন করে ক্ষোভ ঝাড়লেন। বললেন, মিডিয়া যেমনি খুশি চালাবেন, হবে না। এক বছরের মধ্যে তার কাছে যেতে হবে। বললাম, বন্ধু হিসেবে দেখা হতেই পারে। যেতেও পারি। কিন্তু দল ক্ষমতায় আসার ভাব দেখিয়ে বললে, যাব না। অথবা আপনারা ক্ষমতায় এলেও যাব না। ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতেই ভালো লাগে। বন্ধু আবার বললেন— না, বন্ধু হিসেবে নয়, অস্তিত্ব রক্ষায় আসবেন। বিস্মিত হলাম। এই দলটির হলোটা কী? এত অহমিকা কেন? সরকারি দলের আমার বন্ধুরাও এভাবে কথা বলেন না। বিরক্ত হলে তারা মামলা করে দেন। অবশ্য বিএনপির অহমিকা ২০১৩ সালেও দেখেছিলাম। তাদের নেতারা মন্ত্রিত্বের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পেশাজীবীরা জানান দেন, দেশ-বিদেশে কে কোথায় নিয়োগ নেবেন। ঠিক সেই সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন বাংলাদেশে। বিএনপির পক্ষ থেকে সময় নেওয়া হয়েছিল প্রণবের সঙ্গে সাক্ষাতের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রণবের সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। শুধু তাই নয়, সেদিন ঢাকাতে হরতাল কর্মসূচিও রাখা হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই হরতাল জামায়াতে ইসলামীর আহ্বান করা। এই জামায়াত কারা? বিএনপির জোটসঙ্গী। হরতাল প্রত্যাহার করা কঠিন ছিল না। অথচ বিএনপি তা করেনি। বরং ভয়াবহ দাম্ভিকতা নিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে তারা। তারা ভুলে গিয়েছিল এর কিছু দিন আগে ভারতে নেওয়া আতিথেয়তার কথা। প্রণব মুখার্জি কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি একটি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কার বুদ্ধিতে খালেদা জিয়া এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন জানি না। তবে তখনকার ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ এ ঘটনায় খুব বিরক্ত ছিলেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সময়সীমা তাদের সঙ্গে আলোচনা ও অনুরোধের ভিত্তিতে করা। তারপরও এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ কেন? তিনি দুঃখ করে আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী দিল্লি সফরকালে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিলাম তাকে। বিশেষ ফ্লাইটে জয়পুর পাঠানো হয়।  আজমিরে যাওয়ার পথে ছিল পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বিশেষ ভোজের আয়োজন করেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়ার হোটেলে গিয়ে। জবাবে ভারত থেকে পাওয়া এই সম্মান ধরে রাখতে পারেনি বিএনপি। ঢাকায় এসেই খালেদা জিয়া ও তার দল সব ভুলে যায়। আমার মনে আছে, তখন একদিন টকশোতে বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেছিলেন, প্রণবের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। বিস্ময় নিয়ে সেই বক্তব্য শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।  বিএনপি হয়তো জানে না, তাদের সেই অহমিকাকে সাউথ ব্লক ভালোভাবে নেয়নি। ভারতের সামনে আবার উঠে আসে চট্টগ্রামে ট্রাকে ট্রাকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা। সেভেন সিস্টারকে অস্থিতিশীল করতে যা এসেছিল বিএনপির শাসনকালে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আনা এই অস্ত্র পাঠিয়েছিল পাকিস্তানি একটি সংস্থা। ভারত পুরনো স্মৃতি মনে করে বিএনপির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ভোটে না যাওয়ার সরকারি কৌশলে পা দেয় বিএনপি। একবার ট্রেন মিস করলে যা হয় বিএনপির ওই অবস্থা।

ভুলের রাজনীতির সূচনা বারোমিশালি এই দলটির আরও আগে।  তাদের প্রথম ভুলের শুরু ২০০১ সালের পর। ভোট জয়ের পর তারা তাদের দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এর মাঝে ছিল জামায়াতের তাণ্ডব। সেই সময়ে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরাও বাদ যায়নি। আইনশৃঙ্খলা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা নামাতে বাধ্য হন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শুরু হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট। বিএনপির শাসনকালে শুরুর নজিরবিহীন ঘটনা এখনো দাগ কেটে আছে। এরপরের অধ্যায় জঙ্গিবাদের বিকাশ। সারা দেশে একযোগে জেএমবির অস্তিত্বের ঘোষণা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান। যা বিশ্বরাজনীতিতে বিএনপি সরকারের প্রশাসনিক সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ প্রশ্রয়ের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলপাড় হয়। যার খেসারতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কাছ থেকে সরে যায়। একইভাবে ঢাকায় তাইওয়ানের কার্যক্রম নিয়ে বিরূপ হয় চীন। বিএনপির শাসনকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা একুশ আগস্ট। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখে, এ হামলায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থা জড়িত ছিল। অবশ্য একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিষয়টি আমরা তখনই আঁচ করতে পেরেছিলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একজন পরদিন টিভি অফিসগুলোতে হানা দিয়ে ভিডিও ফুটেজ ধ্বংসের তৎপরতায় ছিলেন। আমাদের পেশাদারিত্বের কারণে তা পারেননি। সেই কর্মকর্তা এখন কারান্তরীণ। চট্টগ্রামের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত। তাদের সেই অপকর্মের খেসারত বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এখনো দিতে হচ্ছে।

একটি দেশের বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যার চেষ্টার কলঙ্ক থেকেই প্রতিহিংসার বিকাশ। কিন্তু এর চূড়ান্ত কবর রচনা ইয়াজউদ্দিন সরকারের বাড়াবাড়ি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার দরকার ছিল না ইয়াজউদ্দিনের। তিনি নিলেন। তিনি শুধু নেননি, ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে বিএনপির কথায় কাজও করতেন। সেদিন যদি বিতর্কের বাইরে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজ করত তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। কারণ ’৯১ সালের পর থেকে পাঁচ বছর মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় আসার দৃষ্টান্ত শুরু দুই দলের। একবার এই দল। আবার অন্য দল। সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিএনপি হয়তো মাঝে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকত না। কিন্তু আজকের দুর্গতি তৈরি হতো না। হৈমন্তি শুক্লার গানের মতো বিএনপি অবুঝের মতো ভুলের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। তাদের সেই ধারাবাহিকতার আরেক অধ্যায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। তখন মাঠের রাজনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২৪টি জেলার সিভিল প্রশাসন থমকে গিয়েছিল আন্দোলনের মুখে। সেই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করলে তারা ভালো করত। এর মাঝে শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা তাদের লোকগুলো বেরিয়ে আসত। পরিবেশ হতো নির্বাচনের অংশগ্রহণ উপযোগী। কারণ আওয়ামী লীগের মনোবলে তখন ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে বিদেশিদের তৎপরতার সময় বিএনপি সেনা টহল বাড়ানোর কথা বলতে পারত।  কিন্তু ভুল একবার শুরু হলে এর শেষ হয় না। তারা ভোটের বিপক্ষে গেল। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন নিয়েও বিএনপি চেয়ারপারসনের উত্তরগুলো সঠিক ছিল না। এর মাঝে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর উদারতা নিয়ে শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে। দেশের প্রধানমন্ত্র্রী হেঁটে হেঁটে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে পারলেন না আরেকজন নেত্রীকে। সেদিনই আমার অফিসের সহকর্মীদের বলেছিলাম, এ কাজটি ভালো হয়নি। দেশের সহনশীলতার রাজনীতির মুখে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো। পরস্পর সম্পর্কের শেষ অবস্থানটুকু চিরতরে ছিন্ন হলো। এই বিচ্ছিন্নতার ধারাবাহিক পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি।

একটা আশার আলো তবুও রাখতে চাই। অনেক কিছুর পরও কারান্তরীণ বেগম খালেদা জিয়াকে তার প্রাপ্য মর্যাদা সরকার দেবে বলে আশা করছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ, তারা বেগম জিয়ার কাজের মেয়ে ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করেছে। এতটুকু সহনশীলতা না থাকলে চলে না। প্রত্যাশা করছি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সরকার কোথাও হস্তক্ষেপ করবে না। একদিন অবশ্যই জামিনে মুক্ত হবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তারও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক পাতিনেতার বক্তব্য মোটেও ভালো কিছু নয়। কারণ পাতিনেতাদের অনেকেই বিতর্কিত। এ ছাড়াও মানুষ মনে করে খালেদা জিয়ার বিচার হয়েছে। ভালো কথা। পাশাপাশি শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়া সবারই বিচার হতে হবে। একই সঙ্গে মাদক ও সন্ত্রাসে জড়িত জনপ্রতিনিধিদেরও দাঁড় করানো হবে আইনের কাঠগড়ায়। তাহলেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে আর প্রশ্ন উঠবে না। অন্যদিকে বিএনপিও শিক্ষা নেবে এই ইতিহাস থেকে। তারাও বেরিয়ে আসতে পারবে ভুলের সংস্কৃতি থেকে। বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের সঙ্গে তাদের নিষ্ঠুর আচরণ এখনো দলে থাকা সিনিয়র নেতারা ভুলতে পারেননি। তাদের সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করতে হবে বিএনপিকে। ছাড়তে হবে অহমিকা ও দাম্ভিকতার রাজনীতি। আর তা না করতে পারলে ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। ইতিহাস কোনো নেতিবাচক দিক বা কাউকে নিয়েই ভাবতে চায় না।  ইতিহাস চলে তার আপন মহিমায়। আর ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়াই ইতিহাসের শিক্ষা। অতীত ও বর্তমান তাই বলে। এখানেই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন