আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং
|| বহ্নি চক্রবর্তী ||
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’।
দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে।
দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে।
পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত। দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, আনন্দের উৎসব, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে মিলিত হওয়ার উৎসব।
দেবী দুর্গা তাঁর সন্তানসন্ততি সমেত ৫ দিনের জন্য স্বর্গ থেকে মর্তে আসেন। এই ক’দিন সকলেই সবকিছু ভুলে শুধু আনন্দে মেতে ওঠেন। নতুন জামাকাপড়, পুজো প্যান্ডেলে নতুন নতুন প্রেম, ভালোভালো খাওয়া দাওয়া, নানারকমের অনুষ্ঠান, আলোর রোশনাই সবমিলিয়ে ৫ দিন একেবারে জমজমাট।
আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। সর্বজনীন পুজোর সাথে সাথে কতগুলি বিখ্যাত বনেদি পুজোর আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এরকমই ২ টি বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজোর গল্প আজ আমার আলোচ্য।
আমার শহরে বনেদী বাড়ীর পুজো! সিলেট শহরের পরিচয় ছিলো এরকম আলী আমজাদের ঘড়ি, বঙ্কবাবুর দাড়ি আর চান্নি ঘাটের সিঁড়ি!
১.লাল ব্রাদার্স-প্রসিদ্ধ জমিদার প্রয়াত বঙ্ক বাবুর বাড়ী পরবর্তীতে (সাধু বাবুর বাড়ী) হিসেবে আজ বিখ্যাত, সিলেটের শেখঘাটে অবস্থিত লাল ব্রাদার্স বাড়ী এবং বনেদী পরিবার হিসেবে আজও বিখ্যাত। সিলেটে লাল ব্রাদার্স বাড়ীর পুজো ১৮১০ খ্রিঃ থেকে শুরু! লাল ব্রাদার্স এ বছর ২০৯তম দুর্গা উৎসব উদযাপন করতে চলছে!
জন্মাষ্টমীর পর থেকেই প্রতি বছর দেবী প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। একচালা ও ডাকের সাজের প্রতিমার পুজো করা হয়ে থাকে। তৎকালীন সময় ৮-১০ জন পুজোর পুরোহিত আসতেন ভারতের উড়িষ্যা থেকে। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন তারা। মহালয়ার পরের দিন থেকেই পুজা শুরু হতো, পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলিতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। পূজা উপলক্ষে বাড়িতে এখনো আত্মীয়-সমাগম হয়ে থাকে।
পারিবারিক কাঠামো
লালব্রাদার্স বাড়ির বংশধরেরা আসেন কাশ্মীর থেকে। কাশ্মীরের বণিক সম্প্রদায়। বলরাম দার বাবু আসেন কাশ্মীর থেকে মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদ থেকে উনার ছেলে বুনচাঁদ বাবু নবাব সিরাজদৌল্লার আমলে সিলেটের ছাতকে আসেন চুনাপাথর এর ব্যবসা করতে । তখন সেখানেই মায়ের পুজাে প্রথম শুরু করলেন বুনচাঁদ বাবু ।
যা পরবর্তীতে চালিয়ে যান বানছারাম বাবু।
বানছারাম বাবুর ছেলে ব্রজগোবিন্দবাবু সিলেটে আসেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সিলেট এসে জমিদারি কিনেন, শেখঘাটের বাড়ি থেকে শুরু করে লালাদিঘীর পাড়, মির্জাজাঙ্গাল, বন্দরবাজার, মাছুদিঘীর পাড়, লালবাজার, তালতলা থেকে শুরু করে মহাজনপট্টি, চালিবন্দর দিকেও বিস্তৃত ছিলো। এছাড়াও বিশ্বনাথ, ব্রহ্মময়ী বাজার এলাকায়ও জমিদারীর অংশ ছিলো।
ব্রজগোবিন্দ বাবুর ছেলে বঙ্কবাবু ছিলেন যিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ জমিদার। পরবর্তী সময় বঙ্কবাবু জমিদারি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেন। আর সেই পরম্পরা, বঙ্কবাবুর বংশধরেরাই বর্তমানে পালন করে যাচ্ছেন।
প্রয়াত বঙ্কবাবুর নাতি হলেন প্রয়াত সাধুবাবু, কানুবাবু ও পটলবাবু। সাধু বাবু সিলেট শহরের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। ছিলেন শ্রীহট্টে র সন্মানিত ব্যক্তিত্ব।
সাধু বাবুর জৈষ্ঠ কন্যা শ্রীমতি সাহা ! বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীপতি আজ বনেদী ও পরিবার হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে এক নামে পরিচিত, আর পি সাহার পুত্রবধূ! শ্রীমতী সাহা মির্জাপুর কুমুদিনী ট্রাস্টের চেয়ারম্যান।
প্রয়াত সাধু বাবু র কনিষ্ঠভ্রাতা (পটলবাবু) ওরফে প্রয়াত শ্রী বিদিত লাল দাস জমিদারি ছাড়াও বাংলাদেশের লোক সংগীতের প্রবাদ পুরুষ ছিলেন! সংগীতের পরিমন্ডল তাঁদের পরিবারে প্রথম থেকেই ছিলো।প্রয়াত বিদিত লাল দাসের পিতা প্রয়াত বিনোদ লাল দাস ছিলেন বিশিষ্ট পাকোয়াজ বাদক।
প্রয়াত বিজন বিহারী দাস। সন্তান- এক ছেলে এক মেয়েপ্রয়াত বিমলেন্দু দাস (সাধুবাবু) সন্তান- দুই মেয়ে এক ছেলেপ্রয়াত অমলেন্দু দাস (কানুবাবু)সন্তান -এক মেয়ে দুই ছেলে
প্রয়াত বিদিত লাল দাস (পটল বাবু) সন্তান- এক ছেলে।বর্তমানে পরম্পরা যারা নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। ডাঃ বনদীপ লাল দাস, বিশ্বদ্বীপ লাল দাস বাসু ও পরিববার বর্গ!
২.
সিলেটে বনেদি বাড়ির পুজোর মধ্যে যেটা বাদ দেওয়াই যায় না সেটা হল সিলেটের প্রানকেন্দ্রে চৌহাট্টায় অবস্থিত, সেন্ট্রাল ফার্মেসী বাড়ির পুজো। পরিবারের পরিচিতি প্রয়াত আইনজীবী বিনয়েন্দ্র কুমার দে'র সময়ে। ব্রিটিশ আমল ১৯৪৩ সাল প্রথম চৌহাট্টা বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন তিনি। এই বার ৭৭তম দুর্গা-পুজো উদযাপন করতে চলেছে সেন্ট্রাল ফার্মেসী।
দলিল বিভাগে পত্রস্থ হলো...১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি দেশে পরিণত হয়। ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান, সেই বছর প্রয়াত বিনয়েন্দ্র কুমার দে ঘটে মাকে আহবান করেন! দেশ বিভাজনে পর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিমা গড়ে পুজা করা হয়।
১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় সেন্ট্রাল ফার্মেসীর সবাই ভারতের শিলচর শহরে চলে যান, সেখানে আবার মায়ের পুজো করা হয়! তবে সেন্ট্রাল ফার্মেসী র সবাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন।
এরপর থেকে, একচালা ও ডাকের সাজের প্রতিমার পুজো করা হয়ে থাকে । এ বাড়ী র পুরোহিত মশাই রা ছিলেন প্রয়াত পন্ডিত সিতাংশু ভট্টাচার্য, প্রয়াত পন্ডিত সুরেশ চক্রবর্তী। বিভিন্ন সময় সিলেটের বড় বড় পন্ডিত পুরোহিত মশাই রা পুজার কাজ সম্পাদন করেছেন।
সেন্ট্রাল ফার্মেসী র পরিবার শাক্ত- বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত! কিন্তু প্রাণি বলি কোনো দিনই এই পুজোর অংশ হয়নি। পুজোর কদিন এই কারণেই সমস্ত সদস্যরাই নিরামিষ আহার করেন। দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পরই আমিষ খাবার খাওয়া হয়। এখানে দেবীর উপাচারেও রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য। লুচি-মিষ্টি-মণ্ডা ভোগের সঙ্গে থাকে চিনির মঠ।
এই পরিবারের মহিলারাই পুজোর সমস্ত কাজ করেন এবং সবাইকে খাবার বা ভোগ পরিবেশন করে থাকেন। প্রতি বছরই পরিবারের সমস্ত সদস্যরাই এই পুজোয় মিলিত হন। বাংলাদেশের বহু বিখ্যাত মানুষ এবং বিদেশ থেকেও অনেকে এই পুজো দেখতে আসেন। দশমীতে সিঁদুর খেলা এবং বিজয়া দশমীতে অষ্টদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ এই পরিবারের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এই বাড়িতে পুজোয় এসেছেন ডঃ মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারী এবং প্রেসিডেন্সী কলেজ কলকাতার অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বীরেন্দ্র চক্রবর্তী। এছাড়াও বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীরা প্রতিবছর দর্শন করতে আসেন। গতবছর দুর্গাপুজার সময় বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব দর্শন করেছিলেন। মেয়র এবং সংসদ সদস্যরা প্রতি বছর শ্রদ্ধা জানাতে বাসভবনে যান উপস্থিত থাকেন! শ্রদ্ধেয় অনেক ব্যক্তিতের উপস্থিতি এই পুজোর মাহাত্ম্য কে বাড়িয়ে তুলেছে।
পারিবারিক কাঠামো
সেন্ট্রাল ফার্মেসী পরিবার সেইব্রিটিশ আমল থেকে আদি নিবাসী চৌহাট্টায়!সেন্ট্রাল ফার্মেসী ১৯৪৫ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রয়াত বিজেন্দ্র কুমার দে'র হাত ধরে, সেন্ট্রাল ফার্মেসী তৎকালীন আমলে বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ঠে পূন্যভূমি সিলেটে । প্রয়াত বিজেন্দ্র কুমার দে,পেশায় একজন কেমিস্ট ছিলেন।
‘সেন্ট্রাল ফার্মাসি’ পরিবারে সারাবিশ্বে প্রায় ২০০ জন পরিবার সদস্য রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, হংকং ইত্যাদি শহরে এই পরিবারটি প্রায় আট দশক ধরে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। এই যৌথ পরিবারেরও প্রাথমিক ব্যবসাটি বাংলাদেশের সিলেটের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টায় অবস্থিত সেন্ট্রাল ফার্মেসী প্রাইভেট লিমিটেড। প্রয়াত বিনয়েন্দ্র কুমার দে ' র ৫ ভাই ও ১ বোন নাম দেওয়া হলো।
প্রয়াত বিনয়েন্দ্র কুমার দে পেশা: আইনজীবি
সন্তান: ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে।প্রয়াত- বিজেন্দ্র কুমার দে পেশা: কেমিস্ট
সন্তান- ৬কন্যা এবং ১ ছেলে।প্রয়াত- বীরেশ চন্দ্র দে পেশা: শিক্ষক
(পলিটেকনিক স্কুল)প রবর্তী সময় চাকরি ছেড়ে , সেন্ট্রাল ফার্মাসিতে যোগদান করেন। সন্তান: ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে।
প্রয়াত- বিমলেন্দু কুমার দে পেশা: জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে চাকরিরত ছিলেন।
পরবর্তী সময় এলিড ফার্মেসী (হাসান মার্কেট) ব্যবসায় যুক্ত হোন তিনি ছিলেন ঐ ফার্মেসী র স্বত্বাধিকারী। সন্তান: ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে অধ্যাপক বিজিত কুমার দে (অবসরপ্রাপ্ত) পেশা: অধ্যাপক মদন মোহন কলেজ, সন্তান: ২ ছেলে ও ১ মেয়ে।
প্রয়াত- গীতা দে (বোন) পেশা: গৃহিণী সন্তান: ২ ছেলে ও ৪ মেয়ে বর্তমানে পরম্পরা যারা নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন! দেবাশীষ দে বাসু, দিলীপ কুমার দে, অনুপ কুমার দে ও পরিবারবর্গ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অধ্যাপক বিজিত কুমার দে, অমিতাভ দে, বিশ্বদ্বীপ লাল দাস বাসু।
লেখক :: প্রবাসী কলামিস্ট