আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সিলেট টু ঢাকা: ভার্চুয়াল যুগ; ননভার্চুয়াল ভালোবাসা

জহুরুল ইসলাম শাহরিয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১০-০৮ ১৪:০৪:১০

জহুরুল ইসলাম শাহরিয়া :: আজকাল ভার্চুয়াল ভালবাসার মাঝে সত্যিকারের ভালবাসা খুব একটা পাওয়া যায় না ; বলতে গেলে দুষ্প্রাপ্য।

ঘড়িতে রাত ১ টা ৫৭। স্থান ভৈরব বাজার। রেল গাড়িটা মাত্র স্টেশনে থামলো। চা পান করার জন্যে একটা টং দোকানে গেলাম। গিয়ে দেখি ছবিতে থাকা চাচা আর চাচি (চাচার বউ) পরনে ময়লা কাপড়। চা খাচ্ছে, কথা বলছে চোখে চোখে। বোধহয় ভালবাসার কথা। আমি দাঁড়িয়ে উনাদের দেখার চেষ্টা করছি।

এতো রাতে দুইজন বৃদ্ধ মানুষ বসে চা খাচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে যে কারোরই কথা বলার আগ্রহ জাগতে পারে। চাচার কাছে গিয়ে বসলাম। কৌতুহলবশত চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, -চাচা কোথাও যাচ্ছেন? উনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখটা চাচির দিকে দিয়ে চাচির সাথে কথা বলছে। আরো কিছু জিজ্ঞাস করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন রেসপন্স নেই। হয়তো ভাবছে, কি লাভ কথা বলে। একটা ছেলে আসছে কথা বলার চেষ্টা করছে। কোন বড় লোকের ছেলে; দয়া দেখাতে আসছে। কিন্তু আমার ভেতর একটা আগ্রহ কাজ করছিলো। জানার অনেক ইচ্ছা। এতো রাতে দুইজন বৃদ্ধ মানুষ এখানে কি করছে? চা খেতে আসছে? বৃদ্ধ মানুষই বা এতো রোমান্টিক হয় কিভাবে? এসব চিন্তা থেকেই আগ্রহ নিয়ে নিজ থেকে কথা বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু চাচা কি যেনো বিড়বিড় করে বলছে।
-চাচা!
-জ্বি।
- সাথে কি চাচি?
-জ্বি।
- কি করেন আপনি?
-কিছু না৷
-আশেপাশেই থাকেন কি?
-জ্বি।

ট্রেন আসতে এখনো ঢের দেরি। আমার ইচ্ছা করছিলো উনার সাথে গল্প করেই বাকি সময় কাটিয়ে দেই। কিন্তু নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে হয়তো উনি আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু তিনি যতটা'ই না আমার সাথে কথা বলছেন না, ঠিক ততটা'ই আমার জানার আগ্রহ বাড়ছে। একটু জোর করেই বললাম!
- চাচা আপনার কয় ছেলে মেয়ে?
- এক ছেলে এক মেয়ে।
-আপনি কি উনাদের সাথেই থাকেন?
চাচা কোন কথা বললেন না৷
-উনারা কি করেন?
-মেয়টারে বিয়ে দিছি। ছেলেটা..... (অস্পষ্ট আর বিড়বিড় করে কি যেন বললেন)

ছেলেটার কথা বলতে গিয়েই যেন এক বাদামি রঙের দুঃখ এসে গলার স্বর অস্পষ্ট করে দিলো। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র মেধা থেকে বুঝলাম, যে তার আপন কেউই তার পাশে নেই।

ততক্ষণে উনার চা শেষ। পকেট হাতড়ে কয়েকটা দুই টাকার নোট বের করে হাতে নিলেন। উনি বোধহয় বিলটা দিয়ে চলে যেতে চাচ্ছেন। আমি হুট করেই বললাম;
চাচা আরো এক-কাপ চা খাবেন?
- না বাবা।

আমি এখনো চা'র অর্ডার দেই নাই। দোকানদার মামাকে বললাম। মামা দু'টা চা দেন। একটা আমাকে আর একটা চাচাকে। চাচা না করার আগেই আমি উনার হাতে ওয়ান টাইম কাপটা দিয়ে বললাম, চাচা এই চা'টা খেলে খুব খুশি হবো। চাচা একটা হাসি দিয়ে কাপটা হাতে নিলেন। তারপর আমার চা'টা চাচির হাতে দিয়ে চাচার কাছে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর উনি নিজ থেকেই বললেন;
চাচা এই দুনিয়ায় আপন বলতে, এই বুড়ি ছাড়া আর কেউ নাই। এই বুড়িটাই আমার সব। আমার সব কাজের সাহায্যকারী। ছেলেটা থেকেও নেই। কথা বলতে বলতে চা শেষ করলেন। তারপর বললেন চাচা আমি আসি। আমি বললাম আচ্ছা চাচা। চাচি উনার হাতটা ধরলেন, ধরে সামনের দিকে হাটতে হাটতে চলে গেলেন। আমি চা'র বিলটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

চাচা জন্ম থেকেই যে চোখে দেখতে পায় না। প্রথমে আমার উনার প্রতি আকর্ষিত হওয়ার এটাও একটা বড় কারন। উনারা প্রতিদিন রাতেই এখানে চা খেতে আসে। সকালে ভিক্ষা করে কিছু টাকা রোজগার করে। কোনদিন খায় আবার কোনদিন খায় না। কিন্তু প্রতিদিন রাতে এখানে এসে কিছুক্ষন দু'জন গল্প করে, চা খায় আবার চলে যায়। এটাই তাদের ভালবাসা!

এই ভালবাসাটা কি অদ্ভুত! একজন জন্ম থেকেই দেখতে পারেনা। চোখে কখনোও দুনিয়ার রঙ দেখেনি। অথচ আরেকজনের চোখে সে রঙধনুর সাত রঙ দেখতে পায়।

একজন জন্ম অন্ধ মানুষ, যার কিছু নেই। পেশায় ভিক্ষুক। কিন্তু তার সব থেকে বড় সম্পদ তার স্ত্রী । যে তাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যায় নি। সুখের সময় ছিলো কি না জানি না, তবে সকল দুঃখের সময় পাশে থেকেছে। জীবন সাথী হলে এরকমই হতে হবে। এটাই সত্যিকারের ভালবাসা। জয় হোক ভালবাসার!

সিলেটভিউ/৮অক্টোবর২০১৮/এমইউএ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন