আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিজয়ের মাসে বাঙালির ইতিহাস-ভাবনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১২-০২ ২১:৫৪:৪৬




|| মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ||
বাঙালি জাতির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসের কালপর্ব বিবেচনার ক্ষেত্রে দুইটি বিভ্রান্তিকর অনুঘটক রয়েছে।
এক: পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ নামে ভৌগলিক পরিচয়
দুই: উনিশশো সাতচল্লিশ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রে দুই বাংলার আলাদাভাবে অন্তর্ভুক্তি।

এই দুটি অনুঘটক বাঙালির ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম ও জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের কাল নির্ণয়ে অস্পষ্টতা তৈরি করে। যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ আটকে আছে নয় মাসের ঘেরাটোপে অথবা অপ্রীতিভাজনরা এই সংগ্রামকে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধ হিসেবে দেখাতে পারে। ফলস্বরুপ দেখা যায় যে, মুক্তি সংগ্রামভিত্তিক কোনো নাটক, সিরিজ, সিনেমা এমনকি উপন্যাস ঐ নয় মাসের চৌহদ্দিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। কতগুলো অপারেশন, বন্দুকের ঠুসঠাস, রাজাকারের আস্ফালন, নারীর শরীর নিয়ে টানা হেচড়া, বিজয়োল্লাস প্রভৃতি চিরচেনা ব্যাপার দিয়ে শেষ করা হয় গল্প। আগে ও পরে সম্পর্ক নির্ণয় করে সুদীর্ঘ ইতিহাসের উপস্থাপন সম্ভব হয় না। এটাকে বাঙালির প্রতিভার অক্ষমতা হিসেবে দেখা হয় বা দেখানোর চেষ্টা করা হয়। বাঙালি জাতির প্রতিভা কি আসলেই অক্ষম এটাকে ধারণ করতে? বড় উপন্যাস কি লিখিত হয় নি বাংলায়? হয়েছে তো। সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দুরা লিখেছে বড় বড় উপন্যাস। উহু তারা তো পশ্চিম বাংলার লেখক। এইখানেই সমস্যাটি। জাতির প্রতিভা আছে কিন্তু পূর্ববাংলায় কেউ লেখে নি বড় উপন্যাস। বলা যায়, মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে বড় উপন্যাস লিখতে কেউ সাহস পায় নি। গোটা জনগোষ্ঠীর ভাবনাতে যে ভাবনাটি বিভ্রান্তিকর সেই ভাবনাতে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি একখানা ঢাউস উপন্যাস লিখে ফেললে বিক্রি হবে তো? অথবা লিখে ফেললে উত্থাপিত প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেয়া যাবে কি?

মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে কিন্তু বড় বড় সিরিয়াল বেশ ভালোই চলে। সিন্দাবাদ, টিপু সুলতান, আকবর দ্য গ্রেট ও হালের সুলতান সুলেমান ইত্যাদির নাম করা যায়। এগুলো বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করা। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর দর্শক প্রচুর। সামাজিক কিছু সিরিয়ালও চলছে কোনো কোনো চ্যানেলে। আর ভারতীয় সিরিয়ালে তো পুরো দেশটাই সয়লাব। তার মানে দর্শক আছে। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের উপর নির্মিত হলে ঝুকি থেকে যায়। এটাই রহস্য? একজন সাহিত্যিক একটা বড় উপন্যাস লিখতে যাবার আগে উপরে উল্লিখিত দুইটি অনুঘটকের ব্যাপারে জাতীয়ভাবে স্বচ্ছ ও নিশ্চিত হতে হবে। ফলে শিল্প সৃষ্টির আগে সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে নৃতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি দুটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে আগে এবং জনমানসে সেটি গেঁথে নিতে হবে। আসুন আমরা শুরু করি সেই সাংস্কৃতিক লড়াইটি।

কাগজের ফুল নামে একটি সিনেমা নির্মানের কাজ শুরু করার পর পরিচালক তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সিনেমাটি বাঙালি জাতির লড়াইকে নয় মাসের বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো বলে আমরা জানতে পেরেছি। চৌদ্দই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যার পর নানামুখী ক্ষেত্র প্রস্তুত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো পঁচাত্তরে এসে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা জাল কিন্তু সব সময় কাজ করেছে এই ইতিহাস অধ্যায়নে।

কিছু কাজ হয়েছে অবশ্য। কিন্তু তা একক প্রচেষ্টা। জাতীয় মনন ও চেতনার ভিত্তির উপর দাড়িয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে করা সম্ভব হয় নি। আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রচেষ্টা দেখেছি। খোয়াবনামা উপন্যাসটি এক দীর্ঘ প্রচেষ্টার দলিল। এর বাইরে প্রবন্ধ তথা ইতিহাস আলোচনা হয়েছে প্রচুর। যেমন এই প্রবন্ধেও করা হচ্ছে। সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়ে দাবির বিভক্তিই কি এই বিব্রতবোধ করার কারন? অথবা ধর্মীয় উন্মাদনায় নিজের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক সম্পদের মালিকানা ও উত্তরাধিকারকে বিড়ম্বনামাত্র মনে করার আত্মঘাতী প্রবণতার জাতীয় দৈন্যই এর কারন?

প্রথমে ভৌগলিক পটভূমি খোলাসা করা যাক। আমরা জানি, উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিনে সাগরের অবস্থিতি ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে আবহাওয়া, জলবায়ু তথা প্রকৃতিকে একটা বিশেষত্ব দিয়েছে। এটি এশিয়া মহাদেশের অন্য সকল অঞ্চল থেকে এই এলাকাকে ভিন্নতা দিয়েছে নিশ্চিতভাবে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্য, হিমালয়ের উত্তর দিকের অংশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ভারত মহাসাগর আঁকা-বাঁকা তটরেখা স্পর্শ করে ভারতের উপর বহু রকমের প্রভাব অঞ্চল তৈরি করেছে। সেগুলো হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর সাথে ভৌগলিক মিথস্ক্রিয়াজনিত নানা আবহাওয়া অঞ্চল তৈরি করেছে। মানুষের জীবন যাপনে প্রাকৃতিক প্রভাবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এটাই মানুষের রুচি, আচরণ, সংস্কৃতি ও ভাষা তৈরি করে দেয়।

ভারত মহাসাগরের উপসাগর যেটি বিশ্বের মধ্যে অদ্বিতীয়, সেই বঙ্গোপসাগরের উত্তর তটরেখা সামান্য আঁকা-বাঁকা বাদ দিলে মুটামুটি সোজা পূর্ব হতে পশ্চিমে বাংলাভূমি স্পর্শ করেছে বলা যায়। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। হিমালয় থেকে উৎপন্ন তিন প্রধান নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা প্রবেশ করেছে বাংলায় এবং বাংলার বুক চিরে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

এই যে সাগরের সোজা তটরেখা, এটি নদীগুলোর বিরাট প্রবাহ এবং উত্তরে সুউচ্চ দেয়ালের মত দাড়িয়ে থাকা হিমালয়ের মেঘ পুঞ্জিভূতকরনের বৈশিষ্ট্যের সাথে সমন্বিত হয়েই এখানে তৈরি করেছে খাদ্যাভ্যাস, রুচি, ভাষা তথা সংস্কৃতি। সুন্দরবনের খানিকটা পশ্চিমে, পশ্চিমবাংলার যেখানে শেষ হয়েছে হুগলি নদী আর পূর্বে চট্টগ্রাম যেখানে শেষ হয়েছে মেঘনা নদী-- এই দুই বিন্দু ধরে ঝাড়খন্ডের তথা ছোটনাগপুর মালভূমি ও পার্বত্যাঞ্চল- মিজোরাম-মেঘালয়কে দুইপাশে রেখে হিমালয় পর্যন্ত উত্তরের এই প্রক্ষেপনাংশটুকু, যাকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বলা হয়, মুটামুটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উৎস-চারণভূমি। রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণে বাংলার এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে হুবহু অনুসরণ করা না হলেও বাংলা প্রদেশ তথা বৃটিশ আমলে নির্ধারিত বাংলা অঞ্চল তার কাছাকাছি সীমানা ধারণ করেছে বলেই মনে হয়। পার্বত্য তিন জেলা, সিলেট,কক্সবাজার ও কুচবিহার, চন্ধননগর গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বৈশিষ্ট্যের বাইরে অবস্থান করছে।

এই সীমানা তথা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি উত্তরে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ প্রসঙ্গে নেপালের রাজদরবারে বাংলাভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কার ব্যাপারটি স্মরণ করা যেতে পারে। নেপালি ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে। সেক্ষেত্রে হিমালয়ের পাদদেশের সাথে সমুদ্রের সমন্বয়ে বিশিষ্টতা কাজ করেছে সন্দেহ নাই। ভুটানের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। তাহলে দাড়ালো এই যে, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ যেহেতু প্রাকৃতিক ব্যাপার সেহেতু বৈষয়িক ও ভাবগত সম্পদের জাতীয় অধিকারটিও প্রাকৃতিক ব্যাপার। অর্থাৎ বাংলা হিসেবে পরিচিত ভূখন্ডের প্রত্যেকটি মানুষ এই সম্পদের উত্তরাধিকারী। ধর্মীয় ও রাষ্ট্রনৈতিক বিভাজনে যতোই আমার তোমার হিসেবে দেখানো হোক না কেনো তাতে উত্তরাধিকারের বৈধতা খন্ডিত হতে পারে না।

পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ শুধুই দিকনির্দেশক শব্দ। এজন্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের হেরফের হবার যুক্তি নেই। সম্পদের ব্যাপারেও একই কথা। কেননা সেগুলো জাতীয় সংস্কৃতি থেকেই প্রাপ্ত। তাহলে ভাগ হলো কেনো? ইতিহাসে ক্ষমতার পালা বদলে, রাজার পতনে ও পরিবর্তনে শুধু বাংলা নয়, বহু সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীকে ভৌগলিকভাবে বিভাজিত করা হয়েছে নানা সময়ে। বাংলাও সেভাবে চলেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ামকগুলোর প্রভাবে বিকাশের ধরণটা একই থেকে গেছে। পূর্ববঙ্গ তুলনামূলক বেশি জল-কাদা-বর্ষা-বাদল প্রবণ এলাকা বলে এটা কিছুটা দুর্গম বলে উপেক্ষিত ছিলো। ফলে আলাদাভাবে নামকরণ হয় পূর্ববঙ্গ। এটি দিকনির্দেশক অভিধামাত্র। পরবর্তিতে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই নামে বাংলাকে ভাগ করা হয়েছিলো। লর্ড কার্জনের আমলে উনিশশো পাঁচ সালে। কিন্তু সেটি সমাজের অগ্রসর অংশ ভালোভাবে নেয় নি। শুরু হয়ে যায় তীব্র আন্দোলন। ক্ষুদিরাম তার আলোচিত চরিত্র। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে বাংলা আবার একত্রিত হয়। একত্রিত হলো বটে। কিন্তু ভেঙ্গে যাবার দাগটি রয়েই গেলো। সেই দাগ বরাবর জোরে চাপ লাগাতে উনিশশো সাতচল্লিশ সালে আবার ভেঙ্গে যায়। এবার আর এক রাষ্ট্রের অধীনে নয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রে আলাদা হয়ে গেলো। আর এখান থেকেই শুরু হলো ভয়াবহ বিপত্তিটা। পূর্ববঙ্গে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নিয়ে মুসলিম নেতারা(জনগন নয়) পূর্ববঙ্গকে গেঁথে দিলো পাকিস্তানের সাথে। 

এবার আসি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠার প্রসঙ্গে। কারন এই টার্মটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। জাতীয় উত্তরাধিকার ও নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস স্বীকার ও দাবি করা-না করার দ্বন্দ্বটি এখান থেকেই উৎপত্তি নিয়েছে। উত্তরে হিমালয়--পূর্বে পাহাড়-পর্বতের সারি--পশ্চিমে মালভূমি--দক্ষিণে সাগর। গাঙেয় ব-দ্বীপ তাই গাঙেয় উপত্যকা নামেও পরিচিত। আক্ষরিক অর্থেই এই সমতল ভূমিটুকু সুউচ্চ মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি আবদ্ধ জনপদ।

এখানে চট্টগ্রাম দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে আসা আরব বেনিয়া ও পীর-আউলিয়াদের আগমনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। পশ্চিম দিক দিয়েও পীর-আউলিয়াদের আগমন ঘটেছে নিয়ম করে। পশ্চিম দিক দিয়ে আসা ধর্মপ্রচারকগণ সুদীর্ঘ ভারতভূমি পার হয়ে বাঙলায় পৌছুনোর আগেই কোথাও না কোথাও থিতু হয়ে যেতো। আর চট্টগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করা ইসলামপ্রচারকগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার কাজটি করে চলতো।তাছাড়া এই দুর্গম অঞ্চলে কোনো সমৃদ্ধিশালী মানুষ এসে বসতি গড়ে নি। আর এই কোল-অস্ট্রিক-দ্রাবিড় প্রভৃতি যাযাবর মানুষের বংশধররাও দেহে ও মনে চিরকাল দরিদ্রই থেকে গেছে। ব্রাত্যজনেরাই ইসলাম গ্রহণ করেছে--এমন একটা মত তো চালু আছেই। ফলে এহেন অভাবী মানুষের তুমুল জীবন-সংগ্রাম ও যন্ত্রনার কাছে জাত্যাভিমান বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। নগদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা প্রবল, সাথে পরকালে চিরশান্তির গ্যারান্টি এখানকার মানুষের কাছে ম্যাজিকের মত কাজ করেছে, অনুমান করা অসম্ভব নয়।
 
আর এই সংখ্যাগরিষ্ঠের হুজুগ তুলে উনিশশো সাতচল্লিশ সালে মালভূমি পর্বত ও সাগরে ঘেরা আবহমান গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ দেশটিকে ভাগ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হলো। পাঁচ হাজার বছরের অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী কুৎসিত সময়ের যুগ-যন্ত্রনার তীব্র হুলাহলে ক্লিষ্ট হয়ে বেহুস প্রাণে ছটফট করতে করতে দুই রাষ্ট্রে ভাগাভাগি হয়ে সম্ভবত চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।

বৃটিশ ভারতের রাজধানী এবং সুদীর্ঘকালের বানিজ্যিক কেন্দ্র হবার সুবাদে কলকাতার কাছাকাছি সকল কর্মব্যস্ততা জড়ো হয়েছিলো। এই প্রেক্ষিতে সাহিত্য-সংস্কৃতিরও প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা। ইতিহাসের খাঁড়া--দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রোপান্ডায় বাংলা ভাগ হবার সময় ঐতিহাসিকভাবে জড়োকৃত সম্পদ-সম্পত্তি সমেত কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হয়ে ভারত রাষ্ট্রে অন্তর্লীন হয়ে যায়। সমগ্র বাংলার সামষ্টিক অধিকারের সুষম বিভাজন হয় নি। সেদিকে নজর দেবার সময় ও সুযোগ কোনোটাই ছিলো না অবশ্য।

বাংলা ভূখন্ডের ভৌগলিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র অনুসন্ধান শেষে একটি গুরুতর প্রশ্নের সামনে আমাদের দাড়াতেই হবে। তাহলো, এই জনপদের ইতিহাস--ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হয়ে কারা এখন বিশ্ব দরবারে প্রতিনিধিত্ব করবে? এই গুরু দায়িত্ব কে বা কারা পালন করবে? অন্যভাবে বলা যায়, কাদের পালন করা উচিৎ? উত্তরটি নিশ্চয়ই অনুমান করে ফেলেছেন। হ্যা, স্বাধীন বাংলা তথা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনতাই এই দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু এই ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত দায়-দায়িত্বটি পালন করার জন্য পর্যাপ্ত সাবালকত্ব অর্জন করেছে কি বাংলাদেশের জনতা-জাতি?

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা বটে কিন্তু জাতি হিসেবে স্বাধীন নয়। ক্রমেই তারা বিরাট ভারতবর্ষে আত্মবিলোপের নিয়তির কোপে পড়ছে। আর বাংলাদেশ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতিতে গিয়ে রাষ্ট্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে বিশ্ব দরবারে বাঙালির একটি রাষ্ট্র আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। ভূগোল যতো খন্ডিতই হোক, সমগ্র জাতির সার-সংকলন ধারণ ও প্রকাশ-প্রচারের যোগ্যতা-অধিকার-ক্ষমতা বাংলাদেশের আছে--এ কথা মানতেই হবে।

তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খন্ডিত হবে কেন? কিংবা নয় মাসের ঘেরাটোপে আটকে থাকবে কেন? মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বটে। তাই বলে সাহিত্য-শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে জাতিগত লড়াই-সংগ্রামের প্রসঙ্গে শুধু মুক্তিযুদ্ধে আবদ্ধ থাকতে হবে কেন? পাকিস্তান হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে? এখানেই প্রশ্নটি আবারো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত আলোচনায় ব্যাপারটি খোলাসা হয়েছে আশা করি। তবুও এই প্রসঙ্গে ভিন্ন বয়ান লেখার প্রত্যাশা রেখে সংক্ষেপে বলা যায় যে, পাকিস্তান বাঙালি জাতির জীবনে একটি দুর্ঘটনামাত্র। এই দুর্ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা ছিলো।

কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় নি। ধর্ম বারবার দৃশ্যপটে হাজির হয়ে ঠান্ডা মাথাকে গরম করে দিয়ে হিসাব-কিতাব গোলমাল করে ফেলেছে। শিরক বিদআত হিন্দুয়ানী বিজাতি ইত্যাদি নানা শ্লোগানে বাঙালিকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা সেই ওহাবিজম থেকে শুরু হয়ে আজবধি অব্যাহত আছে। এর পাল্টা হিসেবে জাতিগত পরিচয়কে মূখ্য ধরে শুরু হওয়া সংগ্রামকে কাংখিত গতিতে জারি রাখা যায় নি। ফলে জেঁকে বসেছে বিভ্রান্তি। তাই ভ্রান্তির বেড়াজালে জাতিগত চেতনা বিরাট ক্যানভাসে আবহমান লড়াই-সংগ্রামকে ধারন করার সাহস করেছে কম। এই কারনেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিসংগ্রামের উপর শিল্প ও সাহিত্য এত দুর্বল। আমরা কি তবে হুমায়ন আজাদের বক্তব্যটি উচ্চারণ করবো, ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে মূর্খরাও কিন্তু তাকে শিল্পোত্তীর্ণ করতে দরকার হয় প্রতিভা?

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২ ডিসেম্বর ২০১৯/পিডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন