আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং
আশরাফ আহমেদ :: 'সুরমা গাঙের পাড় বাড়ি,শাহজালালের উত্তরসূরী, কথায় কথায় বেটাগিরি, আমরা হক্কল সিলটী, আমরা হক্কল সিলটি ' সিলেটি ভাষায় সিলেটের জনপ্রিয় এই আঞ্চলিক গানের সুরে আমিও বলি ‘আমরা হক্কল সিলটী’।
সিলেট, কারো কাছে আধ্যাত্নিক নগরী, কারো কাছে চায়ের দেশ, কেউবা বলেন ২য় লন্ডন, কারো চোখে প্রকৃতিকন্যা। এরকম ভিন্ন ভিন্ন নামে দেশবিদেশে সিলেটের পরিচিতিরও আছে যথেষ্ট যৌক্তিকতা। সে ইতিহাস লিখতে গেলে লম্বা হয়ে যাবে। যাইহোক, সিলেট কে যে যাই বলে ডাকেন, আমার কাছে সিলেট একটা আবেগের নাম, হৃদয়ের আস্থার রাজধানী। স্বপ্ন পূরণের শহর। ভালবাসার এই সিলেটের আজ জন্মদিন৷ অনেক উত্থান পতনের পর ১৭৮২ সালের ৩ জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিল সিলেট।
সিলেট সম্পর্কিত বিভিন্ন থেকে জানা যায়, ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ছিল ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ওই বছরেই ১২ সেপ্টেম্বর ভারতে নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের সাথে সিলেটকে সংযুক্ত করা হয়। সিলেট পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭৮ সালে। ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত (১৯০৫-১৯১১) পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কালটুকু বাদ দিয়ে) সিলেট আসামেরই অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন এর সময় বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ৪ টি নতুন জেলায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার) বিভক্ত করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট দেশের ষষ্ঠ বিভাগ হিসাবে মর্যাদা পায়।
প্রাণের শহর সিলেটের নামকরণের ও রয়েছে মজার সব ইতিহাস। বিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক আল-বিরুনী তার ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামক গ্রন্থে সিলেটকে ‘সিলাহট’ নামে উল্লেখ করেন।হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শিবের স্ত্রী সতি দেবীর কাটা হস্ত ( হাত) এই অঞ্চলে পড়েছিল, যার ফলে ‘শ্রী হস্ত’ হতে শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এদিকে,, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম “সিরিওট” বলে উল্লেখ আছে। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে যখন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে এ অঞ্চলের নাম “শিলিচতল” উল্লেখ করেছেন। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী দ্বারা এদেশে মুসলিম সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটলে মুসলিম শাসকগণ তাঁদের দলিলপত্রে “শ্রীহট্ট” নামের পরিবর্তে “সিলাহেট”, “সিলহেট” ইত্যাদি নাম লিখেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ মিলে। আর এভাবেই শ্রীহট্ট থেকে রূপান্তর হতে হতে একসময় সিলেট নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। এছাড়াও বলা হয়, এক সময় সিলেট জেলায় এক ধনী ব্যক্তির একটি কন্যা ছিল। তার নাম ছিল শিলা। ব্যক্তিটি তার কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি হাট নির্মাণ করেন এবং এর নামকরণ করেন শিলার হাট। এই শিলার হাট নামটি নানাভাবে বিকৃত হয়ে সিলেট নামের উৎপত্তি হয়। আবার সুলতানি আমলে এই অঞ্চলকে জালালাবাদ বলে ডাকা হত।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার সিলেটের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বরাবরই মন কাড়ে। দাঙ্গাহাঙ্গামা, চাঁদাবাজি তুলনামূলক কম, সুশৃঙ্খল প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে বসবাসের জন্য সিলেট কে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয় ।
মুঘলদের সাথে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান অপরিসীম। দেশে আসা রেমিট্যান্সের সিংহভাগই আসে সিলেটের মানুষের কাছ থেকে। প্রবাসী অধ্যুসিত এলাকা হিসেবে পরিচিত সিলেটকে বলা হয় ২য় লন্ডন।প্রাকৃতিক সুন্দর্যের স্বর্গরাজ্য সিলেটের মানুষের আতিথেয়তা বরাবরই মুগ্ধ করার মতো৷ জনশ্রুতি আছে, সিলেটের মানুষেরা দেয় বেশি, কম নেয়।
ভালবাসার, ভাললাগার প্রাণের সিলেট, অম্লান থাকুক লাল সবুজের হৃদয় হয়ে। শুভকামনায়, শুভেচ্ছা, প্রিয় প্রকৃতিকন্যা।
তথ্যসূত্র:আদি সিলেটের কথা, সিলেটের ইতিবৃত্ত, সিলেটের ইতিহাস, বাংলা তথ্য বাতায়ন,
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।