আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং

অং সান সু চিকে লেখা খোলা চিঠি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৯-১১ ০০:২৭:৫৩

নঈম নিজাম :: ৮৫ বছর বয়সী ডেসমন্ড টুটু ক্যান্সার আক্রান্ত। আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী এই নেতা আবার আলোচনায় এলেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে খোলা চিঠি লিখে।

এক খোলা চিঠিতে তিনি বলেছেন, “বার্ধক্য আমাকে গ্রাস করেছে। এখন আমি জরাগ্রস্ত, সবকিছু থেকে অবসর নিয়েছি। ঠিক করেছিলাম সার্বজনীন বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আর কিছু বলব না। কিন্তু আজ তোমার দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের গভীর সংকটে সেই নীরবতা আমি ভাঙছি। হে আমার বোন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোই যদি তোমার নীরবতার কারণ হয়ে থাকে, তার জন্য সত্যিই বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে। আমরা প্রার্থনা করি, তুমি ন্যায়বিচারের পক্ষে মুখ খোল, মানবতার পক্ষে কথা বল, দেশের মানুষের ঐক্যের কথা বল। আমরা প্রার্থনা করি যাতে তুমি এই সংকটে হস্তক্ষেপ কর। ”

আমি জানি না ডেসমন্ড টুটুর এই আহ্বান মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কানে গিয়েছে কিনা। সু চির মতোই আরেকজন নোবেল বিজয়ী এই ডেসমন্ড টুটু। সাবেক এই ধর্মযাজক তার জীবনের শেষ আকুতি জানিয়েছেন। এই আকুতি শুধু সু চির জন্য নয়, বিশ্ব বিবেককেও জাগ্রত করার জন্য। কারণ, রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যা নয়। সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে বার্তা যাচ্ছে বিবেক জেগে ওঠার জন্য। একটা সময় আমরা দেখতাম যাত্রামঞ্চে অনাচার-অত্যাচার বন্ধ করতে বিবেকের আগমন হতো। বিবেক তখন তার আকুতি ও আহ্বান জানাতেন। আজ আফ্রিকান নেতা বিশ্ব বিবেকের কাছে ‘বিবেকে’র ভূমিকা নিয়েছেন। সু চি কতটা এই সংকট নিরসনে সক্ষম, জানি না। কিন্তু তার ভুলে গেলে চলবে না, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার আমলে তাকে তার পরিবার-পরিজন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। একটা বড় সময় তাকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন তিনি ক্ষমতার স্বপ্নে অতীতকে ভুলে গেলে হবে না। বর্তমানকে ঘিরেই অতীত। দুঃসময় সু চিরও ছিল। আর রোহিঙ্গা সমস্যা হঠাৎ উড়ে আসা সমস্যা নয়। দাঙ্গাও নতুন করে উদয় হয়েছে এমনটাও নয়। ১৯৪২-৪৩ সালে বার বার সেখানে দাঙ্গা হয়েছিল। তখন ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপকে আশ্রয় দিয়েছিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। আরেকটা গ্রুপকে পাঠিয়ে দিয়েছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। সমস্যা ৬০ ও ৭০-এর দশকেও ছিল। ১৯৭৮ সালে ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের একটি গ্রুপ ফিরে গেলেও অনেকে থেকে যান। এই সংকটের ধারাবাহিকতা আবার দেখা দেয় ১৯৯১-৯২ সালে। সেই সময়ে আবারও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয় মিয়ানমারে। বাকিরা থেকে যান। সেই থেকে এই সমস্যা আমাদের সঙ্গে লেগেই আছে। সরকার যায়, সরকার আসে, কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট সমাধান হয় না। এই সমস্যা আমাদের নয়, এই সমস্যা মিয়ানমারের। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বৈঠক করেন আরও অনেক মুসলিম নেতার সঙ্গে। তখন ব্রিটিশ অবহেলায় সেই সংকটের নিরসন হয়নি। ১৯৭১ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। তারা বাংলাদেশ বিরোধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও সমর্থন দেয়। কিন্তু বিলম্বে হলেও তারা বুঝতে পারছে বিশ্ব মানবতার ডাকে বাংলাদেশ ছাড়া আর কেউই নেই।

বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে অবস্থান করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেই আছে ৭ লাখের মতো। ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, প্রতিদিনই বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা আসছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি। বাকি তরুণ-যুবারা কোথায় না জানলেও নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান  রোহিঙ্গাদের দুঃখে কাঁদলেনও। এই অশ্রু যেন কক্সবাজারের মাটিতে শুকিয়ে না যায়। ফার্স্ট লেডি তার নিজের দেশে কিছু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেবেন— সেই প্রত্যাশাটুকুই আমরা করি। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সব দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে— এটাও আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশ মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে সবসময় ছিল। এখনো আছে। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা আন্দোলনে কঠিন সময়ে সমর্থন দিয়েছিল। কুয়েত ও সৌদি আরবের পাশেও দাঁড়িয়েছিল। এখন মুসলিম জাহানের নেতারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন সে আশা করি না। কারণ, বাংলাদেশের বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অনুধাবন করছে। বিবৃতি দিয়ে তা প্রকাশও করেছে তারা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়েছেন শান্তিতে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী মালালাও। কিন্তু আমরা ভারত, চীন ও রাশিয়ার কোনো শক্ত ভূমিকা দেখছি না। ব্যবসায়িক কারণে নাক গলাচ্ছে না ভারত ও চীন। রাশিয়ার ভূমিকা কূটনীতির কৌশলগত। এই পরিস্থিতিতে মানবিক মূল্যবোধ থেকে বলিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার এই সাহসী অবস্থান, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশের মানুষ ইতিবাচকভাবে দেখছে। বাংলাদেশ সবসময় ইতিবাচক ধারার পক্ষে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু বাংলাদেশের একার নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশের ছিল। কারণ ১৭৮৪ সালে ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত আরাকানের ইতিহাস ছিল ভিন্ন। তখন আরাকান রাজ্যসভায় মুসলিম রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি ছিল। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে সেই অতীতও মনে রাখতে হবে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। এ দায়িত্ব মানবিক। এখন জরুরি ভিত্তিতে বিশ্বকে সক্রিয় করতে হবে এই নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আনতে হবে। ভারত ও চীনের সঙ্গে প্রয়োজনে বৈঠক করতে হবে এই ইস্যু নিয়ে। আলোচনার টেবিলেই অনেক সংকটের নিরসন হতে পারে।

মিয়ানমার একটি নিষ্ঠুর দেশ। সামরিক জান্তা, উগ্রবাদী মগ সম্প্রদায় যত নিষ্ঠুরতা চালাক না কেন, সু চিকে তার অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে হবে। নারী যখন নিষ্ঠুর হয়, তখন ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। তারা ভুলে যান অনেক কিছু। সু চিরও হয়েছে তাই। ক্ষমতার লোভ তাকে নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ কারণেই রাখাইনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে সংখ্যালঘু মানুষকে। মুসলমানদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিন্দুও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় সংখ্যালঘুরাই মগদের টার্গেট। যে পর্যন্ত তাদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কসোভো, প্যালেস্টাইনের মতো আলাদা সেফ জোন না হবে, সে পর্যন্ত এই নিষ্ঠুরতা চলতেই থাকবে। তাই সু চিকে আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা টুটুর মতোই বলছি, আপনার নিষ্ঠুরতা বন্ধ করুন। আপনি যদি সামরিক জান্তার সঙ্গে পেরে উঠতে না পারেন, ত্যাগ করুন ক্ষমতার মসনদ। ছেড়ে দিন শান্তিতে পাওয়া নোবেল পদক। অবসান ঘটান নিষ্ঠুরতার। বিশ্ব আজ না হোক কাল আপনাকে তুলনা করবে হিটলারের সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদিদের গ্যাস-চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। আজ আপনার দেশে একই নিষ্ঠুরতা চলছে। সার্বিক বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের সরকারকেও। দেশের সব মানুষক। কোনো উসকানিতে পা রাখা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে আমাদের দেশে। বিশ্বকে জানাতে চাই, আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। একই সঙ্গে সরকারকে দ্রুত নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে নতুন করে আগত সব রোহিঙ্গার। এমনকি আগে থেকে যারা অবস্থান করছেন তাদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। তাদের দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করতে আসবে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এই সংকট আমাদের জাতীয় সংকট। সংকট নিরসনে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে থাকতে হবে ঐক্যবদ্ধ। সমস্যা নিয়ে কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না রাজনীতি করা।

১৯৭১ সালে আমাদের পাশে শুধু ইন্দিরা গান্ধীই দাঁড়াননি, তার প্রতিপক্ষ বিরোধী দলও বাংলাদেশ প্রশ্নে তাকে সমর্থন দিয়েছিল। এখনো যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা যখন ভারত সফরে যান তখন দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক টেবিলে দেখা যায়। আমরাও বাংলাদেশে তেমন অবস্থা দেখতে চাই।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন