Sylhet View 24 PRINT

ইন্দানগর সবুজ টিলার ভাঁজে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-০৭ ২২:৪৪:৫৭





::  মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::


মাঝে মাঝে ভুল করে এমন কিছু জায়গাতে ঢুকে পড়ি, শাপে বর হয়ে যায়। আবাল্য ঘুরাঘুরির অভ্যাসটি থাকার কারনে এই রকম অনুভূতি জীবনে বহুবার হয়েছে। তেমনি এক অনুভূতি আমাকে রোমাঞ্চিত শিহরিত করে তুললো সেপ্টেম্বরের এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল পূর্বাহ্নের সময়টুকুতে। ভুল করে অজায়গাতে ঢুকে পড়ার বিড়ম্বনা পোহাবার অভিজ্ঞতাও অকিঞ্চিতকর। তবে গলাকাটা বা চোর-ডাকাত আন্দাজ করে দৌড়ানি কিংবা গণপিটুনির মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা যে এখনো হয় নি, সেটা অবশ্যই ভাগ্যের কথা।

দিনকাল যা পড়ছে, একদিন হলেও হয়ে যেতে পারে দুর্ভাগ্যজনক সেই অভিজ্ঞতার উদ্ভব। সেদিন আসার আগ পর্যন্ত ঘুরেফিরে চোখ জুড়োনো আর হৃদয়ে পরম প্রশান্তির আমদানি চলছে, চলতে থাকুক। খাসিয়ারা সন্ধ্যা নামলেই পুঞ্জিতে যে তীর-ধনুক হাতে অপেক্ষা করে সেটাও কম আতংকের নয়।

ইন্দানগর চা-বাগানের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই বিস্তৃত সবুজের হাতছানি। ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল সারকারখানার ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ,  প্রায় তিন বছর ধরে আছে। সেখানে আমার বেড়াতে গিয়ে ঘুরতে বের হওয়া। চা-বাগানের সীমানা দিয়েই মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার শুরু আর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার শেষ। তো এমন একটি পয়েন্টে দাড়িয়ে একটি বিশেষ অনুভূতি হবে সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু চমকের শুরু এরপর থেকে।

চা-বাগান ধরে হাটতে শুরু করার পরই দুইজন খর্বকায় মানুষ চ্যালাকাঠের ভারী দুই স্তূপ কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে চলে গেলো আমাদের পাশ দিয়ে। আমরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম তাদের দিকে। ঘন ঘন টিলার সারি আর অপরিসর সমতলভূমি জুড়ে নিশ্ছিদ্র চা-গাছের বিস্তার। সবুজে সবুজে সয়লাব। কোথাও ফাঁকা নেই, সবুজ ব্যতিত আর কোনো রঙ নেই এখানে। সূর্যের সাদা আলো দিনের উজ্জ্বলতা মাখিয়ে প্রগাঢ় করেছে সেই সবুজকে।

চা-বাগানের দুইটি অংশ। উত্তরভাগ ও ইন্দানগর। এটি রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নে পড়েছে। দক্ষিণ ও পূর্বদিকে দুইটি পাকা রাস্তা চলে গেছে। জাহিদ আর আমি প্রথমেই ধরলাম পূর্বদিকের পথ। পথটা চলে গেছে ইন্দানগর পানপুঞ্জির টিলার দিকে। দুইপাশে সবুজ চা-গাছ দিয়ে মোড়ানো টিলার সারি রেখে আঁকাবাঁকা পথ ধরে যেতে যেতে গভীর জঙ্গলের অনুভূতি আসে মনে।

বাঁশ-বাগান আর কাঠের গাছের সারি ধরে ঘন সুনিবিড় নিসর্গের পরিবেশ। ছায়া ও রোদে মিলে চিকচিক করছে চারদিক। খাসিয়াদের মাত্র সতেরটি ঘরের বসবাস পানপুঞ্জির টিলায়। টিলার গায়ে খাঁজকাটা সিঁড়ির পথ ধরে উপরে উঠতে উঠতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠলাম। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। এত উচুতে নিত্য আসা-যাওয়া করা মানুষগুলো খুবই পরিশ্রমী।

খাসিয়াদের বসতভিটা দেখার মধ্যে একটি বিশেষ আকর্ষণ থাকে সব সময়। বার্মিজ পোশাকে আবৃত মহিলাগণ ঘরের বারান্দায় বসে পান-পাতার গোছগাছ করছে, পরিষ্কার উঠোন, ছিমছাম-পরিপাটি আঙিনা এবং শিশুর সারল্য নিয়ে মানুষগুলোর চকিত চাহনী। টিলার উপর উঠতেই চোখে পড়তে লাগলো। উঠোন আর ঘরের মেঝের পরিচ্ছন্ন পরিসরটুকু খাসিয়াদের নান্দনিকতাবোধের স্মারক হয়ে বিরাজমান থাকে।

লম্বা উঠোন ধরে হেটে গিয়ে টিলার শেষাংশে গির্জাটার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। পাশেই একটি ছোট্ট কমিউনিটি সেন্টার, মনে হলো সরকারি খরচে নির্মিত। বসতির শেষ যেখানে সেখান থেকে শুরু নিখাদ পানপুঞ্জির। খাসিয়াদের জীবন পান-পাতার জীবন। পানেই বাঁচা পানেই মরা। শুনেছি, বহিরাগত কেউ পানে হাত দিলে খাসিয়ারা তার হাত কেঁটে ফেলে! কথাটা আক্ষরিক অর্থে না নিলেও পান-পাতা তাদের পরম আদরের বস্তু তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সারি সারি সুপারী গাছের গায়ে লতার মত জড়ানো পানের গাছ।

একটু সামনে যেতেই বাগান থেকে কাজ করে ফেরা এক যুবকের সাথে দেখা। নাম আমেডেস। হ্যা আমেডেস। খ্রিস্টান বলেই হয়তো নামের ভেতর ইংরেজিয়ানা। খাসিয়াদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। বাংলায় কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটে।

আমেডেসের কাছ থেকে জানা গেলো, পান ছাড়াও তাদের আরো কিছু পণ্য রয়েছে যা বিক্রি করে বছরের বিভিন্ন সময়ে হাতে কিছু পয়সা আসে। কাঠাল, লিচু, আনারস, লেবু, লটকন, আদা, আগর গাছ ইত্যাদি। আমেডেস ত্রিশোর্ধ বছরের যুবক। ফর্সা গায়ের রঙ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কাজ করার কোনো চিহ্ন নেই তার শরীরে। কথাও বেশ গুছিয়ে বলে। মনে হলো, বাইরে থেকে ঘুরতে আসা মানুষদের সামলাতে সে অভ্যস্ত।

ফেরার পথে পানির পিপাসা লাগলো। পরিষ্কার গ্লাসে পানি পানের ব্যবস্থা করলো আমেডেস। আমাদের ছেড়ে এসে ঘরের বারান্দায় বসেছিলো সে। এই টিলায় মানুষ পানি পায় কোথা থেকে? জানা গেলো, টিলা থেকে নেমে সাবমার্সিবল পাম্প থেকে পানি তুলে আনতে হয়। প্রতিদিন পানি টেনে উপরে আনা এখানকার লোকদের একটি কষ্টকর ব্যবস্থাপনা। বিদ্যূতের খুটি পোঁতা হয়েছে, বিদ্যূত সংযোগ হয় নি এখনো। অচিরেই তাদের পানির কষ্ট দূর হবে আশা করি, বৈদ্যূতিক মোটরের কল্যাণে।

দীর্ঘদিন ধরে সৌরবিদ্যূতের ব্যবহার চালু আছে। সৌরবিদ্যূতে খাসিয়ারা রঙিন টিভি দেখে। ডিসলাইনের সংযোগও রয়েছে। সবটা দেখে মনে হলো, আধুনিক জীবনের প্রায় সকল সুবিধাই তারা পাচ্ছে। পাকা রাস্তা থেকে হঠাৎ উঁচুতে টিলার উপর চড়তে হয়, জীবন যাপনের অস্বস্তি বলতে এটুকুই।

পানপুঞ্জি থেকে বের হয়ে পথের সংযোগস্থলে এসে এবার চললাম দক্ষিণের রাস্তা ধরে। এই রাস্তা চা-শ্রমিকদের বসতিতে গিয়েছে। ইন্দানগর বাজার হয়ে সামনেই দেখলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশে বিশাল খেলার মাঠ। সেই মাঠে চা-শ্রমিকদের সন্তানরা দলবেধে খেলছে ফুটবল।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আগে ডানপাশে পড়লো দূর্গামন্দির। সেখানে প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে। সামনের মাসে দূর্গাপূজা। মন্দির প্রাঙ্গনে বিরাট নাটমন্দির দেখে মনে হলো, এখানে কীর্তণ-ভজনের অনুষ্ঠান নিয়মিত হয়। অবশ্য এত বড় ও ব্যয়বহুল স্থাপনা সম্ভব হয়েছে সরকারি বরাদ্দ প্রদানের কারনে। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারি কিনা জানা গেলো না। দিনটা শুক্রবার বলে।

তবে এটা জানা যায়, অল্প কিছু চা-বাগান বাদে দেশের বেশিরভাগ চা-বাগানেই মালিকের ব্যবস্থাপনা ও খরচে চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এটি চা-শিশুদের মানসম্মত ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে একটি অন্তরায়। এই চা-বাগানের গোড়াপত্তন হয়েছিলো বৃটিশ আমলে। শ্রমিকরা তাই রাঢ়বঙ্গ থেকে আসা ভাগ্যান্বেষণের পথিক। বংশানুক্রমে চা-বাগানের সাথে বাধা পড়ে গেছে।

ফেরার পথে পাশেই কালভৈরবের খোলা মন্দির দেখে চোখ আটকে গেলো। বিকট দর্শনের ভৈরব মূর্তির বাহন কুকুর। বাম হাত এগিয়ে পেয়ালা ধরা, ডান হাতে বিরাট গদা ধরে কাধের উপর রাখা। শরীর পেঁচিয়ে সাপের ফঁণা-তুলে দাড়ানো বাম কাধের উপর দিয়ে। বাঘের চামড়া পরা ভয়ংকর এ মূর্তি শিবের অবতার। ব্রহ্মার মাথা কেটে রাগান্বিত শিবের একটি হিংস্র প্রকাশ যা মৃত্যু এবং বিনাশের সাথে সম্পর্কিত। এক মাতাল চা-শ্রমিককে মূর্তির পূজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বললো, সিদ্ধি দিয়ে পূজা করি। পূজা তারা যেভাবেই করুক, মূর্তিটাতে পাগলা বেশের আউলা-ঝাউলা রুদ্র-রূপ খুবই তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে।

গোল গোল পাথর ছড়ানো পাকা রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। সংস্কার হয় না দীর্ঘদিন। বাগান ছেড়ে ফিরে আসার সময় একটা ঘোরলাগা অনুভূতি নিয়ে মূল ফটক পার হলাম। ঝটিকা সফরের মত অদ্ভুত দর্শনে পুলকিত খানিকটা সময় অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকলো মনের মণিকোঠায়। টিলার ভাঁজে ভাজে এমন ভরপুর সবুজে বিস্তৃত পরিসর, মনের ভেতর তাজা অনুভূতির প্রস্রবণ বইয়ে দেয়। ছুটির দিনে ফাঁকা মৌসুমে পর্যটকের আনাগোনাহীন একটা নির্বিঘ্ন সময় রোমাঞ্চে শিহরণে দারুণ কেটে গেলো।

লেখক :: সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.