আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী: আলোকিত জীবন ও কর্ম

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-০৫ ১৯:৫৫:৩৯

প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী আর নেই। আজ রবিবার তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজেউজন)। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ হাদিস বিশারদ। তাঁর মৃত্যুতে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীর মৃত্যুতে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি আলোকপাতমূলক নিচের লেখাটি কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো। লেখাটি হবিগঞ্জের উমেদনগরস্থ জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া-এর ১০সালা দস্তারবন্দী স্মারক থেকে সংগৃহীত।

লেখাটি লিখেছিলেন মাওলানা আবদুল্লাহ মাসুম। তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীর জীবদ্দশায় এটি লিখা হয়। এখন তাঁর পরলোকগমনের কারণে লেখায় প্রয়োজনীয় দু-একটি সম্পাদনা করা হয়েছে।


অবতরণিকা:
আল্লামা তাফাজ্জুল হক-একটি নাম। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি চিন্তা। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির আলিমদের একজন। বৃহত্তর সিলেট বিভাগের আলিমকূল শিরোমণি। এক বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী। দাওয়াত-তাবলিগ, ওয়াজ-নসিহত, সমাজ সংস্কার, শিক্ষকতা, রচনা ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে ছিল তাঁর সরব পদচারণা। তাঁর এই সমৃদ্ধ জীবনের উপর ‘থিসিস পেপারস’ তৈরি হওয়া উচিত। আর নচেৎ তার জীবনী-লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। তদুপরি “মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লাহু” (পুরোপুরি না পারলেও পুরোটাই না ছাড়া, অল্প হলেও করা) নীতির ভিত্তিতে এখানে হযরতের জীবনী সম্বন্ধে সংক্ষেপে আরজ করা হল।

এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, হযরতের জীবনীর উপর বক্ষ্যমাণ লেখাটি প্রস্তুত হওয়ার পর হযরত লেখাটি আদ্যোপান্ত পড়েছেন। কিছু কিছু স্থানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীও দিয়েছেন।

শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক দা.বা.
নাম : শাইখ আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী দা.বা । তবে তিনি নিজ এলাকায় ‘মুহাদ্দিস সাহেব হুযুর’ নামে ছোট-বড় সকলের নিকট পরিচিত। মাঝারি গড়নের। জ্যোতির্ময় চেহারার অধিকারী। যেন নূরের আভা টিকরে পড়ছে। খুব সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়।
পিতা : মাওলানা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.(মৃত: ১৯৯৮ইং)
জন্ম : ১৩৫৯হি. মোতাবেক ১৯৩৮ই.।

জন্মস্থান: হবিগঞ্জ শহরের অদূরে ‘কাটাখালী’ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.ছিলেন বিজ্ঞ আলিম ও সমাজ সংস্কারক। শাইখ তাফাজ্জুল হক দা.বা.এর নানা হলেন আল্লামা আসাদুল্লাহ রহ.। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির একজন মুজাহিদ ছিলেন। হবিগঞ্জ এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবক ও সমাজ সংস্কারকও ছিলেন।

পরিবার:
শাইখ তাফাজ্জুল হক দা.বা. তাঁর পাঁচ ভাইদের মাঝে বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইও নিজ নিজ ময়দানে সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

পড়াশোনা:
অন্যদের মত তাঁরও পড়াশোনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছেই। পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ. ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলিম ও সফল শিক্ষক। এরপর তিনি হবিগঞ্জের অদূরে রায়ধর গ্রামের ঐতিহাসিক মাদরাসা ‘জামিয়া সা’দিয়্যায়’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মামা আল্লামা মুখলিসুর রহমান রহ.(মৃত ১৪২২হি.) এর নিকট আরবী ব্যাকরণ ও আরবিভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.এর ছাত্র। এ এলাকার এক সময়ের সফল চেয়ারম্যানও ছিলেন। এ কারণে তিনি নিজ এলাকায় ‘চেয়ারম্যান সাহেব’ নামেও পরিচিত। তাঁর নানার মত তাঁর মামাও বড় মুজাহিদ ছিলেন। বাতিলের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সমাজ সংস্কারে তাঁরও অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।

পড়ালেখার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম গমন:
প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়া আহলিয়্যা মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা’ চট্টগ্রামে গমন করেন। সেখানে তিনি ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, তাফসীর, উসূলে তাফসীর, হাদীস ও উসূলে হাদীস, মানতেক-ফালসাফাসহ ইসলামের বিভিন্ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে তিনি মুফতী আযম মুফতী ফায়যুল্লাহ রহ. এর বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। ছাত্র হিসাবে তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। উস্তাযদের প্রিয় পাত্র ছিলেন। ছাত্র যামানায় সর্বদা পড়াশোনাকে প্রাধান্য দিতেন। সময় নষ্ট করা থেকে সযত্নে থাকতেন। ক্লাসের বাইরে লাইব্রেরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন। অবশেষে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৬০-৬১ইং সনে ‘দাওরায়ে হাদীস’ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।

উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান গমন:
জ্ঞান আহরণের সুতীব্র আকাঙ্খায় কিশোর তাফাজ্জুল ছুটে এসেছেন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবশেষ পাড়ি জমিয়েছেন তৎকালীন সূদুর পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ঐতিহাসিক ইসলামী বিদ্যাপিঠ ‘জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর’-এ আরো গভীরভাবে হাদীস অধ্যয়নের জন্য দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীস ক্লাসে ভর্তি হন। সময়টা ছিল-৬১-৬২ ঈসায়ী।

লাহোরে থাকাকালীন তিনি ‘খানকায়ে রায়পুরের’ (সাহারানপুর) প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর ওলী শাইখ আব্দুল ক্বাদের রায়পুরী রহ. (মৃত. ১৩৮২হি.) এর ইসলাহী মজলিসে উপস্থিত হতেন। তাঁর খানকায় এক সপ্তাহ অবস্থানও করেছেন। তাঁর জানাযায়ও উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি খানপুরে গমন করেন। সেখানে উপমহাদেশের বিখ্যাত তাফসীরবিদ ও হাদীস বিশারদ হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (মৃত.১৪১৫হি.) রহ.এর নিকট তাফসীরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন।

এরপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া করাচী’ মাদরাসায় বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইউসূফ বিনূরী রহ. (মৃত.১৩৯৭হি.) এর নিকট গমন করেন। তাঁর কাছে তিনি তিনটি বিষয় ও কিতাবের বিশেষ দরস গ্রহণ করেন। যথা-ক.বিষয়: হাদীস শাস্ত্র। কিতাব: সহীহুল বুখারী। খ. বিষয়: শরীয়তের বিধানের বিভিন্ন রহস্য ও ভেদ। কিতাব: হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা। গ.বিষয়: তাফসীরুল কুরআনিল কারীম। এভাবে তিনি পূর্বোক্ত আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. ও আল্লামা বিনূরী রহ.এর কাছে দরস গ্রহণের মাধ্যমে তাফসীর শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। এখানে তিনি কয়েক মাসের মতো ছিলেন।

ভারত গমন: এরপর তিনি ভারতের বিখ্যাত মাদরাসা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ গমন করেন। দেওবন্দ গমনের পথে অনাকাঙ্খিত ভাবে তিনি তাবলীগ জামাতের বড় মুরুব্বী ও দাঈ আল্লামা ইউসূফ ইবনে ইলইয়াস কান্ধলভী রহ. এর সঙ্গ লাভে ধন্য হন। এক সফরেই তাঁর সাথে হযরতের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

হযরতের আবেদনে আল্লামা ইউসূফ কান্ধলভী রহ. হযরতকে সাহারানাপুরে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.এর সোহবতে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি শাইখুল হাদীস ছাহেবের সোহবতে দশদিনের মত ছিলেন। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি শাইখের সহীহুল বুখারীর দরসেও উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
এরপর আল্লামা ইউসূফ কান্ধলভী রহ.-ই হযরতকে দারুল উলূম দেওবন্দে নিয়ে যান। দেওবন্দে তিনি ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহ.এর মেহমান হয়ে ধন্য হন। এখানে তিনি ঐতিহাসিক ‘মাদানী মনযিলে’ মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন।

আল্লাহর কুদরতের কী কারিশমা! মাত্র একটি সফরে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীর সান্নিধ্য পেয়ে গেলেন। সবই তাক্বদিরের ফায়সালা। আল্লাহ পাক যাকে বড় করতে চান তাকে এভাবেই পর্দার আড়াল থেকে গড়ে তুলেন তিলে তিলে। একসময় তা ফুল হয়ে সুবাস ছড়ায় পৃথিবীর বুকে।
দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানী কোন ছাত্র ভর্তি হওয়ার নিয়ম ছিল না। এদিকে ভর্তির সময়ও শেষ। এই দুই কারণে তিনি ভর্তি না হয়ে তৎকালীন মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ.এর অনুমতিতে ‘খুসূসী দরস’ (বিশেষ পাঠ) গ্রহণ করেন। জামে তিরমিযী পড়েন শাইখ ইবরাহীম বলিয়াভী রহ.এর নিকট। তাফসীরে বায়যাবী পড়েন আল্লামা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী রহ.এর নিকট। তখন ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ.এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার-দরসেও উপস্থিত হয়েছেন। এভাবে ‘খুসূসী দরস’ শেষ করে বার্ষিক পরীক্ষার আগেই ১৯৬৩ সনে দেশে ফিরে আসেন।

তাঁর উস্তাদবৃন্দ:
আমরা দেখেছি, তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের বড় বড় আলিমদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। নিম্নে হযরতের উস্তাদবৃন্দের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করা হল।
হবিগঞ্জ-
তার পিতা মাওলানা শাইখ আব্দুন নূর হবিগঞ্জী রহ.।
মামা মাওলানা মুখলিসুর রহমান হবিগঞ্জী রহ.।
মামা মাওলানা আব্দুল লতিফ ছাহেব হবিগঞ্জী রহ.।
ক্বারী মাওলানা মেছবাহুজ্জামান কদুপুরী রহ.।
মাওলানা আব্দুল কদ্দুস ছাহেব
মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব (শায়েস্তাগঞ্জী)।
মুফতী আব্দুল গফুর দরিয়াপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৯৯৮ ঈ.)। তাঁকে হবিগঞ্জের মুফতীয়ে আযম বলা হত।
আল্লামা শরফুদ্দীন রহ. (শাইখে বেড়াখালী)।

চট্টগ্রাম, হাটহাজারী-
আল্লামা আব্দুল ওয়াহাব রহ. (মৃত.১৪০২হি.)
আল্লামা নযীর আহমদ রহ.
আল্লামা আব্দুল কাইয়্যূম রহ. (মৃত.১৪০১হি)
আল্লামা আব্দুল আযীয রহ. (মৃত.১৪২০হি.)
আল্লামা আবুল হাসান রহ.
আল্লামা মুহাম্মাদ আলী রহ.।
আল্লামা মুফতী আহমাদুল হক রহ. (মৃত. ১৪৩১হি.)
মুফতী আযম মাওলানা ফায়যুল্লাহ রহ. (মৃত.১৩৯৬হি.)
মাওলানা হামিদ ছাহেব রহ.।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী হাফিযাহুল্লাহ।

পাকিস্তান-
হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. (মৃত.১৪১৫হি.)
আল্লামা ইউসূফ বিনূরী রহ. (মৃত,১৩৯৭.)
আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রহ. (মৃত.১৩৯৪হি.)
আল্লামা রসূল খান ছাহেব রহ. (মৃত.১৩৯১হি.)

ভারত-
শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. (মৃত.১৪০২হি.)
আল্লামা ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রহ. (মৃত.১৪০৩হি.)
আল্লামা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী রহ. (মৃত.১৩৯২হি.)
আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী রহ. (মৃত.১৩৮৭হি.)

উপরোক্ত উলামায়ে কেরামের অনেকের আলোচনা হযরতের ‘মনীষীদের স্মৃতিচারণ’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।

কর্মজীবন:
এ বিষয়ে তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিচারণমূলক পুস্তিকা ‘মণীষীদের স্মৃতিচারণে’-এ আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে হুবহু এখানে পেশ করা হল-

‘কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসা: পাকিস্তান ও ভারতে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে প্রথমে কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করি। ৬৪-৬৬ ঈ. মোট তিন বছর এ মাদরাসায় হাদীস, তাফসীর ও ফুনূনাতের বিভিন্ন কিতাবের দরস দানের সুযোগ হয়।

আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসা: এরপর ৬৬ ঈ. সনের শেষে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদীস মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতহার আলী ছাহেবের মাদরাসায় চলে যান। তখন বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন মাওলানা দৌলত আলী ছাহেব। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহ্হাব ছাহেবের নিকট পত্র লিখলেন, বালিয়া মাদরাসার জন্য একজন শাইখুল হাদীস দেয়ার জন্য। শাহ ছাহেব তখন আমাকে চিঠি লিখে বালিয়া মাদরাসায় যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বড়দের নির্দেশ অনুযায়ী ৬৯ ঈ. সন পর্যন্ত মোট তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় ছিলাম। আগেও তিন, এখানেও তিন।

জামিয়া ইসলামিয়া ময়মনসিংহ: ১৯৬৯-৭১ ঈ. ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহ জামেয়া ইসলামিয়ায় দরসে হাদীসের খেদমতের সুযোগ হয়েছে। এখানেও তিন। এভাবে ‘তিনে তিনের’ এক আশ্চর্য ছন্দ তৈরি হয়ে গেল।

জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর, হবিগঞ্জ: ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসি। এলাকাবাসী ও মুরুব্বীদের অনুরোধে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করি।’

বৈবাহিক জীবন: ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম মাওলানা আরিফ রব্বানী রহ.(১৯৯৭ইং) এর কন্যাকে ১৯৬৭ ইং সনে বিবাহ করেন। হযরতের ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বিভিন্ন খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

বাইতুল্লাহর যিয়ারত: আল্লাহর রহমতে হযরতের বহুবার হজ্জ ও উমরা করার সুযোগ হয়েছে। সর্বপ্রথম ৭৫ সালের শেষ দিকে বাইতুল্লাহর যিয়ারতের জন্য রওয়ানা হন। হজ্ব হয়েছিল ৭৬ এর শুরুতে।

গুণাবলী: হয়রত হবিগঞ্জী হুযুর আল্লাহ প্রদত্ত বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এখানে সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হল-

১. প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তি
হযরত বাল্যকাল থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী। তাই সহজেই উস্তাযগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতেন। ছোটবেলায় হযরতের কুরআনুল কারীম হিফয করার সুযোগ হয়নি।
হাটহাজারী মাদরাসায় যখন তিনি সহীহ বুখারী পড়েন। তখন তাঁর শাইখ ও মুরশিদ মুফতী আযম মাওলানা ফায়যুল্লাহ রহ. হযরতকে কুরআনুল কারীম হিফয করার প্রতি উৎসাহিত করেন। কিন্তু পড়াশোনার ব্যস্ততায় তখন তা হয়ে উঠেনি।

এরপর যখন লাহোরে জামিয়া আশরাফিয়ায় গমন করেন, তখন কুরআন হিফযের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এ মর্মে তিনি তাঁর হজ্বযাত্রী শাইখ রসূল খান ছাহেবকে লিখিতভাবে দুআর আবেদন করেন। শাইখ রসূল খান ছাহেব হযরতের জন্য কুরআন হিফযের দোআ করেন। এর বরকতেই তিনি নিজে নিজে মাত্র ছয় মাসে দাওরায়ে হাদীসের পড়াশোনার ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও পুরো কুরআনের হিফয সম্পন্ন করেন।

এছাড়া হযরতের উক্ত গুণের অন্যতম সাক্ষী প্রকাশিতব্য ‘মনীষীদের স্মৃতিচারণ’। তাতে তিনি তাঁর উস্তায ও সমসাময়িক মাশায়েখদের স্মৃতিচারণ করেছেন।

২. উদার মানসিকতা ও নিরহংকার
আমি কাছ থেকে দেখেছি, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড় সকলের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেন। কাউকে নিরাশ করেন না। মানুষ যেকোন সমস্যা বা পরামর্শের জন্য আসলে উদার মনে তার সাথে কথা বলেন। সময় দেন। জ্ঞান ও গুণে এত বড় হওয়া সত্ত্বেও কোন ধরনের অহমিকা বা অহংকারমূলক আচরণ থেকে মুক্ত। আমি তাঁর কাছে যতবার গিয়েছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি, আমি তাঁকে একজন প্রকৃত উদার মনে মানুষ হিসাবেই পেয়েছি।

আমাকে হযরতের এই গুণটি বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে। হযরতের এলাকার জনৈক লোক এক যামানায় হযরতকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত যখন তাঁর প্রকাশিতব্য স্মৃতিচারণে ঐ লোকের আলোচনা করেছেন তখন তাঁর কেবল ভাল দিকগুলো তুলে ধরেছেন। ঐ আলোচনা থেকে কোনভাবেই এটি বুঝার উপায় নেই যে, এক যামানায় তিনি ঐ আলিম থেকে কষ্ট পেয়েছিলেন। এমন উদার মননশীলতার এখন বড় অভাব।

৩. নিয়মানুবর্তিতা
প্রতিদিনের কাজ যথাসময়ে যথানিয়মে করা এটি হযরতের জীবনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। লক্ষ্য করেছি, হযরতের সাধারণ আদত হল, ফজরের নামায জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগরে পড়া বা ফজরের পরই মাদরাসায় চলে আসা। (মাদরাসা থেকে হযরতের বাসায় হেঁটে আসলে প্রায় দশ মিনিটের দূরত্বে) সেই শীতের সময়ও দেখেছি, হযরত ভোর বেলা মাদরাসায় হাযির হয়ে গেছেন।

‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ কিতাবের দরস যখন তিনি আমাকে প্রদান করতেন, তখন বলতেন, ফজরের পর মাদরাসায় চলে এসো। সেখানে হুজ্জাতুল্লাহ দরস হবে ইন শা আল্লাহ। হযরত যথাসময়ে কনকনে শীত-সকালে মাদরাসায় হাযির হয়ে যেতেন। কিন্তু আমি জোয়ান হয়েও মাদরাসায় যেতে পারতাম না। একটু রোদ হলে রওয়ানা হতাম। মাদরাসা বন্ধ হলেও হযরতের উক্ত নিয়মানুবর্তিতায় কোন ব্যতয় ঘটতে দেখিনি। জীবনে বড় ও সফল হওয়ার জন্য নিয়ম ও সময়ানুবর্তিতা একটি প্রধান শর্ত। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও তালিবুল ইলম ভাইদেরকে এ গুণটি দান করুন।

৪. ওয়াজ-নসীহত
আল্লাহ তা’আলা হযরতকে যেমন মেধা ও জ্ঞান দিয়েছেন, তেমনি সেই জ্ঞান বিতরণের জন্য চিত্তাকর্ষক বয়ানের যোগ্যতাও দান করেছেন।
হযরতের বয়ান ও ওয়াজ শুনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ চলে আসে। হযরতের কুরআন তেলাওয়াত এত সুন্দর ও মুগ্ধকর, যা খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী নয়; সরাসরি কুরআন-হাদীসের আলোকে ওয়াজ করেন। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো এতটা দরদমাখা ভাষা ও যুক্তিসহ পেশ করতেন যে, মানুষ সহজেই অভিভূত হয়ে যেতেন।

হযরতের ওয়াজের মৌলিক কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
ক. তাঁর ওয়াজকে সাধারণ মানুষের জন্য ‘দরসুল হাদীস’ (হাদীসের পাঠ) ও ‘দরসুল কুরআন’(কুরআনের পাঠ) হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ, তাঁর পুরো ওয়াজেই হতো কুরআনের তাফসীর থাকে, না হয় হাদীসের শরাহ বা ব্যাখ্যা থাকে।
খ. তাঁর প্রায় ওয়াজের মধ্যেই একটি মৌলিক বিষয় হল, সমাজে প্রচলিত বেদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মযবুত যুক্তি ও দলীলের আলোকে আলোচনা করা।
গ.বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী না বলে সরাসরি আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরতেন। এক রমযানে হযরতের মসজিদ ‘নুরুল হেরা জামে মসজিদ’-এ পুরো মাসব্যাপী সূরা ইউসূফের মুগ্ধকর তাফসীর করেছেন। মানুষ অন্যান্য মসজিদে তারাবীহের নামায শেষ করে নুরুল হেরা মসজিদে চলে আসত তাফসীর শুনার জন্য। আমি নিজেও কয়েক দিন উপস্থিত ছিলাম। হযরত এত সুন্দর করে তাফসীর করতেন যে, শ্রোতারা মন্ত্রের মত মুগ্ধ হয়ে শুনত। সূরা ইউসূফকে যে কুরআনে কারীমে ‘আহসানুল কাসাস’ বলা হয়েছে তা তখন ভালভাবে উপলব্ধি হয়েছে।

তাফসীরের ফাঁকে-ফাঁকে হযরত আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও সুন্দর করে তুলে ধরতেন। আল্লাহ তাআলা হযরতকে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীসের বিশেষ যোগ্যতা দান করেন।

আধ্যাত্মিক সাধনা ও খেলাফত লাভ: হযরত হবিগঞ্জী সাহেব জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মনীষীদের সান্নিধ্য থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হন। সর্বপ্রথম তিনি মুফতী আযম শাইখ ফায়যুল্লাহ রহ. এর নিকট বায়আত হন। এরপর হযরতের ইন্তেকালের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকার প্রখ্যাত বুযুুর্গ, খলিফায়ে মাদানী আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা (মৃত.১৯৮৫হি.) রহ. এর নিকট বায়আত হন। তিনি শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। দীর্ঘদিন রিযায়ত-মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় শাইখ রেঙ্গা রহ. ইজাযত ও খেলাফত দান করেন।

অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের পর হযরতের সময় কাটতো ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে দিয়ে। বিশেষত রমযান মাসে হযরতের রাত জাগা ও ইবাদত বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। রমযান মাসে দীর্ঘদিন যাবত তাহাজ্জুদের সময় নিজে কয়েক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করেন। শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ. এর মতানুসারে তাহাজ্জুদের জামাত করেন। আর প্রতি রমযানে শেষ দশকের ইতিকাফ নিয়মিত করতেন। এলাকার দ্বীনদার মানুষ ও দূর দূরান্ত থেকে আলিম-উলামারা ছুটে আসেন তাঁর সাথে রমযানের ই’তিকাফ করার জন্য। কোন কোন বছর পুরো রমযান মাসই ইতিকাফে কাটাতেন।

রাজনৈতিক জীবন: তিনি শুরু থেকেই ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের তিনি ছিলেন ‘নায়বে রঈস’। আর ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত। হবিগঞ্জ ও দেশে ইসলাম বিরোধী কিছু হলে তিনি জমিয়তের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করতেন। মিছিল, মিটিং করতেন। রাজপথে জনগণের সাথে নেমে একাত্মতা ঘোষণা করতেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৫ জানুয়ারি ২০২০/আরআই-কে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন