Sylhet View 24 PRINT

"পিতার লোভে, পুত্র ধ্বংস"

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৪-২১ ১৭:০৯:০৩

নূরউদ্দিন লোদী :: "অতি লোভে তাতি নষ্ট ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু" প্রচলিত এই কথাগুলোর সাথে আমাদের সমাজে সকলেই মোটামুটি পরিচিত। বেশির ভাগ সময় আমরা নিজের লোভটাকে সংবরণ করতে পারিনা বলেই এই লোভের জন্য আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধাবোধ করিনা।

আর আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় এমন অনেক পিতা আছেন, যারা নিজেদের লোভকে সংবরণ করতে না পেরে নিজের সন্তানকে জেনেশুনেই মৃত্যুর পথে যাত্রী করে দিচ্ছে। এসব বাস্তবতার চিত্রগুলো বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি গোচরে হচ্ছে।

যৌথ পরিবারে একজনের সীমিত আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরিবারের বেকার যুবকদের একটা অংশ বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি আর চায়ের আড্ডায় সময় দিয়ে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে ফেলছে- এরকম অনেক চিত্রই আমাদের সমাজে দেখা যায়। মাঝে মধ্যে এমন হয় যে, পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের আবদার রাখার দায়িত্বও ঐ উপার্জনকারী ব্যক্তির উপর পড়ে। অথচ এই বেকারদেরকে দেখলে কিংবা তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, যদি তাদের হাতে এ রাষ্ট্রকে তুলে দেয়া হয় তাহলে অল্পদিনেই তারা তা মালেশিয়া বা সিঙ্গাপুরে রূপান্তরিত করে ফেলবে।

কথায় আর যুক্তিতে মুক্তোর ফুলঝুরি অথচ নিজেরা যে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বসে বসে পা তুলে খাচ্ছে সে বোধটুকু কখনোই তাদের জাগ্রত হয়না। এক সময় দেখা যায় পরিবারের কর্তা ও স্বজনরা বলেন, এই নাদুস-নুদুস বেকারের অনেক বয়স হয়ে যাচ্ছে! যেন পূর্ব আকাশের উদিত সূর্য এখন পশ্চিম আকাশের দিকে অস্তমিত হতে চলেছে আর অপেক্ষা করা যাবে না, বেলা পড়ে যাচ্ছে তার সংসারের পরিপূর্ণতার প্রয়োজন আছে। তার বিয়ের কাজটি সেরে ফেলতে হবে। বিয়ের পরে যখন মাথার উপর দায়িত্ব আসবে তখন বেকার থাকার চিন্তা মাথার মধ্যে থেকে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্নই ঘটে থাকে। পরিবারের ঐ বেকার যুবক বিয়ের পর দায়িত্বশীল হওয়া তো দূরে থাক, তার নিজের বৃদ্ধিকৃত সদস্যদের দায়িত্ব পরিবারের ঐ সীমিত আয়ের ব্যক্তিটিকেই নিতে হয়।
যখন যৌথ পরিবারগুলোতে নতুন প্রজন্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, বেকার মানুষ এখন অনেক ছেলেমেয়ের পিতা হয়ে গেছেন।

পৃথক ছোট পরিবার গঠন করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।

স্ত্রী-সন্তানাদিদের খরচ যোগাতে প্রতিদিন হিমশিম খেতে হয়। এক সময় সিদ্ধান্ত নেন, নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে কিংবা ধারদেনা করেই হোক দশ বারো বছরের ছোট্ট সন্তানকে পাঠাতে চান স্বপ্নের দেশ লন্ডনে। আর লন্ডনে থাকা আত্মীয় স্বজনরাও উৎসাহিত করেন। তাদের ধারনা, ছেলেটি লন্ডনে গেলে হয়তো বেকার পিতার দুঃখ ঘুচবে, পরিবারের হাল ধরবে। সময় ও বাস্তবতার খাতিরে এক সময় দালালের মাধ্যমে ঠিকই অবুঝ কিশোর ছেলেটি লন্ডনে চলে যায়।

সেখানে যাবার পর প্রথমে আত্মীয়-স্বজনদের স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসায় কোন কমতি মিলেনা। কারণ হয়তো ভাইয়ের অথবা বোনের ছেলে লন্ডন আসছে সেই আনন্দে। ভাই কিংবা বোনের ছেলেটি দেশের বাড়ির সকল স্মৃতি মনে করে যেন মন খারাপ না হয়, তাই সকল আত্মীয়-স্বজনরা বেশ অধীর আগ্রহে খোঁজ খবর নিতে থাকেন। কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে এই কিশোর ছেলেটি আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বোঝা হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন জায়গায় তার জন্য কাজ খোঁজতে হয়। অনেকে আবার এই বাচ্চা ছেলেটাকে কাজে নিতে চায়না। তারও দুইটি কারণ আছে- প্রথমত, কাজের বৈধ কাগজপত্র এবং দ্বিতীয়ত, লন্ডনের রাষ্ট্রীয় নিয়ামানুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কোন ছেলেমেয়ে পূর্ণদিবস কাজ করার অনুমতি নেই। তাই কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকই সেই ঝুঁকি নিতে চান না। অনেক সময় দেখা যায়, আত্মীয়-স্বজনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ হয় এই কিশোর ছেলেটির। এক দিকে বৈধ কাগজপত্র নেই, আবার অল্প বয়স থাকার কারণে কাজের জায়গায় প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কাজের পরেও সিনিয়র সহকর্মীদের অনেক কাজ করতে হয় ( কাজ শেখানোর লোভ দেখিয়ে কিশোর ছেলেটি দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হয় ) অন্য সহকর্মীরা মনে করেন, মালিক তাদের সকলের জন্য একটি কাজের ছেলের ব্যবস্থা করেছেন।
আর এভাবেই একজন বেকার লোভী পিতার কিশোর ছেলেটি সংসারের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য অজানা এক দূরদেশে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিশোরটি যখন দেখে তার সামনে গন্তব্যহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে, তখন একটু একটু করে তার মনে ঐ লোভী পিতার প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়। যে মানুষটি সারাজীবন বসে বসে পায়ের উপর পা তুলে দিন কাটিয়েছে সে আজ আমাকে কিশোর বয়সে লেখাপড়া বন্ধ করে স্বার্থপরের মতো অচেনা এক দূরদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। যার কারণে আমাকে এই সমাজে অবহেলিত মানুষের মতো জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আমার অপরাধটা কি? না কি পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটাই আমার অপরাধ? এমন হাজারো ঘৃণা ভরা প্রশ্ন তখন কিশোর ছেলেটির মনে বাসা বাধে।

আস্তে আস্তে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের সকল জমানো কষ্ট নিয়ে সে অন্ধকার জগতের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক সময় দেখা যায় লন্ডনে থাকা আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে দেশের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। এমনকি লোভী পিতার সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হতাশ লোভী পিতা, একদিকে সংসারের দায়িত্ব অন্যদিকে ছেলে নিরুদ্দেশে আত্মগোপন। লন্ডনে থাকা আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার পরিচিত সকলের কাছে একটি আকুতি-মিনতি জানান, যদি আমার ছেলের সাথে দেখা হয় তাহলে এই খবরটা দিও। তার গর্ভধারিণী মা কাঁদলেও এখন আর তার চোখে জল আসে না। একটি ভারের জন্য হলেও সে যেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে বলে, সে কেমন আছে।

আমাদের প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ছেলে মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর প্রবণতা অনেক বেশি। উন্নত জীবনের জন্য বিদেশে পাঠাবেন এখানে অপরাধের কিছু নেই, তবে লেখাপড়া শেষে প্রাপ্ত বয়সে পাঠানোই হচ্ছে উত্তম সিদ্ধান্ত। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাস করছি, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তাদের আর্তনাদের গল্প শুনে এবং আমার নিজের চোখে দেখা বাস্তবাতার চিত্র থেকে বলছি, যারা কিশোর বয়সে এদেশে এসেছেন তাদের অধিকাংশই এখন পথভ্রষ্ট। তাই নিজের অভিজ্ঞতার আলোকপাত করলাম।
সর্বশেষে এই মিনতি করছি- স্বার্থপরতাই যেন হোক, কিন্তু সহনীয় মাত্রায়, সন্তানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে নয়।


লেখক: নূরউদ্দিন লোদী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.