আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

নৈতিক অবক্ষয়ের রঙ্গমঞ্চে শিক্ষাঙ্গন, লাগাম ধরবে কে?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২৩ ১৪:৪০:২৮

শাকির আহমদ :: আমরা জানি, শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান বিতরণ নয় মূল্যবোধ তৈরি করা। সেই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থী মানুষ হওয়ার ভিত তৈরি করে ছোট থেকেই। ধীরে ধীরে সে বড় হয়ে ওঠে চেতনায়। শিক্ষার্থীর সেই ভিত অনেকটাই তৈরি করে দেন একজন শিক্ষক। তাই শিক্ষকরা সমাজের সবচাইতে সম্মানের আসনে বসবাস করেন।

শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম। বর্তমানে এই আবেগ অনুভূতিতে কেমন যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশ বিরাজ করছে। এই জন্য আসলে দায়ী কে শিক্ষক নাকি শিক্ষার্থী নাকি অভিভাবক?

বর্তমানে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষক শাসন করলে অভিভাবক বলেন নির্যাতন। শিক্ষকরা অনেকে বিবেককে বিক্রি করে শিক্ষার্থীদের সাথে গড়ে তুলেছেন আর্থিক সম্পর্ক। টাকা দিলে সাজেশন দিবো, না দিলে পরীক্ষায় মার্কস কম দিবো এমন নীতিতে শিক্ষকদের দিনাতিপাত। আর শিক্ষক-অভিভাবকদের লাগামাহীন ঘোড়দৌড় খেলায় শিক্ষার্থীরা চ্যাঙদোলা দিয়ে লাফায়। ফলাফল- ‘আই এম জিপিএ ফাইভ’।

দৃশ্য-১: চলমান এসএসসি পরীক্ষায় নকল করতে বাধা দেয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি উপজেলার ইছাপাশা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সূনীতি রানীকে জুতাপেটা করে রক্তাক্ত করেছে পরীক্ষার্থী মনিষা কর ও তাঁর মা মাধবী কর।

দৃশ্য-২: বিদ্যালয়ে দেরীতে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শেখ আজিজ উদ্দীন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র সাব্বির হোসেনকে বেত্রাঘাত করেন ক্রিড়া শিক্ষক আমজাদ হোসেন। সেই ছাত্র বাড়িতে গিয়ে তার বাবা আব্দুল হান্নানকে বিদ্যালয়ে ডেকে এনে ওই শিক্ষককে মারধর করে।

দৃশ্য-৩: ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের লিডো কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড জুনিয়র স্কুলের শিক্ষক রেজাউল করিম শ্রেণিকক্ষে আবির তালুকদার নামে এক ছাত্রকে শাসন করেন। ছাত্রটি বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বিষয়টি জানায়। এতে বাবা আবুল কালাম ক্ষিপ্ত হয়ে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওই শিক্ষককে পেটাতে থাকেন। এতে ওই শিক্ষকের ডানহাত ভেঙে যায়।

বেশিদিন আগে না এই তো এই শতাব্দীর প্রথম দিকে আমরাও প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস চলাকালীন কিংবা পরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষক দেখলে এক অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ অনুভূতি কাজ করতো। শিক্ষকরাও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিজের সন্তানদের মতো ভালোবাসতেন। পড়ালেখায় একটু দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের নজর থাকতো বেশি। এমনকি দুষ্টু-চঞ্চল শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা কৌশলে শাসন করতেন উনারা। কখনো কখনো বাধ্য হয়ে বেত্রাঘাত করতেন। প্রয়োজনে অভিভাবক ডেকে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার ব্যাপারে সজাগ করতেন। অভিভাবকরাও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে ওই সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ও নৈতিকতার ব্যাপারে সজাগ থাকতো। শিক্ষকরা টিউশনি করতেন তবে সেটা শুধুমাত্র বাণিজ্য-মানসিকতার ভিত্তিতে নয়। গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা খুব অল্প টাকা মাসিক বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে বিনাবেতনে শিক্ষকরা পড়াতেন শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায়।

মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ওইসব চিত্রের ঠিক উল্টোপৃষ্ঠে অবস্থান করছি আমরা। শিক্ষকদের আঙিনায় চড়া বেতনে প্রাইভেট পড়ার লাগামহীন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় ধনীর দুলালরা দোলনায় চড়ছে, মধ্যবিত্তরা প্রতিনিয়ত হোঁচট খাচ্ছে আর গরিব মেধাবীরা ঝড়ে পড়ছে। সমীকরণ আরেকটা আছে, মধ্যবিত্ত মাঝামাঝি মেধাবীদের আবার নামীদামি শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে চান না। কারণ, সেই শিক্ষার্থীর পেছনে সময় বেশি ব্যয় করতে হবে। কম সময়ে অধিক টাকা উপার্জনের মাধ্যম মেধাবী শিক্ষার্থী। অভিভাবকরাও বেতন বেশি দিতে রাজি তবে শর্ত একটাই জিপিএ ফাইভ চাই..ই..চাই। পরীক্ষার আগে সেই শিক্ষক অনেক মূল্যবান একটা সাজেশন এনে সেই শিক্ষার্থীর হতে দেন। শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টা (সাজেশন) সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। মধ্যবিত্তরা কষ্ট করে বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে খেয়ে না খেয়ে শিক্ষকদের বেতন যোগাড় করে দেন। আর গরিব পরিবারের সন্তানরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসের উপর নির্ভরশীল হলেও সেখানে দেয়া হচ্ছে একটি গরুর দুইটি শিং, দুইটি চোখ, দুইটি কান ও একটি লেজ আছে এমন ধরনের লেকচার।

শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের এই হ-য-ব-র-ল সম্পর্কের কারণে শিক্ষকদের প্রতি অভিভাবকদের শ্রদ্ধা নেই, শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সম্মান নেই, শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের আবেগ ও ভালোবাসা নেই। শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের আবেগঘন ভালোবাসা নেই, শিক্ষকদের অবসরকালীন বিদায়ে শিক্ষার্থীদের চোখে পানি নেই।

সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক পড়ালেখায় সবাই জিপিএ ফাইভ চায়। আগেও সবাই ভালো রেজাল্ট পাওয়ার মোহে সাধনা করতো। তবে তখন শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতা করে, পড়ার পেছনে সময় দিয়ে রেজাল্ট ভালো করতো। আর এখন শিক্ষক আর কিছু কোচিং ভিত্তিক সাজেশনের উপর ভর করে রেজাল্ট ভালো করা হচ্ছে। পার্থক্য, আগে শিক্ষার্থীদের মাঝে নীতি-নৈতিকতা বোধ প্রখর ছিলো আর এখন তারা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায় মগ্ন।

একপেশে শিক্ষকদের দোষারোপ করার কোন সুযোগ নেই। অভিভাবকরা এর জন্য অনেকটাই দায়ী। আগে পড়াশোনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দেয়া কোন শাসনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অভিভাবককে কিছু বলার চিন্তাও করতো না। আর এখন সহনশীল আচরণ থেকে সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন অভিভাবকরা। আর আমরা হুজুগে বাঙালিরা কোন কিছু বুঝার আগেই মানববন্ধনের মতো আন্দোলনের আয়োজন করে ফেলি। সেই শিক্ষক হন সবার কাছে নিন্দিত আর সেই শিক্ষার্থী হয় ক্যাম্পাসের আলোচিত (?)। এমন সমীকরণে শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সরল থাকার সুযোগই বা কই!

মানুষের নৈতিক শিক্ষার শুরু হয় পরিবার থেকে। সেই নৈতিক শিক্ষার সাথে জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমন্ময় হয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। বর্তমানে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় গড়ে উঠছে আমাদের শিক্ষাঙ্গন। এই ব্যবস্থা আমাদের সমাজকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে জানি না তবে এতোটুকু উপলব্ধি করছি, শিক্ষকদের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, আবেগ ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে।


লেখক: সাংবাদিক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন