Sylhet View 24 PRINT

সিলেট-৪ আসন: সংসদ নির্বাচনের সেকাল-একাল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-০৩ ১৩:৪২:৫৯

আব্দুল হাই আল-হাদী :: সিলেট-৪ আসন মূলত: জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত একটি আসন। প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত সমতল অংশ নিয়ে এ আসন গঠন করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের পর সে ঐতিহাসিক সে রাজ্যের পাহাড়ী অংশ ভারতের অংশ হয়ে যায় এবং বর্তমানে সেগুলো ভারতের মেঘালয়ের  ইস্ট জৈন্তিয়া হিলস ও ওয়েষ্ট জৈন্তিয়া হিলস নামে পৃথক দুটি জেলার মর্যাদা লাভ করেছে। ইতিহাসের বাঁকে সে আসনের সীমানার অদল-বদল ঘটেছে। যাহোক, সে সমতল অংশের সংসদ নির্বাচনে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আগ্রহী পাঠক ও তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা হল।

১৮৩৫ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত জৈন্তিয়া একটি স্বাধীন ও প্রভাবশালী রাজ্য ছিল।শেষ রাজা ইন্দ্র সিংকে সিলেট শহরে রাজা মুরারিচাঁদের বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয় এবং এখানেই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ব্রিটিশরা সে রাজ্যটি করায়ত্ব করলেও ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দলইগণ সে রাজ্যের শাসন কাজ পরিচালনা করেন। ব্রিটিশরা খুব একটা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেনি তখন পর্যন্ত।  ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা সে অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করতে থাকে এবং নিজেদের ক্ষমতার পাকাপোক্তকরণের দিকে মনোযোগ দেয়। এতে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে আস্তে আস্তে ব্রিটিশদেও বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হতে থাকে।

নিজেদের ঐতিহ্যবাহী জীবন ও সংস্কৃতির উপরও আস্তে আস্তে হস্তক্ষেপ করলে ১৮৬০ জৈন্তিয়ারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সে বিদ্রোহ প্রচন্ড যুদ্ধে রুপলাভ করে এবং ১৮৬২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ইতিহাসে ব্রিটিশবিরোধী সে বিদ্রোহ  সিন্টেং বা জৈন্তিয়া ব্রিদ্রোহ নামে পরিচিত । সে বিদ্রোহের অকুতোভয় নেতা উ কিয়াং নাংবাহকে ১৮৬২ সালের ৩০ ডিসেম্ভর জোয়াইতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে সে বিদ্রোহ দমন করে জৈন্তিয়া অঞ্চলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পরবর্তিতে সে রাজের সমতল অংশ সিলেটের সাথে এবং পাহাড়ের বিস্তৃত অংশ আসামের সাথে যুক্ত করা হয়।
 
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম প্রত্যক্ষ  নির্বাচন হয়  ১৯৩৭ সালে। ভারতশাসন আইন ১৯৩৫  ভারতের শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ভারতের সংবিধান সম্পর্কে বৈঠকের আলোচনা ও সুপারিশসমূহ যৌথ নির্বাচন কমিটিকে  প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের পরিকল্পনা সংবলিত একটি খসড়া  প্রস্তাব শ্বেতপত্রের আকারে প্রকাশ করে। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে যৌথ নির্বাচন কমিটি এ শ্বেতপত্রের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে এবং এটিকে চূড়ান্ত রূপদান করে। ১৯৩৫ সালের ৫ ফের্রুয়ার হাউস অব কমন্সে একটি বিল উত্থাপিত হয়। বিলটি আইনে পরিণত হয় ১৯৩৫ সালের ৪ জুন, এবং ২ আগস্ট তা রানীর সম্মতি লাভ করে।১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ৩২১টি ধারা ও ১০টি তফসিল সংবলিত একটি অতি দীর্ঘায়িত ও জটিল সংবিধি। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কারও নিকটই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবুও উভয় দলই এ সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। হিন্দুপ্রধান প্রদেশ  মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও উডড়িষ্যায কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং বোম্বে ও আসামে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাদেশিক আইনসভার ১৫৮৫টি  আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭১১টি আসন লাভ করে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগের একটি  অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।( তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া)।

বর্তমান লেখায় ১৯৩৭ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সিলেট-৪ আসনে নির্বাচিতদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল।

১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রত্যক্ষ নির্বাচনে খুবই অল্প বয়সে ছাত্র থাকাবস্থায়ই এমপি (এমএলএ) নির্বাচিত হন মুসলিম লীগের আব্দুছ সালাম। তাঁর বাড়ি কানাইঘাট উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। তিনি পরবর্তীতে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে এই আসন কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট নিয়ে ছিল। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও কারণে নির্বাচন স্থগিত হলে তিনি দ্বিতীয় টার্মও এ আসনে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৬ সাল আসাম পার্লামেন্টের অনির্বাচিত সদস্য ছিলেন সিলেটের পাঠানটুলার এডভোকেট আব্দুল হামিদ। সিলেট সদর তখন এ আসনের সাথে যুক্ত ছিল।

১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা মাওলানা ইব্রাহীম চতুলী। কানাইঘাট উপজেলার চতুলের এই বিখ্যাত আলেম ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। তাঁর ছবি পাওয়া যায়নি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সমর্থিত ও কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী মকবুল হোসেন নির্বাচিত হন। তাঁর মুল বাড়ি ছিল কানাইঘাট উপজেলার বীরদল /গহড়া গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি গোয়াইনঘাটের বাসিন্দা হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে এ আসন শুণ্য হয় এবং উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৫৬ সালের উপনির্বাচন বিজয়ী হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী গোয়াইনঘাটের ডৌবাড়ি নিবাসী ফয়জুল হাসান। তার বাড়ি ছিল লংপুর গ্রামে। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে চেয়ার প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন উপমহাদেশের  প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী। তাঁর কাছে সেদিন পরাজিত হয়েছিলেন সাবেক স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মা সিরাজুন্নেসা চৌধুরীর মত বিদূষী ও সম্ভান্ত্র ঘরের প্রার্থী। সে সময় এই আসন সিলেট সদর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেবার ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভোটের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করা হতো।

১৯৬২ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে  জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট থেকে নির্বাচিত হন গোয়াইনঘাটের মো. সাইফুল আলম এবং কানাইঘাট-জকিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হন কানাইঘাটের মো. আব্দুস সালাম। পরবর্তীতে  মো. সাইফুল আলম জলীল হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে মাত্র ১৮ মাসের মাথায় তার পদ চলে যায় এবং আসন শুন্য হয়। এতে সেখানে উপনির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনে সিলেট সদরের খন্দকার আব্দুল জলীল নির্বাচিত হন। মন্ত্রী হওয়ার কারণে আব্দুস সালামের পদও শুন্য হলে উপনির্বানে  কানাইঘাট সদরের বীরদল গ্রামেরএডভোকেট আহমদ আলী নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী সিলেট সদরের আজমল আলী চৌধুরী নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই সিলেট শহরের দরগাহ এলাকায় নিজ বাসার কাছে আততায়ীর হাতে নিহত হন পাকিস্তানের এই মন্ত্রী।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে কানাইঘাট সিলেট-৪ আসন থেকে আলাদা হয়ে যায়। এ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামীগের দেওয়ান ফরিদ গাজী। তার বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। তিনি বাংলাদেশ আমলে মন্ত্রী ছিলেন। এ সময় সিলেট সদর এ আসনের সাথে যুক্ত ছিল।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সিলেট-৪ আসনে বিজয়ী হন কানাইঘাট উপজেলার রতনপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান (তোতা মিয়া)। তিনি নিজপাট ইউনিয়ের সাবেক চেয়ারম্যান দৌলা ও বর্তমান চেয়ারম্যান সম্রাটের যথাক্রমে চাচা ও দাদা। তখন পর্যন্ত কানাইঘাট এ আসনের সাথে যুক্ত ছিল।

পরবর্তীতে কানাইঘাট জকিগঞ্জের সাথে যুক্ত হয় এবং ১৯৭৯ সালে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন  বিএনপি’র প্রার্থী ডাকসুর সাবেক জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। তার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর গ্রামে। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন জনাব ইমরান আহমদ। তিনি আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচন করেন এবং তাঁর বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে। বর্তমান একাদশ নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বদ্ধিতা করছেন।

১৯৮৮ সালের পাতানো ও একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী হন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ. হান্নান। তার বাড়ি গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলী গ্রামে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।  ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন জনাব ইমরান আহমদ। তিনি আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচন করেন এবং তাঁর বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর সেই একতরফা ও প্রহসনের নির্বাচনে মাত্র চার দিনের জন্য এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম.সাইফুর রহমান।

১৯৯৬ সালের ১২ই জুন ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে বিজয়ী হন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম.সাইফুর রহমান । তিনি এ আসন ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ। তিনি তৃতীয়বার এ আসন থেকে নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন দিলদার হোসের সেলিম।  তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচন করেন এবং তাঁর বাড়ি গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং চা বাগান সংলগ্ন রাধানগর গ্রামে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে সিলেট-৪ আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামীলের জনাব ইমরান আহমদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে দশম সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন ইমরান আহমদ। তিনি বর্তমান এমপি। এবারও তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামীলীগের  প্রার্থী হিসেবে।

আব্দুল হাই আল-হাদী-লেখক ও পরিবেশকর্মী

 

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.