Sylhet View 24 PRINT

স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম শহীদ বিয়ানীবাজারের সূর্যসন্তান শহীদ মনু মিয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৬-০৭ ২০:৫৯:৫৭

নুর উদ্দিন লোদী :: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো বা আক্ষেপ করে এ কথা বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কারণ বাঙালিকে দীর্ঘ দিন বিদেশী শাসন, শোষণ আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধে থাকতে হয়েছে। 

বাঙালিকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কারাগারের শৃঙ্খল ভাঙ্গার গান গেয়েছিলেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট/শিকল পূজার পাষাণ-বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান।’
 
দীর্ঘ বঞ্চনার পর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্যে দিয়ে আসে স্বাধীনতা। কিন্তু এ কোন স্বাধীনতা যেখানে সাঁড়ে সাত কোটি বাঙালি জনসংখ্যা, সেখানে সাঁড়ে পাঁচ কোটি পাকিস্তানি জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বর কাছে প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খা উপেক্ষা করে  পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে  ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এবং ঢাকা কার্জন হলে দমকের সাথে ঘোষণা দেন রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। প্রতিবাদী ছাত্র নেতাদের কন্ঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল, তার মধ্যে তরুণ ছাত্রনেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালির এ বঞ্চনার মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন দীর্ঘ দিন ধরে।  অবশেষে ১৯৬৬ ছয় দফা ঘোষণা হয়, তখন তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় সারা দেশে। পাকিস্তানের শাসক শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন বাদী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সহযোগি ৩৪ জনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হয়। এবার ছাত্রজনতা নেমে আসে ঢাকার রাজপথে, মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকা  শহর। ছাত্র জনতার একটাই দাবী- জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো।
 
১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ছয় দফার স্বাধিকার আন্দোলন যার আত্মদানে বেগবান হয়েছিল ঢাকার রাজপথ, সেই শহীদ সিলেটের পঞ্চখন্ড তথা বিয়ানীবাজার নামক আলোকিত জনপদের সূর্যসন্তান শহীদ মনু মিয়াঁ ছিলেন  স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণার উৎস। সিলেটের এই  জনপদে যুগে যুগে অনেক সূর্য সন্তানদের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এই অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সক্রিয়।

প্রবীণ মানুষের মুখে শুনতাম স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম শহীদ আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান  তিনি হচ্ছেন শহীদ মনু মিয়া। ১৯৯৬ সালে বিয়ানীবাজার মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমান্ডের প্রযোজনায় ‘নাম  রেখেছি স্বাধীনতা’ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে দুই দিন ব্যাপী নাট্য উৎসব অনুষ্ঠানে। যেহেতু আমি মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমান্ডের কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলাম, তাই ছোট একটি দৃশ্যে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। এই নাটকের অন্যতম কাহিনী ছিল শহীদ মনু মিয়া। এই সময় আরো বেশি করে জানতে পারলাম কে এই শহীদ মনু মিয়া।  কিন্তু নিজের জন্মস্থানে আগামী প্রজন্মের কাছে  স্মৃতি সংরক্ষণে দীর্ঘ ৫০ বছর সময়ের প্রয়োজন হলো তাও আবার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ও অর্থায়নে কয়েকজন আমেরিকা প্রবাসী  যারা হ্নদয়ে শিকড়কে লালন করেন, সেই রকম কিছু মহৎ মানুষের উদ্যোগে শহীদ মনু মিয়ার নিজের বাড়ীতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছিল ২০১৬ সালে।

আমরা কি এক হতভাগা বাঙালি যাদের আত্মদানে একটি লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি। আমাদের হাতে কি আর সময় আছে সেই সকল সূর্য সন্তানদেরকে আগামী প্রজন্মের কাছে তাদের বীরত্বকে অমর করে রাখতে। আমরা তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি কি ভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়, ব্যস্ত হয়েছি বিভিন্ন তবদিরের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বের পদক পাওয়া জন্য। কিন্তু এই সকল সূর্য সন্তানদেরকে ইতিহাস ঠিকই মূল্যায়ন করে। নিজের জন্মস্থানের হাইব্রিড রাজনীতিবিদরা তাদের আত্মত্যাগের শ্লোগান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, যখন নিজেদের জন্য বলটি গোল পোষ্টে প্রেরণ করেন, তখন ভুলে যায় তাদের বীরত্বকে আগামী প্রজন্মর কাছে অমর করে রাখার কথা।

২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে রেসকোর্স ময়দানে যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়ে ছিলেন, সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি লক্ষ লক্ষ  জনতার সম্মুখে বলেছিলেন, আমি জেলে থেকে আলিমের মুখে শুনেছি, নুরে আলম সিদ্দিকীর কুলে মাথা রেখে  মনু মিয়া বলে গেছে, ‘মুজিব ভাইকে বলো, আমি বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছি/আমি বাঙালীর জন্য রক্ত দিয়েছি…’

আমি শেখ মুজিবুর রহমান মনু মিয়ার রক্তের  সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবো না। স্বাধীনতার পর স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণে জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা নাখালপাড়ায় শহীদ মনু মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত করেন। অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীতে মনু মিয়াকে অমর করে রেখে গেছেন বাংলার মানুষের কাছে। যেখান থেকে জ্ঞানের ফুল ফুটবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু মনু মিয়ার রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন নাই। হয়তোবা বিয়ানীবাজারের মানুষরাই জানে না ঢাকায় একটি স্কুলের নামকরণ হয়েছে এই এলাকার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের নামে!

দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয়, আমরা কি এক হতভাগ্য এলাকাবাসী স্বাধীনতার চেতনার শক্তি আজ বেশ কয়েক বছর থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সফল শিক্ষামন্ত্রী আমাদের এই অঞ্চলের সন্তান নুরুল ইসলাম নাহিদ। উনি ইচ্ছা করলে সম্ভব ছিল শহীদ মনু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যমান কিছু করতে।

বিয়ানীবাজারে কি কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান/জায়গা জমি নেই, যেখানে শহীদ মনু মিয়া স্মৃতিস্তম্ভ  অথবা শহীদ মনু মিয়া নামে  কোন নতুন স্কুলের নামকরণ, সর্বশেষ কোন একটি পুরাতন প্রতিষ্ঠানে নতুন কক্ষে নাম করণ করা সম্ভব ছিল। এখনো আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ অপেক্ষা করছে। সত্যিকার অর্থে যদি বিয়ানীবাজার আওয়ামীলীগের অভিভাবকবৃন্দ ও আমরা যারা স্বাধীনতার চেতনা শক্তি হ্নদয়ে ধারণ ও লালন করি বলে বিভিন্ন সভা সমাবেশে দাবি করে আসছি, যদি এ শহীদের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকে তাহলে আজ মনু মিয়ার মৃত্যু তারিখে শপথ গ্রহণ করি  বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিতব্য দশতলা ভবনটি ‘শহীদ মনু মিয়া ভবন’ নামকরণ করা হোক। এই নামকরণের মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম শহীদের বীরত্ব গাতা  অমর হয়ে থাকবে এই অঞ্চলের আগামী প্রজন্মের কাছে।

আমাদের মতো বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম প্রবীণ মানুষের মুখে গল্প শুনে জানতে হবে না কে এই শহীদ মনু মিয়া। মনে পড়ে আমাদের নাটকের শেষ দৃশ্যের একটি গানের লাইন হিল- ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে/আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে-রে।’ যারা  শক্ত হাতে হাল ধরে ৫০ বছর পরেও শহীদ মনু মিয়ার স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যে সকল ভাইয়েরা ও আপনাদেরকে যারা সহযোগিতা করেছেন সকলের প্রতি রইলো আমার হৃদয়ের সমস্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

এই আলোকিত জনপদের প্রজন্ম জেগে উঠেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চায়, এই জনপদের কোন সূর্য সন্তানেরা আর অবহেলিত নয়। নিরাশ হওয়ার কিছু নেই কোন একদিন বঙ্গবন্ধুর সোঁনার বাংলায় সঠিক উত্তরসূরিরা তাদেরকে মূল্যায়িত করে আগামী প্রজন্মর কাছে বীরদের বীরত্বকে অমর করে রাখবে।

সেদিন  ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত উচ্চারণে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় লক্ষ লক্ষ মুজিব সৈনিকদের কন্ঠে ধ্বনিত হবে, যে সংগঠন স্বাধীনতার চেতনা শক্তি ধারণ করে, সেই সংগঠনে অনুপ্রবেশকারি রাজনীতিবিদদের ফরমালিনযুক্ত রাজনীতির চর্চা করার সুযোগ আর নেই।

আজ শহীদ মনু মিয়ার এই মৃত্যু দিবসে সকলের মুখে মুখে একটি শ্লোগানই মুখরিত হোক, ‘বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিতব্য দশতলা ভবনটি ‘শহীদ মনু মিয়া ভবন’ নামকরণ করা হোক।

লেখক– নুর উদ্দিন লোদী, লন্ডন প্রবাসী।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.