আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং
মুনজের আহমদ চৌধুরী :: প্রচলিত রাজনীতির নষ্ট স্রোতের নীতিহীনতার বাইরের একজন জননেতার নাম সৈয়দ মহসীন অালী। যিনি তাঁর জীবনে কখনো সচেতনভাবেই ধূর্ত রাজনীতিবিদ হতে চাননি, চেয়েছেন অাজীবন মানুষের ভালবাসা। অর্থ-বিত্ত, সম্পদ কোনকিছু চায়নি লোকটা। পরিবারে স্ত্রী কন্যাদের সময় দেয়নি কোনদিন। মানুষ, খুব সাধারন মানুষ, কল্যান অার উপকার- অামৃত্যু যেন সাধনা ছিল লোকটার। ভালবাসতেন খেতে অার মানুষকে খাওয়াতে। শরীরের মতোই বড় ছিল হৃদয়টা। যতটা রাজনীতিক,তাঁর চেয়ে বহুগুন সফল পাবলিক লিডার।
অন্তত অাধেক যুগ খুব কাছ থেকে দেখেছি। ঘরের বাইরে সে সময়টাতে অামি তাঁর যতটা অাদরের সঙ্গী ছিলাম,তাঁর অাদরের তিন কন্যা ঘরের বাইরে ততখানি তাকেঁ কাছে পাননি। সে কথা তারা বলেন। চার বছর হজরত শাহ মোস্তফা (রহঃ) র মাজারে সব জুম্মা একসাথে পড়েছি,অাসতে দেরী হলে,শহরের বাইরে থাকলে কদাচিৎ; ফোনে ডাকতেন।
একটা সময় বিশাল মানুষটিকে সব হারাতে হয়েছিল। নেমে অাসতে হয়েছিল একেবারে সাধারন মানুষের কাতারে। তিন বারের পৌর মেয়রকে জোর করে ২০০৪ সালে ব্যালটবাক্স ছিনিয়ে করে হারানো হল। সিরাজ ভাইয়ের লোডেড পিস্তলের মুখে বিডিয়ার বেষ্টিত অবস্থায় প্রথম প্রতিবাদী স্লোগানটি সেদিন অামি ধরেছিলাম। হাফিজা খাতুন কেন্দ্রে। তাক করা পিস্তলের মুখে ধস্তাধ্বস্তির মাঝ থেকে অামাকে উদ্ধার করে অানা হল ইস্কুলবন্ধুনাইমা আল নোমানের বাসায়। অামাকে অক্ষত অবস্থায় দেখে নাঈমার সেদিনের বাল্যবন্ধুর জন্য কান্না অামি অামার জীবনে কখনো ভূলতে পারব না।
সেই শুরু মহীরূহ মহসীন অালীর খুব কাছে যাবার। এরপর পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার সুতোয় অাষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাবার অাগ পর্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি তাকেঁ। হাজারো স্মৃতি মানুষটার সাথে। চোখ ঝাপসা হয়ে অাসে। কোথা থেকে যে শুরু করি...।
লোকটা রাত জেগে পড়তেন। বই পড়াটা অভ্যাস করতে অামাকে একরকম বাধ্য করেছিলেন। তার ৮১২ নাম্বার ভাঙ্গাচোরা জীপটার ক্যাসেট প্লেয়ার দুদিন নষ্ট থাকলেই গান শুনতে না পেরে উতলা হতেন।
একটা সময় বাড়ী থেকে বেরিয়ে চৌমুহনায় মিছিলে যোগ দিতে যাবার সময় তাঁর অনুজ সৈয়দ নওশের আলী খোকন, অার অামি ছাড়া অন্য কেউ সঙ্গী হতেন না। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সাথীরা স্বার্থের অংকে নিরাপদ দুরত্বে থাকতেন। সে কঠিন সময়ে মহসীন অালী তাঁর অাত্বসন্মান অারো প্রবলতায় বরং অাকঁড়ে থেকেছেন। এমন দুঃসময়ের পরও তিনি সুসময়ের দিন অানতে পেরেছিলেন। তাঁর মাটি কামড়ে পড়ে থেকে, ঘুরে দাড়াবার সংগ্রাম লেখা রবে, ইতিহাসের অক্ষরে।
সেই দিনগুলিতেও তার কন্যা সৈয়দা শায়লা চৌধুরী, সানজিদা শারমিন, সৈয়দা সাবরিনা শারমিনের ভাতমাখা অাদরের হাতের পিছুটানও,তাকে ফেরাতে পারত না, রাত-দুপুরেও মানুষের জন্য সদা ছুটে চলা থেকে। তিনি ছুটেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে,নীপিড়িত দুর্গত মানুষের টানে। নিজের পকেট খালি হলে মানুষের জন্য চাইতে তিনি দ্বিধা করতেন না কখনো আকবর আলীরমতো তাঁর বিশ্বস্ত,সমুদ্র হৃদয়ের ব্যাংকের কাছে।
পৌর নির্বাচনে জোর করে হারিয়ে দেবার পর তিনি ষড়যন্ত্রের কাছে হতে পারলেন না চেম্বার অব কমার্স সভাপতি। এরপর রাজনীতির এক ঘরের মানুষরা শেষ মুহুর্তে পেছন থেকে খেললেন মহসীন অালীর বিরুদ্ধে অাত্বঘাতি খেলা। ফলাফল, জেলা অাওয়ামীলীগ সভাপতির ভোটে হারলেন মহসীন অালী। সেদিন ভোটের পর সার্কিট হাউসে মহসীন অালীকে নয়,তাঁর পাশে দাড়ানো অামাকে জড়িয়ে সান্তনা দিচ্ছিলেন অাজকের সাধারন সম্পাদক নেছার অাহমদ। কেননা,অামার চোখ তখন অশ্রুসজল। বার বার ব্যাক্তিগত স্মৃতিকাতরতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী পাঠক। লাখ লাখ মানুষ লোকটিকে বার বার ভোট দিয়েছেন। এ মানুষটি, এবং তাঁর স্ত্রী অামার শ্রদ্বেয়া চাচী সৈয়দা সায়রা মহসীন এমপি অামাকে শুধু ২০০৭ সালের মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরীর নির্বাচনে অামাকে কেবল ভোটই দেননি। সৈয়দ মহসীন অালী ছিলেন অামার মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবকারী, সমর্থনকারী ছিলেন শ্রদ্বেয় তারেক অাহমদ চাচা (সত্বাধীকারী সিলকো পাইপ ইন্ড্রাষ্টিজ)। একজন মহসীন অালীকে নির্মানে তাঁর স্ত্রীর অাজীবনের ত্যাগের কথা না স্বীকার করলে অন্যায় হয়। রোজকার রান্নাঘরের শত মানুষের খাবারের গভীর রাত কিংবা স্বামীর প্রতি পরম নির্ভরতার হাত সৈয়দা সায়রা মহসীনকে কেবল অনন্যতাই দেয়নি। নেতাদের রেখে সে নিছক গৃহিনীকেই সাংসদ করাই তখন সংগত ভেবেছেন শেখ হাসিনা।
যা হোক। সেই কূট-কৌশলের হেরে যাওয়া মানুষটি পরে এম সাইফুর রহমানের মতো জাতীয় নেতাকে নিজ অাসনে পরাজিত করে এমপি হয়েছেন। কোন্দলের বলি হয়ে সেসময় দল ক্ষমতায় থাকবার সময়ও তাকে কোনঠাসা থাকতে হয়েছে। ধৈর্য্যের পরীক্ষায় পাশ করায় শেখ হাসিনা পরম অাস্থায় তাকেঁ মন্ত্রী করেছেন। তাঁর নেত্রী তাকে খুব বিশ্বাস করতেন।
বহু ষড়যন্ত্র করেও তাকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানো যায়নি। কেন? কারন,সাধারন মানুষ তাকে ভালবাসত। লোকটা অসৎ ছিল না,চরিত্রহীন ছিল না। কারো টাকা মেরে খাননি। শেখ হাসিনাকে ভালবাসতেন অন্ধের মতোন। ওয়ান ইলেভেনে সেনা সরকারের অব্যাহত হুমকীর মুখেও বিশাল অায়োজনে ১৫ই অাগষ্ট পালনের অসীম সাহস,সিলেট বিভাগে সেই লোকটি রাখত। সংস্কৃতিবান ও রুচীবান,স্মার্ট সেই পুরুষটির নাম সৈয়দ মহসীন অালী। এম.সাইফুর রহমান মন্ত্রী তখন। তবুও মহসীন অালী শহরের দারুল উলুম মাদ্রাসার অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নিলে সাইফুর রহমান তৎকালীন জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন, 'মহসীন যেভাবে বলবে, সেভাবে বিষয়টি সমাধান হতে হবে।' অামি সে দৃশ্যের চাক্ষুষ সাক্ষী। খুউব গর্ব হয় সেই ভিন্নমতের বাইরের রাজনৈতিক সম্প্রীতির দিনগুলির শহরের মানুষ অামি, সে কারনে।
সৈয়দ মহসীন অালী একদিন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকে বলেছিলেন,অামি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় তদবিরবাজ। অামি তদবির করি গরীব,অসহায়,বিচার না পাওয়া মানুষের জন্য। অামার কথা অাপনাকে শুনতে হবে। অথচ তিনি তখন বিরোধী দলের নেতা। পৌরসভার চেয়ারম্যান ও নন। প্রশাসন তাঁর কথা শুনত,সমীহ করত বিরোধীদলে থাকলেও, কেননা তিনি ব্যাক্তি মহসীন অালী। মৌলভীবাজারের মহসীন অালীর দল-গ্রুপ লাগত না,তাঁর সমীহ জাগানো ব্যাক্তিত্বের কারনে। তাঁর কাছে সব দলের মানুষ ভরসার জায়গাটা পেতেন। এটাই তাঁর বড়ো গুন।
অনেকে বলবেন,তাঁর কি ভূল,দোষ ছিল না। উত্তরে বলি, অবশ্যই ছিল। অাপন-পর চিনতেন না। ভূল মানুষকে রাজনীতিতে বিশ্বাস করে ঠকেঁছেন। এবছর বিলেতে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকেঁ সেভাবে স্মরন করা হলো না। শুধু ব্যাক্তিগত ব্যস্ততায় অামি উদ্যোগ নিতে পারিনি বলে। অনেকেই তাঁর উদারতার,সরলতার সুযোগটি নিয়েছেন। শেষ জীবনে নিজের প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারনে দ্রুত রেগে যেতেন। ভূল-ভাল কয়টা বক্তব্যও দিয়েছেন। ঐ পর্যন্তই। কিন্তু, মহসীন অালী তার সারাজীবনে পরিকল্পনা করে কোন মানুষের ক্ষতি করেননি।
সেলফোন অার বেডরুম অবধি বাড়ীর দরোজা তাঁর ভোররাত হলেও সাধারন মানুষের জন্য খোলাই থাকত। মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব,সাহস অার অাত্বসন্মান বোধটা মানুষটার ছিল। কয়েক হাজার গানের লাইন মুখস্ত রাখার রোগটা অামায় দিয়েছিল লোকটা। ব্যাক্তিগতভাবে সৎ ছিলেন বলেই ২০০১ সালের নির্বাচনের পর অাওয়ামীলীগের প্রথম বর্ধিত সভায় শেখ হাসিনার কাছে দাড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন,'নেত্রী দল ক্ষমতায় থাকতে অামি সৈয়দ মহসীন অালীর মতো মাঠের নেতা তোফায়েল, অামু ভাইদের সাক্ষাত পাইনি। চাটুকারদের জন্য অাপনি হেরেছেন। নেত্রী যারা বিএনপি বা চারদল করে,তারা তো অামারই ভাই, অামার সন্তান'।
অাজ মৌলভীবাজারের মাটি ও মানুষের জননেতার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই এপ্রিলের ১১ তারিখ অামার বাবা এডভোকেট জামিল উদ্দীন চৌধুরীকে হারিয়েছি। বাবা একদিন অসুস্থ ছিলেন বাসায়। সম্ভবত ২০০৪ সালে। সে কারনে সেদিন সিলেটে যাইনি সৈয়দ মহসীন অালীর সাথে। সন্ধেবেলা তিন বার হার্ট সার্জারী করা অসুস্থ সৈয়দ মহসীন অালী তিন তলা সিড়ি বেয়ে উপস্থিত অাব্বাকে দেখতে।স্মরন করি,তাঁর দীর্ঘদিনের একান্ত সচিব,অকাল প্রয়াত নির্মল নাগ দাকেও।
অনেক কিছু লেখবার ছিল। কিন্তু যাদেঁর সাথে সম্পর্কটা থাকে খুব অাবেগের,তাঁরা চলে যাবার পর তাদের নিয়ে অামি কেন জানি লিখতে পারি না। সেলফোনের কিবোর্ড বেয়েঁ নামে স্মৃতি-পোড়া অশ্রুধারা। তবু লিখব, তবে এখন না। অন্য কোন কঠিন, দুরূহ সময়ে অাপনার স্মৃতির খানিকটা হলেও। কিছুক্ষন অাগে অাপনার সবচেয়ে ছোট ভাই সৈয়দ সুলেমান আলীর ইনবক্সের চিঠির জবাবে সেকথাই বলেছি।
ভালো থাকবেন,কঠিন সত্য সহজে বলতে পারা সাধারন মানুষের নেতা। ভালো থাকবেন রাজনীতির গীতিকবি। একজন অাপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মানুষ। অসহায় মানুষের কান্না যাকেঁ অশ্রুসিক্ত করত।
অাপনার কারনে,এখনো গর্ব করে ভাবতে পারি,অামি অাজকের ছাত্রলীগ নয়, অাসলেই মহসীন লীগ করতাম। তারুন্যের উত্তাল দিন অামি ভূল ভালবাসায় পার করিনি। কোনদিন কোন ধরনের ব্যাক্তিগত দরকারে অাপনার শরনাপন্ন হইনি সুবিধা চেয়ে, এটুকুই প্রাপ্তি।
অাপনার স্মৃতি,অাপনার অাত্ববিশ্বাস অামার পথচলার প্রেরনা। অাপনার চলা-ফেরার,অাদর্শের কিছুটা ছায়া নিয়ে সাইফুর রহমান বাবুলরা এখনো সে জনপদে রাজনীতি করেন,অাপনার দলের। তাদের মানুষ ভালবাসেন,তারা অাপনার অনুসারী বলেই।
খুব সাধারন,খেটে খাওয়া মানুষের অন্তরে মমতা অার অাস্থার অক্ষরে বহুকাল অাপনার নাম লেখা রবে। অামাদের সময়ের তারুন্য,সাহস অার নৈতিকতার নায়কের উজ্জল স্মৃতিতে অাপনি অাছেন-অাপন প্রবলতায়,সরলতায়।
(লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া)