আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

একজন আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-২৬ ০০:১৯:১৫

সিদ্ধ মাধব দাস :: যিনি সারা বিশ্বে সনাতন ধর্মকে প্রচার করে ব্যক্তিগত ভক্তি, একনিষ্টতা, অদম্য শক্তি ও দক্ষতার দ্বারা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ প্রতিষ্ঠা করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভগবদ্ভক্তির মার্গে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ও ভক্তিযুগের ভিত্তিতে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁর প্রকৃত নাম শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।

মহান এই আচার্য ১৮৯৬ সালে ভারতের কোলকাতায় আবির্ভূত হন। তাঁর পিতৃদেব শ্রীযুক্ত গৌর মোহন দে সম্ভ্রান্ত সুবর্ণ বণিক সমাজের একজন স্বচ্ছল কাপড়ের ব্যবসায়ী এবং মাতা রজনী দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণা। অভয়চরণ দেখতেন, তাঁর মা কি রকম সরলতা সহকারে সকলের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতেন, পূজা-পার্বণ করতেন তাঁর মনে তা গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। ৬৯ বছর বয়স ১৯৬৫ সালে তিনি ভগবদ্ভক্তি প্রচারের জন্য আমেরিকায় পৌছান। তখন থেকেই আত্মপ্রত্যয়ী গুরু আমেরিকা আসার পর কঠোর পরিশ্রম করে একের পর এক সারা বিশ্বে ভগবদ্ভক্তি প্রচারে সাফল্য লাভ করেন।

১৯২২ সালে কলিকাতায় তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ছিলেন ভক্তিমার্গের বিদগ্ধ পণ্ডিত এবং ৬৪টি গৌড়ীয় মঠের (বৈদিক সংঘের) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই বুদ্ধিদীপ্ত, তেজস্বী ও শিক্ষিত যুবকটিকে বৈদিক জ্ঞান প্রচারের কাজে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। শ্রীল প্রভুপাদ এগার বছর ধরে তাঁর আনুগত্যে বৈদিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে ১৯৩৩ সালে এলাহাবাদে তাঁর কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হন।

১৯২২ সালে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল প্রভুপাদকে ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞান প্রচার করতে নির্দেশ দেন। পরবর্তীকালে শ্রীল প্রভুপাদ ভগবদ্গীতার ভাষ্য লিখে গৌড়ীয় মঠের প্রচারের কাজে সহায়তা করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি এককভাবে একটি ইংরেজী পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এমন কি তিনি নিজে হাতে পত্রিকাটি বিতরণও করতেন। পত্রিকাটি এখনও সারা পৃথিবীতে তাঁর শিষ্যবৃন্দ কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।

১৯৪৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদের দার্শনিক জ্ঞান ও ভক্তির উৎকর্ষতার স্বীকৃতিরূপে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ’ তাঁকে “ভক্তিবেদান্ত” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫০ সালে তাঁর ৫৪ বছর বয়সে শ্রীল প্রভুপাদ সংসার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে চার বছর পর বানপ্রস্থ আশ্রম গ্রহণ করেন এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন, প্রচার ও গ্রন্থ রচনার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরাধা-দামোদর মন্দিরে বসবাস করতে থাকেন এবং অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। শ্রীশ্রীরাধা-দামোদর মন্দিরেই শ্রীল প্রভুপাদের শ্রেষ্ঠ অবদানের সূত্রপাত হয়। এখানে বসেই তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্য ও তাৎপর্যসহ আঠার হাজার শ্লোকের অনুবাদ করেন এবং ‘অন্য লোকে সুগম যাত্রা’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন।

১৯৬৫ সালে ৭০ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ কপর্দকহীন অবস্থায় আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে পৌঁছান। প্রায় এক বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করার পর তিনি ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকন। তার সযত্ন নির্দেশনায় এক দশকের মধ্যে গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী শতাধিক আশ্রম, বিদ্যালয়, মন্দির ও পল্লী-আশ্রম।
১৯৭৪ সালে শ্রীল প্রভুপাদ পশ্চিম ভার্জিনিয়ার পার্বত্য ভুমিতে গড়ে তুলেন নব বৃন্দাবন, যা হলো বৈদিক সমাজের প্রতীক। এই সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর শিষ্যবৃন্দ পরবর্তী কালে ইউরোপ ও আমেরিকায় আরও অনেক পল্লী আশ্রম গড়ে তোলেন।

শ্রীল প্রভুপাদের অনবদ্য অবদান হল তার গ্রন্থাবলী। তাঁর রচনাশৈলী গাম্ভীর্যপূর্ণ ও প্রাঞ্জল এবং শাস্ত্রানুমোদিত। সেই কারনে বিদগ্ধ সমাজে তাঁর রচনাবলী অতীব সমাদৃত এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ সেগুলি পাঠ্যরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। বৈদিক দর্শনের এই গ্রন্থাবলী প্রকাশ করছেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থ-প্রকাশনী সংস্থা ‘ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট।’ শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের সপ্তদশ খণ্ডের তাৎপর্যসহ ইংরেজী অনুবাদ আঠার মাসে সম্পূর্ণ করেছিলেন।

১৯৭২ সালে আমেরিকান ডালাসে গুরুকুল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রীল প্রভুপাদ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বৈদিক শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রচলন করেন। ১৯৭২ সালে মাত্র তিনজন ছাত্র নিয়ে এই গুরুকুলের সূত্রপাত হয় এবং আজ সারা পৃথিবীর ১৫টি গুরুকুল বিদ্যালয়ে ছাত্রের সংখ্যা সহস্রাধিক।

পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীল প্রভুপাদ সংস্থার মূল কেন্দ্রটি স্থাপন করেন ১৯৭২ সালে। এখানে বৈদিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য একটি বর্ণাশ্রম মহাবিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনাও তিনি দিয়ে গেছেন। শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশে বৈদিক ভাবধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রকম আর একটি আশ্রম গড়ে উঠেছে বৃন্দাবনের শ্রীশ্রীকৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরে, যেখানে আজ দেশ-দেশান্তর থেকে আগত বহু পরমার্থী বৈদিক সংস্কৃতির অনুশীলন করছেন।

শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থাবলীর ভূয়সী প্রশংসা করে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী,শ্রীলালবাহাদুর শাাস্ত্রী বলেছিলেন , “শ্রীমৎ এ.সি.ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এক অমূল্য কর্তব্য সম্পাদন করেছেন । মানব সমাজে মুক্তির জন্য  তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি এক অনবদ্য অবদান ।”
 
একজন বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক এবং সাহিত্যিক জোসেফ জিন লানজো জেল ভাস্টো বলেছিলেন,”এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ হচ্ছেন একজন অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু আচার্য এবং এক মহান সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ।”

১৯৭৭ সালে এই ধরাধাম থেকে অপ্রকট হওয়ার পূর্বে শ্রীল প্রভুপাদ সমগ্র জগতের কাছে ভগবানের বাণী পৌঁছে দেবার জন্য তাঁর বৃদ্ধাবস্থাতেও সমগ্র পৃথিবী চৌদ্দবার পরিক্রমা করেন। মানুষের মঙ্গলার্থে এই প্রচার-সূচির পূর্ণতা সাধন করেও তিনি বৈদিক দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বিত বহু গ্রন্থাবলী রচনা করে গেছেন, যার মাধ্যমে এই জগতের মানুষ পূর্ণ আনন্দময় এক দিব্য জগতের সন্ধান লাভ করবে।

আজ শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের ১২৩ তম শুভ আবির্ভাব তিথি। বিশ্বের মানুষ আজ তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভক্তিভরে।




লেখক- সিদ্ধ মাধব দাস, ইসকন সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন