আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

করবিনকে আটকাতে মিথ ও মিডিয়ার ব্রেইন ওয়াশই সফল হলো

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১২-১৭ ২১:২০:০২

কাইয়ূম আবদুল্লাহ :: বহুল আলোচিত ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচন অনেক আলোচনার জন্ম দিয়ে গেলো। এই নির্বাচনে বরিস জনসন নেতৃত্বাধীন টোরির আশাতীত বিজয় এবং জেরেমি করবিন নেতৃত্বাধীন লেবারের ভরাডুবি নিয়ে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ চলছে এবং তা আরো বহুদিন চলবে। এও বিচিত্র নয় যে, ব্রেক্সিট প্রশ্নে অনুষ্ঠিত  রেফারেন্ডামে ক্যামব্রিজ এনালিটিকার বিতর্কিত ভূমিকার মতো হয়তো কোনো কেলেংকারীও বেরিয়ে যেতো পারে। বাংলাদেশের মতো ব্যালট বক্স ছিনতাই, জাল ভোট প্রদান কিংবা দরজা বন্ধ করে সিল মারার বেআইনি ও গর্হিত কর্মকান্ডের নজির নাই বটে। তাই বলে সুক্ষ্ন ডিজিটাল কারশাজি যে হয় না বা হতে পারে না তা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিশ্বকে সবক-শাস্তি কিংবা শান্তি দেয়ার প্রধান প্রবক্তা, স্বীকৃত মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার নির্বাচনেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ড্রাম্পের বিজয়ের পেছনে ঘনিষ্ট মিত্র রাশিয়ার ডিজিটাল কারসাজি বহুল আলোচিত। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ২০১৬ সালের রেফারেন্ডামে লিভপন্থীদের পক্ষে ভোটারদের প্রভাবিত করার দায়ে ক্যামব্রিজ এনালিটিকার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে খোদ বৃটেনে। এবারের নির্বাচনেও টোরির ভূমিধ্বস বিজয়ে মিথের ছড়াছড়ি এবং সাধারণ পাবলিকের ব্রেইন ওয়াশে মিডিয়ার ভূমিকা যে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের শক্তিশালী যুদ্ধাবাজ, অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং তাদের বেশীরভাগ দোসর মিডিয়া মুঘলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কপোকাত হওয়া ছাড়া উপায় ছিলো কি ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক, কঠোর যুদ্ধ বিরোধী ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সোচ্চার অবস্থানকারী লেবার নেতা করবিনের? তবে হারলেও করবিন চিরতরে ব্রিটিশ রাজনীতিকেই বদলে দিতে সমর্থ হয়েছেন বলে দাবী করছেন তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী, সতীর্থরা।


ভোটের ঠিক আগের ও পরের দিনের কয়েকজন ভোটারের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যাবে ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের মন কীভাবে কাজ করেছে। কীভাবে মিথ ও মিডিয়ার ব্রেইন ওয়াশে প্রভাবিত হয়েছিলেন তারা।

বুধবার দিবাগত রাত। আর রাত পোহালেই নির্বাচন। একটু আগেভাগেই বাড়ি ফিরতে চান জুলি ও মার্ক। তাই মন চাইলেও আর ফেনিল গ্লাসে বাড়তি চুমুক দিলেন না। তবু যতুটুকু গলদকরণ করেছেন তাতেই নেশায় ঢলঢল তাদের চোখ। বাড়ি ফেরার পথে ঠুটে ঠুট রেখে দীর্ঘ চুমু শেষে মুখ সরাতেই মার্কের প্রতি জুলির প্রশ্ন- উই আর ভোটিং টুডে? ইয়েস, বাট আই কান্ট স্টে অন করবিন, সোজাসাপ্টা জবাব মার্কের। বিস্মিত জুলির পাল্টা প্রশ্ন: ওয়াই? আর ইউ ব্রেইন ওয়াশড? এই কাপলের কথোপকথন থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, জরেমি করবিন তথা লেবারকে ভোট দেয়ার বিষয়ে একটি বোঝাপড়া ছিলো তাদের মধ্যে। কিন্তু কোনো কারণ বশতঃ আগের দিন মত পাল্টে ফেলেছেন তাদের একজন।

ভোটের পরের দিন দেখা হয়েছিলো একজন শিক্ষার্থীর সাথে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন (ইউসিএল) এর ওই শিক্ষার্থীর নাম ডানা। মূল নিবাস আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়। হোয়াট ডু ইউ থিংক এবাউট লাস্ট নাইট ইলেশন রিজাল্ট? সাথে সাথে তার সংক্ষিপ্ত উত্তর ইস্টস টেরিবল! ওই শিক্ষার্থী আরো বললেন, আই ডন্ট আন্ডার্স্টেন, হাও কাম আমেরিকান এন্ড বৃটিশ পিপলস আর সেইম! এতে বোঝা গেলো ডোনাল্ট ড্রাম্পের মতো নানাভাবে বিতর্কিত রাজনীতিক বরিস জনসনকে কীভাবে ব্রিটিশ জনগণ প্রাধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলো? সেজন্য সে রীতিমতো বিস্মিত।

.সন্ধ্যায় কথা হয় এক ব্রিটিশ শিখ মহিলার সাথে। তার কাছে জানতে চাইলাম নির্বাচন সম্পর্কে। তিনি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন। ওই মহিলার ক্ষোভ লেবারের উপর। কারণ এই লেবারের কারণেই ইরাক যুদ্ধে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তার এখানকার এক বন্ধু তার পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে। এজন্য তিনি আর কখনো লেবারকে ভোট দেবেন না বলে অনেকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন। তিনি আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমি শিখ হলেও সব ধর্মের মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা সমান। তুমি মুসলমান হয়ে কীভাবে ইরাক বিনষ্টকারী এই লেবারকে সমর্থন করছো? তাছাড়া এন্টি-সেমিটিজমের বিষয়টিও তিনি তুলে বললনে, এই লেবার এন্টি-সেমিটিক। আমি যুদ্ধের জন্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যে দায়ী এবং করবিন সবসময় যুদ্ধ বিরোধী সেটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। সবশেষে লেবার নেতার সম্পর্কে এফ ওয়ার্ড যুক্ত করে তিনি মন্তব্য করে বসলেন, এই বুড়ো করিবনকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তবে ব্রেক্সিট সম্পর্কে লেবারের অবস্থান নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, জনগণের রায়ে বিষয়টি যখন একবার ফায়সালা হয়ে গেছে সেই বিষয়টি পাল্টাতে আনডেমোডেক্রিক অবস্থান লেবার নেয় কীভাবে?

উপরোল্লেখিত তিনটি খন্ড ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, করবিন তথা লেবারের ভরাডুবির পেছনে মিথ ও মিডিয়ার শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘদিন যেসব চরম ও ভিত্তিহীন মিথ চালু রয়েছে তম্মধ্যে করবিন এন্টিসেমিটিক, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অনুপোযুক্ত, এমনকি বৃটেনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ব্রিটিশ ডানপন্থী মিডিয়া এসব বিষয় পাবলিককে গলদকরণ করিয়ে যাচ্ছিলো প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ নির্বাচনের আগের দিন ঐক্যজোট হয়ে একতরফাভাবে টোরি ও বরিস জনসনকে উলঙ্গভাবে সমর্থন ও পক্ষ নিয়ে কাভার স্টোরিগুলো করেছে তারা। তাতে একটি জাতির বৃহৎ অংশ ব্রেইন ওয়াশড হতে বাধ্য। করবিন প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ফিট নন কিংবা তিনি বৃটেনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেন- চরম এসব মিথগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও তা লোকমুখে অহরহ চালু ছিলো। আর তা তুলে দিয়েছিলো করপোরেট ও ধনকুবেরদের মালিকানাধিন সংখ্যাগরিষ্ট মিডিয়া। অথচ দলের কিছু সদস্য কোনো কোনো এন্টিসেমিটিক মন্তব্য করলেও করবিন ছিলেন তা থেকে মুক্ত। তিনি শুধু যুদ্ধবাজ ইসরাইলের বিরোধী, নির্যাতিত ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন আবাসের পক্ষে ছিলেন এবং এসবে তার কোনো রাখঢাক ছিলো না। জীবনের সিংহভাগ সময় তার কেটে গেছে একটি মানবিক বিশ্ব নির্মাণের আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে। আর তাই শুধু বৃটেন নয়, পুরো পৃথিবীর বিবেকবান মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিলো তার প্রতি। তাদের গভীর দৃষ্টি নিবন্ধিত ছিলো বৃটেনের দিকে। শেষ পর্যন্ত ওইসব মিথ ও মিডিয়ার ভূমিকাই সফল হল।

লেখকঃ সাপ্তাহিক সুরমার বার্তা সম্পাদক, প্রবাসী স‌াংবা‌দিক

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন