Sylhet View 24 PRINT

চায়ের কাপে ধোঁয়া ওড়ে ধোঁয়ার সাথে গল্প ঘোরে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-২৩ ১১:২৮:৩৭

মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::এক কাপ চায়ের আমেজে সজীব হয়ে উঠার নৈমিত্তিক গল্পের সাথে চা-বাগানের ভেতরের গল্প তেতো স্বাদের মিশেল ছাড়া কিছুই নয়। জন্মের পর থেকে চা খেতে খেতে বড় হবার কোনো স্তরেই চা নামক পণ্যটির উৎপাদনে নিযুক্ত জনগোষ্ঠীর গল্প শুনতে হয় না। অজস্র পণ্যের বাজারে চা-পণ্যকে আলাদা করে দেখারই বা কী আছে? পয়সা দিলে পাতি মেলে, পাতি দিয়ে চা তৈরি হয়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো চায়ের দোকানে সুলভ মূল্যে প্রতি কাপ চা পাওয়া যায়। তরতাজা চায়ের স্বাদ এসে আমাদের ঠোঁটে-মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে দেয়। আমরা নতুন উদ্যমে কাজের ভেতর ডুব দিয়ে অতীত ভুলে যাই। একঘেয়েমি ভর করলে আবার চুমুক চায়ে। আবার ভুলে যাই অতীত। যুগের পর যুগ ধরে চলছে এ গল্প। ছয় লক্ষাধিক চা-জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন, শিক্ষাহীনতা, চিকিৎসাহীনতা আমাদের চায়ের কাপের উড়ুক্কু ধোঁয়ার গতিপথ কিছুতেই আটকে দিতে পারে না। বাংলাদেশের চা-বাগানগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। শুধু চা-বাগানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য পাঁচতারকা হোটেল নির্মিত হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। আরো হোটেল নির্মানের অপেক্ষায়। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে অবসর কাটাতে চা-বাগানের সাহচর্যে। অপরূপ সবুজের হাতছানি আর জাতি-বৈচিত্র উপভোগ করতে শ্রীমঙ্গলের টিলার ভাঁজে অসংখ্য মানুষ আসে প্রতিদিন। সাতরঙের চা ও সাজানো বাগানের দৃশ্যের আড়ালে নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় একটি কুঁড়ি দুটি পাতা তুলে আনার বিত্তান্ত ঢাকা পড়ে থাকে। চোখের সামনে অপূর্ব দৃশ্য রেখে রঙিন চায়ে চুমুক দিয়ে এক জনমের ক্লান্তি ভুলে যায় মানুষ। যাদের হাত ধরে বাগানের চা-পাতা উঠে আসে অবিরাম, তাদের ক্লান্তি কখনো শেষ হতে পারে না।

বাংলাদেশের একশো ছেষট্টিটি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে বিরানব্বইটি, সিলেটে উনিশটি, হবিগঞ্জে চব্বিশটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি, চট্টগ্রামে বাইশটি, রাঙ্গামাটিতে একটি, পঞ্চগড়ে সাতটি, ঠাকুরগাঁওয়ে তিনটি চা বাগান রয়েছে। আরো কিছু বাগান প্রস্তুত হবার প্রক্রিয়াধীন। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আসাম ও সিলেটের চাবাগানগুলো গড়ে ওঠে। তৎকালে নতুন এ শ্রমঘন শিল্পে প্রচুর পরিশ্রমী শ্রমিকের দরকার ছিলো যা স্থানীয় শ্রমিকদের সাধ্যাতীত। ঠিক সে সময় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। সেই সুযোগটিই কাজে লাগায় ব্রিটিশরা।

দালালদের মাধ্যমে ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য জায়গা থেকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসাম ও সিলেটের চা বাগানগুলোতে কাজে আসতে শ্রমিকদের প্ররোচিত করা হয় । এমনও শোনা গেছে যে, শ্রমিকদেরকে বলা হয়েছে, ওখানে গাছ ঝাঁকালে পাতার বদলে পয়সা পড়ে। উন্নত জীবনের প্রতিশ্রতি দেয়া হয়েছে। সেটি যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিলো, শ্রমিকদের বুঝতে বেশি সময় লাগে নি। কিন্তু ফিরে যাবার কোনো উপায় ছিলো না তাদের।

এ প্রসঙ্গে চা-শ্রমিকের সন্তান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিখাপিরেগু পত্রিকায় লিখেছেন,
এতো পরিকল্পিত ভাবে প্রতারণা করার কারণ হলো, এসব শ্রমিক অপেক্ষাকৃত গরম ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় বসবাসকারী, অশিক্ষিত, নিম্নবর্ণের গরিব-জনগোষ্ঠী; স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় বেশি কষ্ট-সহিষ্ণু ও পরিশ্রমী। যেহেতু এঁরা স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি অপরিচিত, তাঁদেরকে দেশ, সমাজ ও পরিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দি-শ্রমিক হিসেবে যুগ যুগ ধরে, এমনকি ভবিষ্যত প্রজন্মকেও অল্প মজুরিতে কাজে লাগিয়ে রাখা যাবে বলে মনে করেছিলো বৃটিশরা।

চা-শ্রমিকদের এই বঞ্চনার কথা তাদের মধ্যে অনেকেই গানে গানে প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সময়। সেই গানগুলো রুক্ষ গলায় এদেশীয় ঢঙে গাওয়া হয়েছে। ঝুমুরের গান। অনেকটা ভাওয়াইয়া গানের কাছাকাছি। ভাষাগত একটা সামান্য ভেদরেখা থাকলেও স্থানীয় গানের অংশ হয়েই বিকাশ লাভ করেছে সেগুলো। আসামের ডলু চা-বাগানের এক সাধারণ শ্রমিক বঞ্চনার কথা বলছে গানে গানে,
'ফাকি দিয়ে নিয়ে এলো রে আসামের বাগানে
গোরা সাহেব বলেছিলো পয়সা পাবি বলে
গোরা সাহেব বলেছিলো সুখে থাকবি বলে.....'

ঝুমুরগানের কিংবদন্তী গদাধর বাউলের একটি গানের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি,
''ঝাকরপুটি টাকরমাছ
মিছাই ভাবো সাত-পাঁচ
নিজ মুরতি করো মনের সুখে।
মনোরে, বেহুস হইলে লিয়ে নেবে চোরে।।
গদাধর তাই বলে ভেবে
ঘুমাইয়ো না জাইগে রবে।।
ঘুমাই গেলে লিয়ে যাবে চোরে
ও মনোরে, বেহুস হলে লিয়ে যাবে চোরে।।''

রূক্ষভূমির মানুষ চা-বাগানে কাজ করতে এসেছিলো পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে। কিন্তু তাদের সংস্কৃতির উপাদান 'ঝুমুর গান' তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে।
চা শ্রমিকদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল নাঁচ। এরমধ্যে ঝুমুর নাঁচ, সাওঁতাল নাঁচ ও লাঠি নাঁচ অন্যতম।
এসব নাঁচের বেশির ভাগই এসেছে নানা পূজা ও পার্বণ থেকে।
ঝুমুর নাঁচ এসেছে করম পূজা থেকে।
সাহিত্যরত্ম হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রার উদ্ভব ঘটেছে। ঝুমুরতালের অসংখ্য গান রয়েছে কিংবদন্তী শিল্পী ভূপেন হাজারিকার। বাংলাদেশের 'জলের গান' ব্যান্ডদলের একটি জনপ্রিয় গান 'বকুল ফুল বকুল ফুল' ঝুমুর তাল ও সুরের গান।

চা বাগানে বসবাসরত সাওঁতাল সম্প্রদায়ের সাওঁতাল নাঁচ খুব আকর্ষণীয়।
তারা নিজ ভাষায় গান গেয়ে, মাদল, রাম করতাল ও বাঁশি বাজিয়ে নাঁচ পরিবেশন করে।
ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমায় হোলি উপলক্ষে লাঠি নাঁচ হয়। লাঠি নাঁচের নামগুলো হচ্ছে পিঠজোড়নি, সন্ধিবেঠ, তিনডাড়িয়া, ছেটরা, রেখনি।

ভাওয়াইয়া গানের ঢঙে ঝুমুর গান, যাত্রাপালা এবং লাঠিখেলা তিনটিই বাংলার লোকজ সংস্কৃতির গুরত্বপূর্ণ অংশ। চা-শ্রমিকদের সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বাঙালি সংস্কৃতিরই বিকাশ সাধন হয়েছে। চা-শ্রমিকের ইতিহাস মানেই বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস বললে অত্যূক্তি হবে না। বংশানুক্রমে বঞ্চিত হবার করুণ এই ইতিহাস আজকের সভ্য সমাজে খানিকটা অদ্ভুতই বটে। দেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত এই নাগরিকদের স্বাভাবিক অধিকারগুলোও সংকুচিত। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে শ্রমের মূল্য নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ থাকলেও সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে জিইয়ে থাকা সংকট তাদের স্বাবলম্বী হবার পথে বিরাট বাধা। চা-জনগোষ্ঠীর কেউ সরকারি চাকুরী কিংবা উচ্চ শিক্ষায় উপজাতি কোটা সুবিধা পায় না।
ঝুমুরের তালে চা-জনগোষ্ঠীর আরেকটি খুব বিখ্যাত গান আছে, যেটা দোহার শিল্পীগোষ্ঠী গেয়ে হালে জনপ্রিয় করেছে। গানটিতে প্রলোভনে পড়ে বাঁকুড়া থেকে আসামের চাবাগানে যাওয়া এক নারী শ্রমিক তার কন্যাশিশুকে উপলক্ষ্য করে কথাগুলো বলছে,

'চল মিনি আছাম যাবো
দেশে ভরা দুখরে,
আছাম দেশেরে মিনি চাবাগান হরিয়া,
এক পয়সার পুটিমাছ কায়াগোলার তেলগো
মিনির বাপে মাঙে যদি আরো দিবো ঝোলগো।।
গোরমারা যেমন তেমন পাতি তোলা কামগো
হায় যদুরাম ফাকি দিয়া পঠাইলি আছাম
সর্দার বলে কাহম কাহম বাবু বলে ধইরা আন
সাহাব বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম ফাকি দিয়া পঠাইলি আছাম।
হায় যদুরাম ফাকি দিয়া পঠাইলি আছাম।।"

গানটিতে মর্মান্তিক আর্তনাদ জুড়ে রয়েছে। নিচের অংশটুকুও একই সুরে গাওয়া হয়,

'বানাই দিলি কামিন কুলি
টাঙাইলে দিলি পিঠে ঝুলি
ঝুলি টাংগাইল ভিখারি বানাইলি
নিঠুরোসাম জনমে জনমে কাদাইলি।'

গানটিতে যদুরাম একজন দালালের নাম, যে তাদের উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়েছিলো। বাবু বলতে চা-বাগানের ম্যানেজার আর সাহাব বলতে বাগানের মালিক ইংরেজ সাহেবকে বুঝানো হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ফাকিতে পড়ার নিদারুন হাহাকার দিয়ে ভরা এই গানটি। মজার বিষয় হলো, এখনো চা বাগানগুলোতে ম্যানেজারকে 'সাহেব' এবং বিভিন্ন কর্মকর্তাদের 'বাবু' বলে সম্বোধন করা হয়। এই গানের সুর চা-শ্রমিকরা নিয়ে এসেছে তাদের আদি বসতি বাঁকুড়ার এই গান থেকে,
"কলি কলি ফুল ফুটেছে নীল কালো আর সাদা
কোন ফুলেতে কৃষ্ণ আছে কোন ফুলেতে রাধা
কালো জলে উজলাতলে ডুবলো সনাতন
আজ সারানা কাল সারানা পাইছে দরশন।"

বর্তমানে বাংলাদেশের চা শিল্পে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক লাখ ত্রিশ হাজার। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যাও প্রায় সমান। শ্রমিকদের মধ্যে পঁচাত্তর ভাগই মহিলা শ্রমিক।

চা-বাগানের মালিক ব্যক্তি হলেও চা বাগানের ভূমির মালিক রাষ্ট্র। চা-শ্রমিকরা তিনপুরুষ ধরে বাগানের বাসিন্দা হয়েও তাই ভূমির মালিকানা পায় নি। আর এই কারনে বাগানের বাইরে গিয়ে উচ্চ মূল্যে শ্রম বিক্রির সুযোগ থাকলেও তারা বাগান ছেড়ে চলে যেতে পারে না। চলে গেলে ঠিকানা হারাবে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির প্রায় আটানব্বইটি জাতিগোষ্ঠী চা-বাগানে বসবাস করে।উৎপাদন আর ব্যবস্থাপনার দিক বিবেচনা করে চা-বাগান বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা দেয়া হয়। ইজারা হিসেবে সরকারকে প্রতি বছর দিতে হয় হাজার টাকা মাত্র। তবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নতুন যে চা-বাগানগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ব্যবস্থাপনা আলাদা। সেখানে ঠিকানাবিহীন শ্রমিকের ভূমির সাথে কোনো অদৃশ্য বন্ধন নেই। তদুপরি বাইরে রিক্সা চালানো, পরিবহন ও গ্যারেজে অধিক পারিশ্রমিকের আশায় চা-শ্রমিকদের কাজ করার প্রবণতা বেড়েছে। তাই চা-বাগানগুলো চা-পাতা তোলার ভরা মৌসুমে শ্রমিক সংকটে পড়ে।

চা-জনগোষ্ঠীর নাগরিক-রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু তার বাস্তবায়নটাই কেন যেন হচ্ছে না। ঠিক কি কারনে বাস্তবায়ন হচ্ছে না তার সুনির্দিষ্ট কোনো হদিস নেই আমাদের কাছে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে সবার আগে দরকার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। চা-বাগানগুলোর শিক্ষার হাল খুবই খারাপ। এখন পর্যন্ত প্রায় তেত্রিশ জন চা বাগানের শিক্ষার্থী ঢাবি, জাবি, জবি, রাবি, বেরোবি, কুবি, শাবিপ্রবি, সিকৃবি, ঢাকা মেডিকেল, সিলেট মেডিকেলে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। প্রতিটি চা-বাগানেই চা-বাগান কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি সহযোগিতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসকল বিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষকমন্ডলী মানসম্মত নয় বলেই মনে হয়। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত মাত্র চৌত্রিশটি বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মিত হতে পেরেছে। বাকিগুলোর শিক্ষক স্বল্পতা এবং অবকাঠামোর অপ্রতুলতা প্রকট। শিক্ষকদের দৈনিক ভিত্তিতে মজুরী দেয়া হয়। একজন শ্রমিকের মতো শিক্ষকের মজুরীও দৈনিক একশত দশ টাকা।

তার উপর উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় না থাকায় বাগানের শিশুরা দ্রুতই ঝরে পড়ে। আশেপাশে যেসব বিদ্যালয় রয়েছে সেসব বিদ্যালয় বাগান থেকে অনেক দূরে দূরে অবস্থান করায় শিশুরা পড়াশোনা চালিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া অভিভাবকের সামান্য মজুরীতে পেটের ভাতই জোটে না, পড়াশোনার খরচ কোথায় পাবে? একটা জরীপে দেখা যায়, বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেকেরও বেশি শিশু অনুপস্থিত থাকে এবং অনেকে ভর্তিই হয় না। এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকার ফলেই হয়েছে বোধ করি। কেননা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধকল্পে যেসব উপায় অবলম্বন করা হয়, প্রচলিত বিদ্যালয়গুলোতে তার কোনোটিই নেই। মালিকদের মুনাফা সংক্রান্ত হিসেবের ফাঁকে আটকা পড়ে থাকে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমান সরকারের এসডিজি সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষায় যে যুগান্তকারি পদক্ষেপসমূহ নেয়া হচ্ছে, চা-বাগানের শিশুরা সেসব পদক্ষেপের সুবিধা পাবার অধিকারই শুধু রাখে না, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য এটি অপরিহার্য। এত সংখ্যক শিশুকে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন আশা করা যায় না।

চা-বাগানগুলোর চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত নয়। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার খুব বেশি। চা-শ্রমিকেরা আট বাই এগার ফুট মাপের একটি ঘরে অন্তত তিনটি প্রজন্ম বাস করে। বাংলাদেশের চা-শ্রমিকেরা বহুকাল ধরে নিরক্ষরতা, নিপীড়ন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক, মশা, সাপসহ বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় খেয়ে মাত্র একশত দশ টাকার বিনিময়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে যায়। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার প্রাক্কালে এই বাস্তবতা রীতিমত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

যেই চা আমাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সভ্যতা-ভব্যতার নিয়ামক হয়ে উঠেছে সেই চায়ের শ্রমিক এবং তাদের শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা থেকে রাষ্ট্র পিছিয়ে যেতে পারে না। কোমলমতি শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা একটি গুরত্বপূর্ণ দায়। এ দায় সমাজ এবং রাষ্ট্রের। চা-বাগানের সকল শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন সেই দায়েরই অংশ। একটি রাষ্ট্রের ভেতর দৃশ্যমান এ বৈষম্য সকল নাগরিকের জন্য বিব্রতকর। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকল শিশুর ভর্তি এবং পড়াশোনা নিশ্চিত করে এই বিব্রতকর দশা দূর করা সম্ভব। সারাদেশে শতভাগ ভর্তি অর্জিত হয়েছে। ঝরে পড়ার হার শূণ্যে নামিয়ে আনার কাজ প্রায় সম্পন্ন। এমতাবস্থায় চা-বাগানের বিপুল সংখ্যক শিশুকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার সুযোগ নেই। প্রচলিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে বাগান মালিকদের যে অর্থ ব্যয় হয়, বিদ্যালয়গুলো সরকারিকরণ হলে সেই অর্থ তাদের সাশ্রয় হবে। তাই এ কাজে বাগান-মালিকদেরও এগিয়ে আসতে অনীহা থাকার কথা নয় বলেই আমরা মনে করি।

বাঙালির ইতিহাস লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাঙালির ইতিহাস বঞ্চিত হবার ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের এই কথাগুলো সকল নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার সাথে মিলে যায়। পৃথিবীর সকল নিপীড়িত জাতি তাই বাঙালি জাতির সহমর্মী এবং আত্মার সুহৃদ। চা-জনগোষ্ঠীর চির বঞ্চনার ইতিহাস, নিপীড়িত হবার ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের চূড়ান্তে গিয়েই তো দেশটা স্বাধীন হলো এবং বাঙালি জাতি রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার অর্জন করলো। হাজার বছরের ক্ষত বুকে বয়ে চলছে বাঙালিরা। সেই জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে চা-জনগোষ্ঠীর বঞ্চিত হবার ইতিহাস আর দীর্ঘায়িত হতে পারে না। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করা এই জনগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতিকেও করেছে শাণিত এবং পরিশীলিত। বলা যায় আত্ম-নিবেদনের ঢঙে সাংস্কৃতিক অন্তঃশক্তিকে সবল করছে। এই সবল করার প্রচেষ্টাকে আরো গতি দিতে পারলে আখেরে রাষ্ট্রের লাভ, বাঙালির লাভ। মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে পূর্ণ নাগরিকের সুবিধা নিয়ে বিকশিত হবার সুযোগ করে দিলে চা-জনগোষ্ঠীর জীবন যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি সমৃদ্ধ হবে বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতি।

আর্থ সামাজিক অবস্থার কারনে তারা তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখতে পারছে না। চা শ্রমিকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভূজপুরী ভাষায় কথা বলে। যার ফলে নিজেদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্র কমে গেছে। গবেষকরা বলছেন এদের রক্ষা করতে হলে এখনি এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। নয়তো এক সময় তাদের আসল পরিচয় হারিয়ে যেতে পারে। আর এদের রক্ষা করতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশে বহু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বসবাস। প্রত্যেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সাংস্কৃতিক কিছু পরিচয় কম-বেশি সকল জাতিসত্তার মধ্যে এখন পর্যন্ত টিকে থাকলেও অনেকের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। কারো কারো একেবারেই হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ জাতি-পরিচয়ও ভুলে গেছে। বর্ণমালাসহ মাতৃভাষা টিকে আছে হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। টিকে থাকা ভাষাগুলোকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। চা-জনগোষ্ঠীর ভাষা মুখে মুখে টিকে আছে। তবে তাদের বর্ণমালা নেই। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুদ্র পরিসরে এখনো বজায় আছে। এই জনগোষ্ঠীর শিল্প-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গবেষণাকেন্দ্র গঠন করা যেতে পারে। সরকারিভাবে এর একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন আছে। মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চা-জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা করারও উদ্যোগ নেয়া দরকার। এর মাধ্যমে রক্ষা পাবে বাংলাদেশের জাতি-বৈচিত্র এবং জাতীয় সংহতি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে চা-শ্রমিকদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। রক্ত ও জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে তারাও ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বেশ কিছু চা-শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও মানবেতর জীবন থেকে স্বাধীনতা পায়নি তারা।  শ্রীমঙ্গলে গেলে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি দেখতে পাওয়া যায়। কালাইগুল, লাক্কাতুরা চা-বাগানের শ্রমিকদের উপর পাকসেনারা গণহত্যা চালিয়েছিলো। হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগান তো মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়ার্টারই ছিলো বলা যায়। প্রতিটি চা-বাগানেরই রয়েছে এই রক্তাক্ত ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত ঝরানো এমন একটা জনগোষ্ঠীকে কোনোক্রমেই রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা উচিৎ নয়।

লেখকঃ
মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৩ আগস্ট ২০১৯/মিআচ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.