সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-০৭ ১৮:২৪:২০
আকাশ চৌধুরী :: ঢাকার অলি-গলিতে গড়ে ওঠা ক্লাব নামধারী স্থানে আবিস্কার হয়েছে অপরাধ জগতের আস্তানা। আইনশৃংখলা বাহিনীর জুয়া বিরোধী অভিযানে কোটি কোটি টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র, মাদকসহ আরও অনেককিছু। এসব দেখে সঙ্গত কারণেই ক্লাবের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরূপ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছে ক্লাব মানেই জুয়া, ক্লাব মানেই অপরাধীদের আনাগোনা। কিন্তু না, তাদের এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। তারা হয়তো অনেকেই জানেনা ‘ভূঁইফোড়’ এসব ক্লাবের কারণে যুগের পর যুগ ধরে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের গায়ে এর দাগ লাগতে পারেনা। আর এমনই একটি ১৩৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের নাম ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব’। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এ ক্লাব। সম্মান দিচ্ছে সমাজের হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধী এমনকি জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও।
রাজধানী ঢাকার কয়েকটি ‘বাণিজ্যিক’ ক্লাবে যেভাবে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়, সুন্দরী রমণীদের আনাগোনা ও অস্ত্রবাজদের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির বিষয়টি স্বাভাবাকি। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানের পর অনেকে বলেছেন, এসব ক্লাবের আয় দিয়ে তারা খেলোয়ার তৈরি করতেন। ক্লাব বন্ধ হয়ে গেলে খেলোয়ার তৈরি হবে না। অথচ গণমাধ্যমের খবরে এসেছে এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই শ’ শ’ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বিদেশেও। অভিযানকৃত ওই ক্লাবগুলোকে বাণিজ্যিক বলার অর্থ হলো এদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিজেদের আখের গোছানো। এই ক্লাবগুলোর সামাজিক কোনো দায়বোধও নেই এবং কখনো ছিল না বলেও মনে করা হয়।
আজকে যে ক্লাব নিয়ে এই লেখা সেই সিলেট স্টেশন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৬ সালে। ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করেছে তখনই তার প্রতিষ্ঠা। এ ক্লাব সম্পর্কে কিছু লেখার আগে একটু পেছনে ফিরে যাই। বিশিষ্ট সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার-এর ‘সামাজিক ক্লাব: অতীত ও বর্তমান’ লেখা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ববঙ্গ) প্রথম ক্লাব গড়ে বরিশালে, ১৮৬৪ সালে। তখন বাখেরগঞ্জ জেলার সদর কার্যালয় ছিল বরিশালে। এসবের ক্ষেত্রে মূলত ইংরেজদেরই ভূমিকা ছিল। তারা যেখানেই গেছে সেখানেই ক্লাব গড়েছে। ভারতবর্ষে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলেই প্রথম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম ‘ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাব’। এর গোড়াপত্তন হয় ১৭৯৩ সালে। এরপর কলকাতায় একে একে যে ক্লাবগুলো গড়ে উঠে সেগুলো হলো- ব্যাঙ্গল ক্লাব (১৮২৯), রয়েল রোয়িং ক্লাব (১৯২৯), ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব (১৯৫৮), ক্যালকাটা পলো ক্লাব (১৮৬২), স্ট্যাটারডে ক্লাব (১৮৭৫), রয়েল ক্যালকাটা টারফ ক্লাব (১৮৮৮), টলিগঞ্জ ক্লাব (১৮৯৫০) ও ক্যালকাটা ক্লাব (১৯০৭)।
এরপর শুধুমাত্র ইংরেজদের ব্যবহারের জন্য ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন শহরে আরও কয়েকটি ক্লাব গড়ে ওঠে। তবে এরমধ্যে ‘চিটাগাং ক্লাব’ নিয়ে একটি ইতিহাস রয়েছে। ওই সময় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ভারতীয় বংশোদ্ভুত কে সি দে ‘চিটাগাং ক্লাব’-এর সদস্য হতে চাইলে ইংরেজরা তা প্রত্যাখ্যান করে। কে সি দে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের প্রশাসনিক কর্নধার হওয়া সত্তে¡ও তাকে ক্লাবের সদস্য পদ না দেওয়ায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। তিনি মনস্ত করলেন ইংরেজ নয়, বাঙালিদের জন্য একটি ক্লাব গঠন করবেন। তার উদ্যোগে সাড়া দিলেন ডাঃ খাস্তগীর, রায় বাহাদুর বি বি চৌধুরী, ব্যারিস্টার জে কে ঘোষাল, ব্যারিস্টার খাস্তগীর ও এ কে চন্দ। শহরের জামালখানে ডাঃ খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন জায়গাটি দান করলেন ডাঃ দাস্তগীর। এখানেই ১৯২৭ সালে গড়ে উঠে ‘চিটাগাং ইন্সস্টিটিউট’ যা বর্তমানে ‘চট্টগ্রাম সিনিয়র্স ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত।
এই চট্টগ্রাম সিনিয়র্স ক্লাবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসেই মোটামুটি ধারণা করা যায় ক্লাবের মাপকাটি ও সেখানে কোন্ ধরণের ব্যক্তিদের যাতায়াত। যদিও বর্তমানে লাইসেন্স নিয়ে নিত্যনতুন অনেক ক্লাব সৃষ্টি হচ্ছে। বিক্রি করছে চড়া দামে সদস্য পদ। টাকা হলেই যে কেউ এসব ক্লাবের সদস্য হতে পারছেন। আর এসব কারণেই কমে আসছে ক্লাবের গুণগত মান। আমরা যদি তাকাই সিলেট স্টেশন ক্লাবের দিকে, দেখা যাবে সেই ইংরেজরাই তার প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তি সময়ে এর দায়িত্ব নেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই। এ ক্লাবের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিচারপতি ড. মো. আবু তারিক, বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত তোফায়েল করিম হায়দার, সিলেটে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনার এল. কৃষ্ণমূর্তি, ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান সাফওয়ান চৌধুরী, মৌলভীবাজার সাতগাঁও টি গার্ডেন-এর ম্যানেজিং পার্টনার আরদাশির কবির।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাণিজ্যেক যেসব ক্লাব গড়ে উঠেছে সেখানে অবাধে সাধারণ মানুষের পদচারণা রয়েছে। তবে ঢাকা ক্লাব বা সিলেট স্টেশন ক্লাবের মতো যেসব ক্লাব আছে সেখানে তাদের সদস্যর বাইরে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ অতিথি ও বিদেশি পাসপোর্টধারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই। এসব ক্লাবের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট। মূলত সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিছুটা অবসর সময় কাটানোর জন্যই ইতিহাসের অনেক স্বাক্ষী হয়ে আছে এসব ক্লাব। ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্লাবগুলো এখনও যে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বহাল রয়েছে তা কিন্তু কম কথা নয়। আজকে এই সিলেট স্টেশন ক্লাব নিয়ে কিছুটা লিখলে সেই ইংরেজদের কথাই বার বার আসছে।
১৮৮৬ সালে তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই এ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কারণ দিনভর কাজ করার পর ইংরেজ কর্মকর্তা, চা কর ও ব্যবসায়ীদের চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। তখন শুধু ইংরেজরাই ছিলেন এর সদস্য। ৩০ বছর পর ১৯১৬ সালে তেলিহাওরের হেমেন্দ্রনাথ দাস ও শেখঘাটের তিন ভাই বানোয়ারীলাল দাস, বীরেন্দ্রলাল দাস এবং বিনোদলাল দাসের কাছ থেকে ক্লাবের জন্য দেড় বিঘা জমি বন্দোবস্ত নেয়া হয়। ১৯৫৩ সালে পারুলবালা দাসের কাছ থেকে আরও এক বিঘা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে মোট আড়াই বিঘা জমিতে শুরু হয় ক্লাবের কার্যক্রম। যদিও এর আগে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এ ক্লাবের সদস্য হতে থাকেন। ইংরেজরা ক্লাবের মালিকানা হস্তান্তর করে চলে যান নিজ দেশে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও পটপরিবর্তন।
পাকিস্তানিদের বিদায়ের পর তা দখলে আসে বাংলাদেশিদের। সদস্য হতে থাকেন সরকারী কর্মকর্তা, শিল্পপতি, চা-কর সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবিসহ সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা। সেই ১৩৩ বছরের পুরনো ক্লাবের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন প্রতিনিধিত্বশীলরা। টাকা হলেই এ ক্লাবের সদস্য হওয়া যাবে-এমনটি ভাবলে ভুল। অনেক রীতি মেনে ও সঠিক যাচাই বাছাই করেই কেবল কাউকে সদস্য পদ দেয়া হয়।
সম্প্রতি এ ক্লাবে গেলে স্বাগত জানান ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম। তিনি সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সরকারী কৌঁসুলীও। ক্লাবের ভেতরের বিভিন্ন কক্ষ দেখলে সত্যিই চমকে ওঠার মতো। ক্লাব ভবণে প্রবেশের সময়ই চোখে পড়ে জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জীবিত ও মৃত অনেক বিশিষ্টজনের ছবি। যাঁরা এ ক্লাবেরই সদস্য। এমন কয়েকজন হলেন সাবেক স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইফতেখার হোসেন শামীম প্রমূখ। এরপর একে একে ঘুরে দেখা হয় হলরুম, ডাইনিং, সুইমিং পুল, টেবিল টেনিস, ক্যারাম, দাবা, ব্যডমিন্টন, ভলিবলসহ নানা খেলাধুলার স্থান।
নিখুঁত কারুকাজ ও সৌন্দর্যে ভরপুর এ ক্লাবে শুধু সদস্যদের চিত্তবিনোদনই নয়, বাইরের সামাজিক অনেক উৎসবও হয়ে থাকে। ক্লাবটিও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে সামাজিক কর্মকান্ডে। বিয়ে, জন্মদিন বা অন্যান্য অনুষ্ঠানও হয় এখানে। সরকারী দিবসেও তারা পালন করে নানা কর্মসূচিত। আলাপকালে প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম জানান, সিলেট স্টেশন ক্লাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪২৫ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪৫ জন। ক্লাবের সদস্যদের ফি ও অন্যান্য খাতে যে আয় হয় তা থেকে সংশ্লিষ্টদের ভেতন-ভাতাদি দেওয়া ছাড়াও দু:স্থ ও সামাজিক কর্মকান্ডে দেয়া হয় নগদ অর্থ।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি জাতীয় দিবস যেমন বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননাও দিচ্ছেন। এ ক্লাবের ব্যবস্থাপক পরাগ কান্তি দেব বলেন, দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়েছেন, অথচ বর্তমানে অসহায় দিনযাপন করছেন এমন কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে মাঝেমধ্যে আর্থিক সহায়তাও করা হয়। যেহেতু এটি কোনো বাণিজ্যিক ক্লাব নয়, সেহেতু সমাজে তার একটি দায়বদ্ধতা থেকে যায়। আর তা থেকে সিলেট স্টেশন ক্লাবও পিছ পা নয়। কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাব। তাহলে আসুন আমরা ইতিহাসের পাতায় থাকা ঐতিহ্যবাহী ক্লাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি এবং ‘ভূঁইফোড়’ ক্লাব পরিহার করে সুন্দর জীবন গড়ি।
আকাশ চৌধুরী: সাংবাদিক ও লেখক