আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অগ্রসৈনিক ছিলেন আবু হেনা চৌধুরী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২৪ ১৮:৫৩:১৭

এডভোকেট কুমার চন্দ্র রায় :: ২৪ অক্টোবর’২০ এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালাল পুঁজি বিরোধী আপোষহীন নেতা, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (ঘউঋ) সিলেট জেলা শাখার সাবেক সভাপতি, সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবু হেনা চৌধুরীর ১৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৪২ সালের ১১ নভেম্বর আবু হেনা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর শ্বাসনালী ও খাদ্যনালীর সংক্রমনজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই আবু হেনা চৌধুরী বাম ধারার প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন এবং ছাত্র ইউনিয়ন সিলেট জেলা শাখার কর্মী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সূত্রপাত ঘটে। তিনি মার্কসবাদের কালজয়ী আদর্শকে তাঁর জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেন। গত শতকের ৬০ এর দশকে স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে সেন্টো-সিয়াটো জোটে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে সেন্টো-সিয়াটো জোট বিরোধী আন্দোলন, মসজিদ আল-আকসাতে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী অসংখ্য আন্দোলনে আবু হেনা চৌধুরী অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদান করেন। এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। সে সময় হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন তাদের প্রণীত শিক্ষানীতি সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করলে এমসি কলেজের ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আবু হেনা চৌধুরী উক্ত শিক্ষা কমিশনের বিভিন্ন গণবিরোধী দিক তুলে ধরেন এবং গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবিতে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেন। সেজন্য তৎকালীন এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সুলেমান চৌধুরী আবু হেনা চৌধুরীকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। অন্যায় বহিষ্কাদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে মহামান্য হাইকোর্ট আবু হেনা চৌধুরীর পক্ষে রায় প্রদান করেন।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মহামতি কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভচক্র ক্ষমতায় এসে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাত্তি¡কভাবে যে বিতর্কের সৃষ্টি করে সে বিতর্কের ঢেউ এদেশেও এসে লাগে। মতাদর্শিক প্রশ্নে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও পার্টি প্রভাবাধীন ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গণসংগঠন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই আদর্শগত সংগ্রামে আবু হেনা চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবী ধারার সাথে একাত্ম থাকেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (‘মেনন গ্রæপ’) সিলেট জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী ’৬৯ এর গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় আবু হেনা চৌধুরী একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। কিন্ত সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম না হওয়ায় শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এদেশের মানুষের দু:খ কষ্টের মূল কারণ সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির নগ্ন শোষণ, সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থা এবং তাদের এজেন্ট আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজির নির্মম শোষণ শাসন। সেজন্য এদেশের মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এজেন্ট আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করা। আবু হেনা চৌধুরী আজীবন এ সংগ্রামের পথিকৃৎ ছিলেন। পূর্বের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় আশির দশকে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (ঘউঋ) গঠিত হলে ১৯৮৮ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখা গঠিত হয়। আবু হেনা চৌধুরী প্রথমে আহবায়ক ও পরে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

আজ এমন এক সময় আবু হেনা চৌধুরীকে স্মরণ করছি যখন করোনা ভাইরাস বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষকে আক্রান্ত করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিদিন নভেল করোনা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অসারতা সামনে চলে আসছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায়  দীর্ঘদিনের ঘোষিত লকডাউনে পৃথিবীর সকল দেশের অর্থনৈতিক জীবনসহ সামগ্রিক সামাজিক কর্মকাÐকে স্থবির করে দেয়। সঙ্গত কারণেই নভেল করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজন ছিল বৈশ্বিক সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্ব সংস্থা এবং দেশে দেশে দালাল সরকারগুলো তা না করে সংকটের প্রকৃত ঘটনাকে সামনে না এনে নানা রূপের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংকটের বোঝা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের উপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে দেখা দেওয়া নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম দিকে বাংলাদেশে ছিল না। বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটে। বিমানবন্দরে পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া ব্যাপকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ইতালি ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত প্রবাসীদেরকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে না রেখে মফস্বলে গ্রামের বাড়িতে ঘরবন্দী (ঐড়সব ছঁধৎবহঃরহব) থাকার জন্য বলে দেওয়া হয়। যার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত হয়। অথচ সে সময় দেশে আসা প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সরকারি তত্ত¡বধানে কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব হতো। শুরু থেকেই আমাদের দেশের সরকার করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানালেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ছিল না; ‘করোনা থেকে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী’ সরকারের মন্ত্রীদের এমন আস্ফালনমূলক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য পিপিই, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত টেস্টকিটও। ফলে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু ও অসুস্থ্যতার মুখে পড়তে হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করতে থাকে। বহু মানুষ হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও  সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চরম সংকট দেখা দেয়। এমনকি প্রয়োজনীয় আইসিইউ না থাকার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব নগ্নভাবে জনসাধারণের সামনে আসে। ক্ষমতাসীন সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ^ সংস্থার বৈশি^ক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণকে সচেতন না করে লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, প্রচার মাধ্যমকে স্বপক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে জনগণকে দায়ী করে সরকার ও শাসক শ্রেণির দুর্নীতি, লুটপাট, দমন-পীড়ন ও ব্যর্থতাকে ঢাকার অপচেষ্টা চালায়।

করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীনকে উহান ল্যাবরেটরিতে এই জীবানুঅস্ত্র তৈরি করার অভিযোগ করে। আবার বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন উহানে অনুষ্ঠিত সামরিক বাহিনীর বিশ^অলিম্পিকে আগত সংক্রমিত মার্কিন সেনাদের মাধ্যমে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার পাল্টা অভিযোগ করে। যদিও চীন ও আমেরিকার একে অপরকে দায়ী করার বিষয়টি প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু একথা নি:সন্দেহে বলা যায়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের অতিমুনাফা কেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাই করোনাসহ ‘সার্স-২’, ‘মার্স’, ‘সোয়াইন ফ্লু’, ‘ইবোলা’ ইত্যাদি প্রাণঘাতি ভাইরাসের উৎস হিসেবে কাজ করে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের বহুজাতিক কোম্পানির সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে গাছপালা, বনজঙ্গল উজার করা; জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা; বৈশি^ক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন; পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে চলছে। এসব তৎপরতায় ভাইরাসের মিউটেশন হয়ে প্রাণী থেকে মানুষে বা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশ সৃষ্টি করে। আবার বাজার ও প্রভাব বলয় নিয়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যে আগ্রাসী যুদ্ধের জন্য জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে প্রচলিত অস্ত্র, পারমানবিক, রাসায়নিক, জৈবঅস্ত্র. সাইবার অস্ত্র, লেজার অস্ত্র, তেজস্ক্রিয়তা ও বিকিরণ ইত্যাদি বিভিন্ন রূপের তৎপরতাও প্রাণঘাতী ভাইরাস সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে সামনে আসছে। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ও ঔষধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষ করে আমেরিকা ও চীন ভ্যাকসিনকে তাদের অর্থনৈতিক মুনাফা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। করোনাকে কেন্দ্র করে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এবং পরষ্পর বিরোধী অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং অপপ্রচার অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যমান শোষণমূলক বিশ^ব্যবস্থায় শ্রমিক-কৃষক-জনগণের উপার্জিত অর্থ ও সম্পদ জনগণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) পূরণের লক্ষ্যে ব্যয় না হয়ে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতির হাতে কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পণ্য ও বাণিজ্য হিসেবে গণ্য করায় গণস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় বিশে^র উন্নত ও অনুন্নত বেশীরভাগ দেশেই করোনা মোকাবিলা করতে কার্যত ব্যর্থ হয়। আবার অন্যান্য রোগের চিকিৎসা সেবাও বিপর্যস্ত হচ্ছে। ফলে করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ না থাকা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে মুনাফাভিত্তিক বেসরকারি মালিকানাধীন চিকিৎসা কেন্দ্র, বাজেটে নগন্য বরাদ্ধ ইত্যাদির কারণে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-জনতা করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।

স¤প্রতি সিলেট মহানগরে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমসি কলেজের গেইট থেকে প্রাইভেটকারসহ স্বামী-স্ত্রীকে জিম্মি করে কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ছাত্রলীগের দুবৃত্তদের গণধর্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ, নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে স্বামীকে বেধে রেখে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রচেষ্টার ভিডিও ধারণ করে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মাসাধিককাল পর তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশের নারী সমাজ তথা শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের জীবনে বিদ্যমান শোষণ-নিপীড়নের পাশাপাশি নারীদের ওপর ভয়াবহ পাশবিক নির্যাতন সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে। এসব সমস্যাগুলো ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণি শোষণের পাশাপাশি নারীকে শোষণ নির্যাতন ও পুরুষের ভোগ্য বস্তুতে পরিণত করার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে পণ্যে পরিণত করে একচেটিয়া মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করছে। তাই নারী বৈষম্য, নারী নির্যাতন প্রতিনিয়ত আরও নগ্ন ও জিঘাংসা রূপে প্রকাশ ঘটছে। আর তাই নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার, পর্ণোগ্রাফী ও কালোবাজারি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি গণবিরোধী অসামাজিক কার্যকলাপ বাংলাদেশেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে আজ ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।

বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের এমডিজির ধারাবাকিতায় এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং ফেসবুক, ইউটিউব এর মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবক্ষয়ী সংস্কৃতিকে বিস্তৃত করে যুবসমাজকে বিপথগামী করার ফলে উল্লিখিত সমস্যা এত তীব্ররূপ ধারণ করেছে। এ সমস্যার মূল কারণ প্রচলিত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী চলমান মন্দায় বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়ে শ্রমিক-কৃষক-জনগণ সীমাহীন অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা থেকে বাঁচার জন্য যাতে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে সংগঠিত হয়ে অগ্রসর হতে না পারে তা ঠেকানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদ অবক্ষয়কে ব্যপকতর করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার প্রতিফলন ঘটছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের মত নয়াঔপনিবেশিক-আধাসামন্ততান্ত্রিক দেশে সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে আরও তীব্রতর রূপে কার্যকরী করার জন্য তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত-আমলা-মুৎসুদ্দিপুঁজি প্রভুর পরিকল্পনা ও স্বীয় লক্ষ্য হাসিলে যে নগ্ন শোষণ-লুন্ঠন, নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার অন্যতম রূপ বেপরোয়া ও ব্যপকতর ধর্ষণ ও নির্যাতনের সা¤প্রতিক গণধর্ষণের ঘটনাবলী। শাসক-শোষক শ্রেণির এই শোষণ-লুন্ঠন, নিপীড়ন-নির্যাতনকে কার্যকরী করছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য প্রভুর আশীর্বাদ নিয়ে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বৈরাচারকে তীব্রতর করে চলেছে। ফলে সরকারি দলের শোষক, গুন্ডা মাস্তানদের দৌরাত্ম সীমাহীন রূপ নিচ্ছে। করোনাজনিত দুর্যোগে অসহায় গরীব-দুখীর ত্রাণ ও বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সীমাহীন দুর্নীতি, চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজ-রসুন-আদা, শাক-সবজি-তরিতরকারি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতিসহ রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য দায়ী সরকারি দল, সকল রূপের ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিরা’ ও প্রশাসন তথা সরকার। এরা সমগ্র দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বারা এবং ক্ষমতার বলয়ে থেকে দলীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা অত্যাচার চালিয়ে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একটির পর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলেছে। সিলেটের রায়হান হত্যার আগে কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ড। প্রদীপ-লিয়াকত কান্ড হিসাবে যা দেশে পরিচিত। মানুষ ভুলে গিয়েছে বিগত নির্বাচনে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের নারী নির্যাতনের কথা। কুমিল্লার তনু হত্যা, মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা, শিশু সায়মা হত্যা ইত্যাদি একের পর এক নারী ধর্ষণ-নির্যাতন ও হত্যার কথা গুরুত্বের সাথে আলোচিত হলেও ক্ষমতার উৎসের সাথে সম্পর্কের কারণে এসব ধামাচাপা পড়ে যায়।

জাতীয় ও আন্তার্জাতিক এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধোত্তর কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দা ও সংকটে নিমজ্জিত। ২০০৮ সাল থেকে সৃষ্ট এ সংকট সাম্রাজ্যবাদের ব্যবস্থাজনিত অন্তর্নিহিত সংকট। চলমান করোনা পরিস্থিতি যাকে আরো বিপর্যস্ত করেছে। দীর্ঘস্থায়ী বৈশি^ক মন্দায় ২য় শীতলযুদ্ধ, তৃতীয় শীতলযুদ্ধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ সামনে আসছে। অসম বিকাশের নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর বৃটেন উডস সম্মেলনে গঠিত সাম্রাজ্যবাদী বিশ^ সংস্থা, বিশ^ব্যাংক, আইএমএফ, গ্যাট, জি-৭, জি-৮ ইত্যাদির কার্যকারিতা হারাতে থাকলে আন্তর্জাতিক শক্তি সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় গঠিত হয় জি-২০। তাতেও মন্দা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। বাজার ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধির প্রশ্নে বাজার পুন:বণ্টনের জন্য মুদ্রাযুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ, স্থানীয়যুদ্ধ, আঞ্চলিকযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় তারা বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে যার প্রতিফলন ঘটছে এবং বর্তমানে যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তাদের এই যুদ্ধ প্রস্তুতি থেকে আমাদের দেশও মুক্ত নয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু, তিন দিকে আধা-সামন্তবাদী ভারত ও উত্তরে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মালাক্কা প্রণালী থাকায় বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় এতদ্বাঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা এবং চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) পরিকল্পনা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আন্তসাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্ব›দ্বীতা বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক তথা সামগ্রিক সংকট তথা অস্থিরতা ও জটিলতা বৃদ্ধি করে চলছে। নয়াউপনিবেশিক ভারতের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও বাণিজ্য উদ্যোগ’ চুক্তির ধারাবাহিকতায় সবশেষ মোদি-ট্রাম্প প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিরক্ষা রণনীতিতে ভারতের ‘এক্ট এশিয়া’ রণনীতিকে সমন্বিত করে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যুক্ত করার তৎপরতা চলছে। তাছাড়া এতদ্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান-অষ্ট্রেলিয়া-ভারতকে নিয়ে চতুষ্ঠয় জোট গঠনসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন এতদ্বাঞ্চলে তার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশে তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি করে নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধারাবাহিক তৎপরতার প্রেক্ষিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় রূপে বিনিয়োগ ও ঋণচুক্তি স্বাক্ষর, সমুদ্রসীমা সুরক্ষা উন্নয়ন, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আংশিক কাজের প্রাথমিক চুক্তি, চীনের সাথে দু’দেশের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ৩টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের ষ্ট্রিং অব পার্লস, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই‘), সিল্ক রোড, বিসিম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মায়ানমার) ইকোনোমিক করিডোর এবং জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক করিডোর ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতের লুক-ইষ্ট পলিসি ও প্রতিবেশীদের তথা এশিয়ার দেশসমূহে নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা, বৃহৎ বাজার ও পুঁজি এবং ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নয়াউপনিবেশিক ভারত সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে দর কষাকষির সুযোগে এসকাপ প্ল্যানের সাথে নিজেদের স্বার্থ জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বাত্মক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য করিডোর কার্যকরী করে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ আমলের এতদ্বাঞ্চলে যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ চট্টগ্রাম ও মংলা পোর্ট ব্যবহার, ফেনী নদীর পানি ব্যবহার, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ২০টি রাডার স্থাপন ইত্যাদি নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংঘাত ও যুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, আসামের নাগরিকত্ব সমস্যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করছে।

সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের শোষণ-লুন্ঠন এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দেশ ও সমাজকে অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির নামে, ছাত্ররাজনীতির নামে রাজনীতিকে, শিক্ষাঙ্গনকে, গোটা দেশ ও সমাজকে কলঙ্কিত করছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনীতি বিমুখ করার কাজে এরা নিয়োজিত। যুব সমাজের শক্তিকে হীনবল করতে মাদক, অস্ত্রবাজী, নারী নিগ্রহ এ সকল পথ বেছে নিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আজ প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবসমাজ সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে, কিন্তু সা¤্রাজ্যবাদীদের কর্মকান্ডকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। নতুন করে বর্তমানেও সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সম্মিলিতভাবে হায়েনাদের বিরুদ্ধে, রক্তখেকো ড্রাকুলাদের বিরুদ্ধে, তাদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল শক্তি আমাদের দেশে অতীতেও এমন অনেক স্বৈরাচার, স্বৈরাচারের দোসরদের পতন ঘটিয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আমলের স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালালপুঁজি বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একনিষ্ট কর্মি ও নেতা আবু হেনা চৌধুরীর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। আবু হেনা চৌধুরীর স্বপ্ন দেখতেন এদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা দালালপুঁজিকে উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। এ লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। আবু হেনা চৌধুরীর এই মতাদর্শ ও আজীবন লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

 লেখক: সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সিলেট জেলা শাখা।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৪ অক্টোবর ২০২০/জুনেদ   

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন