আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

জাগো হে অমৃতজ্যোতি, জাগো হে মা দুর্গা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২১ ১৪:৪৭:৫২

সজল ঘোষ :: চলছে শুভ্র শরৎ। সাদা মেঘের ভেলা রয়েছে আকাশ জুড়ে। মন মাতানো কাশবন আর শিউলি ফুলের মুগ্ধ সমারোহ চারিদিকে। এমনই চমৎকার ও মধুময় লগ্নে এসেছেন মহামায়া মা শ্রীদুর্গা। সবার মনে চলছে আনন্দানুভূতি। এই শরৎ শুভক্ষণে বছর ঘুরেই মা শ্রীদুর্গা আসেন সবার ঘরে। এবারও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। মহামায়ার আগমনে চারিদিকে তাই লেগেছে বর্ণাঢ্য আনন্দ উৎসবের ঢল। সকল স্থানেই হৃদয়ের উচ্ছল মুখরতা প্রকাশিত হচ্ছে। নজরকাঁড়া বর্ণিল আবহে চলছে পুজোর আয়োজন। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন অনাবিল ভালোবাসার সম্মিলনে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল শারদীয় শ্রীদুর্গা পুজা । ৫ দিন ব্যাপি দুর্গোৎসবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দশভ‚জার শ্রীরাঙা রাতুল চরণে তাঁদের মনবাসনা পুরণের আকুল প্রার্থনা জানান। শরৎ আকাশে এখন সাদা মেঘের ভেলা। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে মন ভোলানো কাশফুল শিউলি ফুলের অপুর্ব মাখামাখি। দিকে দিকে চলছে এখন মাতৃদেবী বন্দনা। বছর ঘুরে উমা দেবী এলেন তার বাপের বাড়ি। ঢাকের কাঠির ঢেম কুড় কুড়, ঘন্টা- কাসার টিং টিং, মঙ্গল, শাঁখ ও   উলুধ্বনিতে মায়ের আগমনে চারদিকে কেবল আনন্দ আয়োজনের উল্লাস বইছে। দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এই আনন্দ আয়োজনে অংশ নেন বলে দুর্গা পূজার নামকরন হয় সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গোৎসব। ধনী- গরীবের ভেদাভেদ ভুলে মন্ডপে মন্ডপে তাই চলে আনন্দময়ীর আগমনী সংগীত ।

শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু উৎসব নয়, মহা-উৎসব। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিকতার অনুভ‚তি, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য, বাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক প্রীতির বন্ধন, হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমন্বয় সাধন করে। বিশ্বজননীর পূজায় বাঙালি হিন্দুর হৃদয়কে প্রসারিত করে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে। সকল দেশের মানুষকে আপন করে নিতে উৎসবকে বিশ্বজনীন উৎসবেও পরিণত করেছে।

দুর্গা পূজার ইতিহাস বেশ পুরনো। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টির আদিতে গোলকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ দ্বৈত্যদ্বয়ের নিধনে তিনি শরণাপন্ন হন দেবীর। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালে সংকটাপন্ন মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গা পূজা করেছিলেন। এরপর দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন। এটা চতুর্থ দুর্গোৎসব। দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও ইন্দ্রের ন্যায় ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মান্ডব্য, হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সুরথ রাজা ও বৈরাগ্য লাভের জন্য সামাধি বৈশ্য, কার্তাবির্জাজুন বধের জন্য বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।
কৃত্তিবাসের রামায়নে পাওয়া যায়, রাক্ষস রাজা রাবন বিনাশে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তখন ছিল শরৎকাল। বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের এ অকাল বোধনের
বিস্তা—িত বর্ননা পাওয়া যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা শঙ্কিত হলেন। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জানালেন , দুর্গাপূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ব্রহ্মা স্বয়ং যজমানী করলেন রামের পক্ষে। তখন শরৎকাল, দক্ষিনায়ন। দেবতাদের নিদ্রার সময়। ব্রহ্মার স্তব স্তুতিতে জাগ্রত হলেন দেবী মহামায়া। তিনি উগ্রচন্ডি রুপে আবিভর্‚ হলে ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চন্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুন্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুন্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।’’ রামচন্দ্রের অকাল বোধনই পরে বঙ্গদেশে প্রচার পায়, বর্তমানে যা শারদীয় দুর্গোৎসবের রুপ নিয়েছে। মহাভারতে বর্নিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে দ্বারকা নগরীতে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পান্ডব পক্ষের অর্জুন ও পুদুন্ম দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন।

দুর্গা ও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত কাহিনীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও লোকমান্য হল দেবীমাহাত্ম্যম-এ বর্ণিত কাহিনীটি। দেবীমাহাত্ম্যম পকৃতপক্ষে ‘মার্কন্ডেয় পুরাণ’-এর একটি নির্বাচিত অংশ। সাতশত শ্লোকাবিশিষ্ট এই দেবীমাহাত্ম্যম-ই শ্রীশ্রী চন্ডি গ্রন্থ। চন্ডি পাঠ দুর্গোৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও বটে। দেবীমাহাত্ম্যম-এর কাহিনী অনুসারে পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশ বছর ব্যাপি এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। শান্তিপুরী স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে তাদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করে। ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সুউচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। তিনিই শ্রীদুর্গা। অপরদিকে দৈত্য, বিষ্ম, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। আবার মার্কন্ডেয় পুরাণমতে দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় দেবীর নাম হয় দুর্গা। বাঙ্গালিরা একে দশভ‚জারূপে পূজা করে থাকেন। দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধের মাধ্যমে দেবতাদের স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়ে শান্তির পরশ ছড়িয়ে দেন। তাই তাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আবার দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী, দুশভূজা, মঙ্গলময়ী, শক্তিদায়িনী, পরমাপ্রকৃতি, আদ্যশক্তি ও স্নেহময়ী মা। চন্ডীতে দেবীর স্তবে বলা হয়েছে ‘স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণি নমোস্তুতে’। অর্থাৎ, ভোগের স্থান স্বর্গ লাভ করার জন্য এবং মুক্তিলাভের জন্য হে দেবী নারায়ণি, আমি তোমাকে প্রণাম জানাই। শ্রীভগবানকে মাতৃভাবে আরাধনার কথা মার্কন্ডেয় পুরাণে রয়েছে। গীতাতেও ভগবান বলেছেন- আমি জগতের মাতা। (গীতা-৯/১৭)। বাঙালি সমাজ মায়ের ভালবাসায় মুগ্ধ। ঈশ্বর সকল জীবের মা হয়ে বিরাজ করেন।

দেবী পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসুক্ত। এই দেবীসুক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। শক্তি পূজার দু’টি দিক আছে একটি হলো আধ্যাত্মিক এবং অপরটি হল আধিভৌতিক। মাতৃসাধক আধ্যাত্মক্ষেত্রে মহামায়া আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন এবং অন্তরে কাম ক্রোধাদি রিপু ও ইন্দ্রিয়দিগকে জয় করে আধ্যাত্মিক কল্পনা ও মুক্তি লাভ করেন। অন্যদিকে আধিভৌতিক ক্ষেত্রে সাধক তাঁর পূজা বন্দনা করেন দেশ ও সমাজের বাহ্য শত্রুর কবল হতে দেশ জতিকে মুক্ত করতে।

মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশ দিক রক্ষা করার প্রতীক, দশ প্রহরন এক দেবতার সাধনালব্ধ বিভূতি। দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকা শক্তির প্রতীক অর্থাৎ সত্ত¡,রজঃ তমঃ গুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী-একটি নয়ন চন্দ্র স্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বপুরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে ল²ী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শুভ্র শক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্য শক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক। শক্তিসমূহ অনুভ‚তির বিষয়, অনুভ‚তির আকার নেই। আকার দেয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য। সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা । তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র সুশোভিত। তার ডান হাতে ত্রিশূল, খড়গ ও চক্র; বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘন্টা। দুর্গা দেহ-দুর্গের মহাশক্তি। সাধক সাধনাকালে সেই শক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূ করার জন্য উদ্যোগী হয়। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। সেই অনন্ত জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীকী রুপ  শ্রীশ্রী চন্ডির মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে। পূজার বর্ণনা : আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথানুসারে দুর্গোৎসব কখনো পনেরো, দশ বা পাঁচ দিনের। দুর্গা পূজার শুরু হয় মহালয়ায়। এ দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোরবেলা পিতৃতর্পনের মাধ্যমে দেবীপক্ষকে আহবান জানান ভক্তরা। শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার হরণ করে শুভ, মঙ্গল, আনন্দদায়ক ও আলোর দিশারী অসুরবিনাশিনী মাকে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেন তারা। সমবেত কণ্ঠের স্তব ‘হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো। তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে ধন্য করো । কলুষতা মুক্ত করো। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরুপে, শক্তিরূপে আশির্বাদ করো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে।’ এরপর মহাষষ্ঠীতে বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষ বা বিল্বশাখায়।

মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা। কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে একটি বধূ আকৃতিবিশিষ্ট করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। এই হল ’ নবপত্রিকা’, প্রচলিত ভাষায় যাকে ‘কলাবউ’ বলে।

মহাষ্টমীতে মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমীব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা,অধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা ও বলিদান। কুমারী পূজা নিয়ে একটু বলা যাক। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে, দেবী চন্ডিকা এক কুমারী কন্যারূপেই দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। দেবী ভগবতী কুমারীরূপেই আখ্যায়িত। কুমারী পূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় । তাকে সাজানো হয় ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলঙ্কারে। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে ফুলের বাজুবন্ধ, কুমারী মেয়েটি যেন সত্যিই দেবীর প্রতিরূপ। মন্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার।

তবে সব পূজা মন্ডপে কুমারী পূজার চল নেই। বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতে শুধু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পূজামন্ডপগুলোতে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহানবমীতে কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা। বিজয়া দশমীতে বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা।
বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন কে কবে করেছিলেন, সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চন্ডী অংশটি পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে।

একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পন্ডিত ভবদেব ভট্ট দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান দিয়ে গেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ও বাঙালি পন্ডিত শূলপাণি ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ বই দুইটি থেকে দুর্গা পূজার কথা জানা যায়। অর্থাৎ, চতুর্দশ শতাব্দীতেই বাংলায় দুর্গাপূজা ছিল রীতিমতো ‘উৎসব’। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের ‘দুর্গাপূজা তত্ত¡’ গ্রন্থখানি। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পন্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমান সংগ্রহ করে পূজা পদ্ধতি লিখেছেন তিনি।

বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভ‚ম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরীম রাজবংশের কুলদেবী। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজা পদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী সপরিবারা বটে, কিন্তু ল²ী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে থাকে। অর্থাৎ ল²ীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে ল²ী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্লট প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও জগৎমল্লট  প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্লট রাজবাড়ির পূজায় দেবী পটের যে ব্যবহার স্বতন্ত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রাণ শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।

কোন কোন ইতিহাসবেত্তা রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের কথা উল্লেখ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ন ¯্রফে খ্যাতি লাভের নিমিত্তে আট লাখ ব্যয়ে ঘটা করে দুর্গা পূজা করেন। নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, বড়শিয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী, কোচবিহার রাজবাড়ি সর্বত্রই মহাসমারোহে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। তাই বলা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতেই দুর্গোৎসবের সূচনা।

ঢাকার দুর্গোৎসবের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৮৩০ সালে সূত্রাপুরে নন্দলাল বাবুর মৈশুন্ডির বাড়িতে ঘটা করে আয়োজন করা হয় দুর্গা পূজার। দোতলা বাড়ির সমান উঁচু ছিল সে প্রতিমা। বিশ শতকের শুরুতে দুর্গা পূজা ছিল পারিবারিক। জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা সে কালে পূজার আয়োজন করতেন। ত্রিশের দশকে শুরু হয় বারোয়ারি পূজা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা সম্মিলিতভাবে পূজা করতেন। প্রথমদিকে কেবল বাবুগিরি ও ইংরেজদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্যই পালিত হতো এ উৎসব। বাবুদের সামাজিক মর্যাদা লাভের উপায়ও ছিল এ উৎসব! পূজায় ইংরেজদের আপ্যায়নের জন্য থাকত ব্র্যান্ডি, শেরি, শ্যাম্পেন। থাকত আমোদ-প্রমোদের সুব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাইজি নাচ, কবিগান, চরস ও তামাকের ধোঁয়াও।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দুর্গা পূজা হয়ে যায় সর্বসাধারণের উৎসব, তখন পূজা পালনে আসে ভিন্নতা। দেশভাগের পর বাংলাদেশে এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয় । তবে এখনও পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে বাংলাদেশের অনেক এলাকায়। পাকিস্তানি শাসনামলেও পূজার আনন্দে ভাটা পড়েনি । কিছু ঐতিহ্য সবসময়ই অমলিন। পূজা উপলক্ষে এখনও মেলা বসে। নাগরদোলা, গজা-মুরালি-সন্দেশের দোকান, আলো ঝলমলে পূজার মন্ডপগুলো, মাইকে গান এসব এখনও চোখে পড়ে। সারাদিন জুড়ে ঢাকিদের সমাগম, ভক্তদের ভিড়, পুরোহিতদের হাতে ভক্তের প্রসাদ গ্রহণ, সন্ধ্যায় আরতি ও নৃত্য, সব মিলিয়ে উৎসবের ছোঁয়ার কমতি নেই কোথাও। দিন পাল্টেছে, উৎসবে হয়তো নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কিন্তু উৎসবের এই চিরাচরিত রূপ বদলায়নি এতটুকুও।

পূজোর সাজ পোশাকেও সেকেলে ভাবটা থেকে গেছে। পূজা মানেই পাড়ার দিদি-বৌদিদের এক প্যাঁচে পরা গারদের শাড়ি। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, আলতা রাঙা পায়ে নূপূর পড়ে পূজা মন্ডপে আসেন তারা। ধূতি- সাদা পাঞ্জাবি উঠে যায়নি, বরং পরনের ধরনে এসেছে নানা বৈচিত্র্য। পূজার নৈবদ্যেও পুরোনো ধারা বজায় রেখেছে ভক্তরা। মৌসুমী ফলের ভোগের পাশাপাশি খিঁচুড়ি প্রসাদ, মিষ্টান্ন, তারপর রয়েছে মন্ডা- মিঠাই, মুড়ি- মুড়কি।
পূজা মানেই বাড়ি জুড়ে আনন্দের ধুম। পূজার পাঁচদিন বাড়িতে রান্না হবে বাহারি পদের সব আইটেম। প্রথা অনুযায়ী ষষ্ঠী থেকে নবমী এ চারদিন চলবে নিরামিষ।  

বিজয়া দশমী। পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গ শিখর কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যান। পেছনে ফেলে যাবেন ভক্তদের শ্রদ্ধা আর বেদনাশ্রæ। সকালেই দেবীর দশমীবিহিত পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জনের পর্ব শেষ হবে। প্রতিমা বিসর্জনের আগে স্ত্রীরা দেবী দুর্গাকে বেদনাবিধূর বিদায়লগ্নে তেল, সিঁদুর ও পান দিয়ে মিষ্টিমুখ করাবেন। এরপর শোভাযাত্রা সহকারে দেবী প্রতিমা বিসর্জনে চলবে ভক্তরা। শোভাযাত্রা শেষে মন্দিরে ফিরে শান্তি জল ও আশির্বাদ গ্রহণ করে ঘরে ফিরবেন ভক্তরা। দুর্গাপূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ, পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও সুন্দরের যুদ্ধ। দুর্গতি থেকে রক্ষা, বিভেদ, বিবাদ, অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্রস্বার্থবোধ ও সংকীর্ণতা প্রভৃতির ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মহাশক্তির বর লাভের নিমিত্তে সনাতন ধর্মাবলম্বরী মেতে উঠবেন দেবী বন্দনায়। আত্মশক্তির উত্থান, প্রাণশক্তির জাগরণ, ষড়রিপুর গ্রাস থেকে মুক্তির জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার কৃপালাভের জন্য দুর্গাদেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে বিশ্ব চরাচর।

দেবীর চরণে ভক্তদের কাতর মিনতি- এবারের দুর্গোৎসব যেন সামাজিক বন্ধনকে শান্তিময় ও সুদৃঢ় করে। সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত নিবিড় ভালোবাসার মায়াময় স্পন্দনে  গৌরাবান্বিত করে  সবার মন-প্রাণকে। সবার প্রত্যাশা-বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার শারদীয় শ্রীশ্রী দুর্গা পূজায় ১ দিনের সরকারি ছুটির বদলে ৩ দিন সরকারি ছুটি যেন দেয়া হয় । প্রতিটি পুজা মন্ডপে যেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়া হয়। আশা-প্রত্যাশা করবো শারদ উৎসব সকল বাঙালির প্রাণে আনন্দ শিহরণ  চিরকাল বহমান রাখবে । মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃত মানুষ। দেশ ও জাতি হবে সমৃদ্ধ ও উন্নত।


লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন