আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, কাজে ও জীবনে অসাম্প্রদায়িকতা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-১৭ ১৮:০৯:৩২

বিশপ বিজয় এন ডি ক্রজ :: বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও কাজ আমরা যদি লক্ষ্য করে থাকি তাহলে তার মধ্যে আমরা দেখতে পাই: তার জীবনে জনগনই ছিল আন্ত:প্রাণ। মানুষের দুঃখ-কষ্টে তার মন কাঁদতো।  বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন এবং সোনার বাংলা গড়বেন এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন যাপন করবে, দারিদ্রের নির্মম কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর অন্তরে।  যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ, আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবী আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালী জাতিকে দিয়েছেন কাঙ্খিত স্বাধীনতা।  বাঙালী জাতিকে বিশ্বের দরবারে তিনি অন্যন্য মর্যাদায় তুলে ধরেছেন।  বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন তিনি সফল করেছেন। এই জাতি অত্যন্ত দুর্ভাগা যে, জাতির পিতা, স্বপ্ন দ্রষ্টা, আপোহহীন সংগ্রামী নেতা, মুক্তির জন্য বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, বাংলাদেশের স্থপতি, ঘাতকের নির্মম বুলেটে মৃত্যুবরণ ১৯৭৫ খ্রী: করতে হয়েছে।

আমার সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগতভাবে দেখা হয় নি কিন্তু ১৯৭২ তাকে সামনাসামনি দেখেছিলাম।  ছোটবেলায় তার জীবন সম্পকে যথেষ্ট জানতাম না।  নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে তার জীবন ও কাজ সম্পর্কে কিছু জানতে শুরু করেছি তখনই এক সকালে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।  তাঁর অস্প্রদায়িকতার কথা বলার পূর্বে তাঁর সম্পর্কে দু’চার কথা বলতে চাচ্ছি: এই ব্যক্তিটা কত বড় মানুষ ছিলেন, তাঁর হৃদয়টা ছিল কত বড়, দেশ প্রেম ছিল কত গভীর, তাঁর ব্যপকতা, আত্মত্যাগ, মায়া-মমতা, বিচক্ষণতা, মানুষের সাথে সম্পর্ক, ধৈর্য্য কত বেশী ছিল তা কল্পনা করা যায় না।

প্রথমেই আমি তাঁর মধ্যে দেখতে পাই অনেক পূর্ণ একজন নেতা, সত্যিকার একজন নেতা, (ধঁঃযবহঃরপ) যত বড় বড় ঝুঁকি ও বিপদ এসেছে, তিনি একেবারে নির্ভয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।  সেজন্য প্রতিনিয়ত তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, নিজস্ব সবকিছু ত্যাগ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।  পাকিস্থান হওয়ার পরে যখন মাওলানা ভাসানী নেতৃত্বে মুসলীসলীগ ত্যাগ করে আওমীমুসলিমলীগ গঠন করা হলো তখন বঙ্গবন্ধু  বুঝতে পেরেছিলেন তাকে ধরে কারাগারে প্রেরণ করা হবে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী বলেছিলেন, লাহোরে নয় ঢাকা গিয়ে তাকে বন্দি হতে হবে।  এই যে পালিয়ে পালিয়ে তাকে ঢাকা আসতে হয়েছিল এবং পালিয়ে পালিয়ে তাকে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল এটা তিনি একেবারে পছন্দ করেন নি বরং কারাগারে মৌলানা ভাষানী ও অন্যান্যদের সাথে আবদ্ধ থাকাকেই তিনি শ্রেয় মনে করেছিলেন।

তিনি যে ছাত্রলীগ গঠন করেছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সংগঠনের সদস্য/সদস্যাদের তিনি কর্মী হিসাবেই শুধু দেখেন নি।  সবার সাথে তার একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের কাজের অনেক স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন করেছেন।  পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস করা হয়েছিল মোগলটুলী। মুসলিম লীগ কর্মীরা এটা ভেঙ্গে ফেলতে অনেক চেষ্ট করেছিল। তিনি বলেছেন শওকত মিঞার জন্য তা পারে নি, তিনি প্রথম অফিস করার জন্য টেবিল চেয়ারও জোগাড় করেছিলেন।  এমনিভাবে কে কখন তাকে খাবার দিয়েছিল, বিপদের সময়ে তাঁর পাশে থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিল, তাকে প্রয়োজনে টাকা, শীতের সময় কাপড় দিয়েছিল এই মানুষগুলোকে কখনও তিনি ভুলেন নি, তাদের তিনি উচ্ছ¡সিত প্রসংশা করেছেন। এমনিভাবে ভাল নেতা অনেক নেতা নেত্রীর সৃষ্টি করেন।

নেতা হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনদরদী।  পার্টির কাজ চালানোর জন্য, বিভিন্ন সময়ে কোন ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করার জন্য কত ধনী ও উদার ব্যক্তি কাছে তিনি হাত পেতেছেন যাতে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।  তিনি চাঁদাবাজী করেন নি, দান তুলে এই বিপদগ্রস্থ মানুষদের সাহয্য করেছেন।   যেখানে সমস্যা সেখানো তিনি ছুটে গিয়েছেন।  এক সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হলো যে, কৃষকেরা ধান কেটে এক মহকুমা থেকে আর এক মহকুমাতে নিতে পারবে না।  এতে এই শ্রমিক শ্রেণী অত্যন্ত বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল কারন এই ধান দিয়েই তাদের সংসার চলতো।  তাদের এই অধিকার আদায়ের জন্য তিনি নিজে জড়িত হয়েছেন এবং এর সমাধান খুঁজেছেন। 

অস্প্রদায়িক মুজিব: প্রকৃত নেতা একদিনে হওয়া যায় না।  বঙ্গবন্ধু ছাত্র জীবন থেকে সংগঠনে কাজ করা শুরু করেছেন।  একবার গোপালঞ্জের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এসে মুজিবের আব্বাকে বললেন আপনার ছেলে যা শুরু করেছে তাতে খুব শীঘ্রই জেলে যেতে হবে।  তার আব্বা উত্তর দিয়েছিলেন: “দেশের জন্য কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না।  যদি জেল খাটতে হয় খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না।”  যৌবনে তিনি মহাত্মা গান্ধি, হোসেন শহীদ সারওয়ার্দীর, শেরে বাংলা ফজলুক হক, কাজী নজরুল আরও অনেক মহৎ ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তাদের জীবন, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন।  হয়তো তাঁর অজান্তেই মনের মধ্যে আকাঙ্খা জেগেছিল যে, নেতা হলে তাদের মতো নেতা হতে হবে।  তিনি দেখেছেন গান্ধীর ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, দেশ প্রেম কত গভীর।  তাঁর উপস্থিতি ও বক্তব্য যেন মন্ত্রের মতো কাজ করেছে।   যেখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছে কি করে তাঁর উপস্থিতিতে মূহুর্তের মধ্যে সব শান্ত হয়ে: সবাই মিলে একত্রে শ্লোগান দিয়েছিল হিন্দু মুসলিম ভাই, ভাই। হোসেন শহীদ সারওয়ার্দীকে তিনি যেন একেবারে গুরু হিসাবে মানতেন।  তিনিও মুজিবকে অনেক ভালবাসতেন।  মুজিবের হাতে টাকা আছে কিনা, খাবার এমনকি তার জন্য তিনি জামা কাপড়ও কিনে দিতেন।  মুজিবও তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, শহীদ সাহেব বাংলা ও বাংলার মানুষকে কত ভালবাসেন তা তাঁর সান্নিধ্যে না আসলে কেউ বুঝতে পারবে না।  মুজিব শহীদ সাহেরেব আচার-আচরণ, তাঁর অত্মত্যাগ, দেশপ্রেমের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। পাশাপাশি কিছু স্বার্থপর, লোভী ভন্ড নেতাদের আচার আচরণ দেখে দুঃখ পেয়েছেন, অবাক হয়েছেন তাদের স্বর্থপরতা দেখে।

তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার ধারাটা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই: যখন মুসলীম লীগ থেকে আওমী মুসলিম লীগ, এবং পরে আওমীলীগ গঠিত হয়।  ৩০ শে মে, ১৯৭৩ তিনি বলেছিলেন: “একজন মানুষ হিসাবে আমি সমগ্র বিশ্বকে নিয়েই আমি ভাবি।  একজন বাঙ্গালী হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালীদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।  এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলে।” আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে সবধরনের কাজ ও সেবার প্রধান উৎস হলো ভালবাসা।  ভালবাসাই মানুষের জীবনে পূর্ণতা এনে দেয়।  ভালবাসাই আমাদের অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন করে।  খ্রীষ্টনদের ঈশ্বরের অন্য নাম হলো: ভালবাসা।  যে ভালাবাসে না সে ঈশ্বরকে জানে না ও চেনে না। মাদার তেরেজা বলেছিলেন: “ছোট ছোট কাজ কিন্তু প্রতিটি ছোট কাজে অনেক বড় ভালবাসা দিতে হবে তখন আমাদের কাজ হয়ে উঠে অনেক বড় ও মহৎ।”

বঙ্গবন্ধু আবার বলেছিলেন: “বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই।  মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান বাংলাদেশে যারা বাসবাস করেন, তারা সবাই এদেশের নাগরিক।  সকল ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভোগ করবে।” এধররেন চিন্তা-ভাবনা কথা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি তিনি কত অস্প্রদায়িক ছিলেন।  বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র তিনি দান করে বিশ্বে অস্প্রদায়িকতার এক অন্যন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।

খ্রীষ্টমন্ডলী বা চার্চ্চ সব সময় অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠি নিয়ে এই চার্চ্চ গড়ে উঠে বিশ্বাসের ভিত্তিতে এখানে সবার সমান অধিকার।   বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে যখন মিশনারী স্কুলে পড়াশুনা করেছেন একটু হলেও অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন। সেখানে ছিল বিদেশী মিশনারীগন, এদেশে এসে কিভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে মায়া মমতা দিয়ে, মূল্যবোধ-সম্পন্ন সুশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আগামী বছর আমরা স্বাধীনতা সুবর্ন জয়ন্তী পালন করবো। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ট অর্জন হলো আমাদের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ। আমাদের মতো ছোট খ্রীষ্টান সম্প্রদায় থেকে থেকে প্রায় ২,০০০ যুবক এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন।  আমাদের খ্রীষ্টান মিশন, প্রতিষ্ঠান ও মিশনারীগণ পরোক্ষ কিন্তু শক্তিশালীভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।  উল্লেখ্য, ফা: মারিও ভ্যারানেসি শিমুলিয়া মিশন, জিকরগাছা, যশোহর, প্রধান পুরোহিত ছিলেন।  এই যুদ্ধের সময় তিনি তার গাড়ী নিয়ে চলে আসেন ফাতেমা হাসপাতালে, যশোহরে যেখানে অসংখ্য আহত মুক্তিযুদ্ধাদের তিনি সেবা দান করে সুস্থ করেছেন এবং অনেক মানুষদের তিনি রাস্তা থেকে নিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন।  এটা জানাজানি হলে পাকসেনারা এসে মিশনের ভিতরে আরও ছয় জনকে গুলিবিদ্ধ করে এবং সবাই সাথে সাখে মৃত্যুবরণ করেন।  আরও একজন, ইতালিয়ান মিশনারী ফাদার মারিও রিগন, গোপালগঞ্জে বানিয়ারচরে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধদের সেবা করেছিলেন।  তিনি বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, পওে এই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন। আমেরিকান ফাদার ইভান্স এবং দিনাজপুরের ফাদার  লুকাস মারান্ডিও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকসেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন।  এমনিভাবে আমাদের অনেক খ্রীষ্টান মিশন হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের দুর্গ।  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ঈশ্বর সেবক ঢাকার আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলী তার স্বর্ণের চেইন ও একটি চেক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর হাতে যাতে তিনি দেশ সেবা করতে পারেন।  আমাদের নটরডেম ইউনিভার্সিটি সহ ১০০ টি বেশী কলেজ ও হইস্কুল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কারিতাস এ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কাজ করে যাচ্ছে।  এই প্রতিষ্ঠানগুলো শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপন করে যাচ্ছে।

আমরা, খ্রীষ্টানরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে লালন করি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।  আমরা খুবই প্রত্যাশা করি এই দেশ হবে অনেক উন্নত একটা দেশ, যেখানে থাকবে না শাষন,শোষন, অত্যাচার ও নির্যাতন।  এদেশে মানুষ ন্যায় বিচার পাবে এবং পূর্ণ স্বাধিনতা ভোগ করবে।  এদেশে থাকবে না প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার।  এদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধশালী ও সম্প্রীতির এক বাংলঅদেশ।  জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।

বিশপ বিজয় এন ডি ক্রজ, ওএমআই
সিলেট ধর্মপ্রদেশ (বিভাগীয় কাথলিক চার্চ্চ প্রধান)।
 

সহায়ক পুস্তক: বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী
বি.বি.সি ও ভয়েজ অব আমেরিকার সংবাদ ও সাক্ষাৎকার।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন