আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

রোহিঙ্গারা কি বাঙালি?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৯-২২ ০০:৫৯:৩০

হাসান শাহরিয়ার :: বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলশ্রুতিতে আগের বিশ্ব আর নেই। সব দেশই বদলে গেছে, বিভিন্ন সংস্কৃতির সমাহারে হয়ে উঠেছে বহুজাতিক।

কোনো দেশই এখন আর বিশেষ এক বা একাধিক জাতিগোষ্ঠীর জন্য চিহ্নিত নয়। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুশিক্ষিত ইমিগ্রেন্টরা শুধু সরকারেই নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও উচ্চপদে আসীন রয়েছেন। এমনকি এমপি-মন্ত্রীও হচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর বার্মা বা মিয়ানমার এখনো পেছন দিকে হাঁটছে। সে দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে, ‘বর্মীর জন্য বার্মা’। দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের সরকারপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদী একটি গ্রুপ সে দেশের আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের দাবি ছিল ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি যেন আর ব্যবহূত না হয়। কারণ ‘এই নামে তাদের দেশে কোনো জাতিগোষ্ঠী নেই। তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। তারা বাঙালি এবং সন্ত্রাসী। তাদের অধিকাংশই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় থেকে সেদেশে অবৈধভাবে বসবাস শুরু করেছে। ’ আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের কথা কতটুকু বিশ্বাস করেছেন জানি না, তবে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম তাদের কথায় সায় দেয়নি। এই জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়েই সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে বর্মী নেত্রী অং সান সু চি এখন সরকারপ্রধান। শুরু থেকেই তার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে উগ্রপন্থিদের প্রভাব। ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ বলে খ্যাত মুসলিমবিদ্বেষী বৌদ্ধ ভিক্ষু অশিন উইরাথু সেনাবাহিনী ও তার সরকারের মদদপুষ্ট। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের পশ্চাতে রয়েছে এই ভিক্ষুর বিরাট অবদান। গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো সু চি মুখ খুললেন। কিন্তু তার বক্তব্য ছিল সত্যের অপলাপ। তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি। এতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, জাতীয়তাবাদের নাম করে তিনি রোহিঙ্গা নিধন ও বহিষ্কারের এক জঘন্য খেলায় মত্ত। একজন পরিপক্ব রাষ্ট্রনায়ক কখনো আগুন নিয়ে সর্বনাশী খেলা খেলে না। মানবতার জন্য উচ্চশিক্ষিত এই নেত্রী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তাকে কে বোঝাবে যে, জাতীয়তাবাদ ভালো, তবে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিপজ্জনক? গত ২৫ জুলাইয়ের পর থেকে উন্মাদপ্রায়, বর্বর ও সাম্প্রদায়িক  বর্মী সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে লাখো রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আজ রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গারা বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর শীর্ষে। অনেকেই বর্মী সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত এই রোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের নায়ক সেনাপ্রধান মিন অং হ্লায়াংকে পাকিস্তানি সেনা জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) টিক্কা খানের নৃশংসতার কাহিনী স্মৃতিচারণ করলে এখনো বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। তখন এক কোটি বাঙালি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালিরা স্বদেশে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটি ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেহাতই মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। বলেছেন, প্রয়োজন হলে খবার ভাগ করে খাব। তার এই উদারতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন হলো : রোহিঙ্গারা কি বাঙালি? অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। ‘কুরুখ’ নামে অস্ট্রিক জাতির একটি শাখা পূর্ব ভারত থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে রাখাইন প্রদেশে বসতি স্থাপন করে। এরপর ক্রমান্বয়ে বঙ্গপোসাগরের উপকূলে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে বাঙালি, পারসীয়, তুর্কি, মুঘল, আরব ও পাঠান। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, মংডু, কিওকতাও, মামব্রা, পাত্তরকিলা, কাইউকপাইড, পুণ্যাগুন ও পাউকতাই এলাকা এদের মূল আস্তানা। আরাকান রাজ্যের ভাষার নামও রোহিঙ্গা।   এরা বাংলা বলতেও পারে না, লিখতেও পারে না। তবে চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার কিছুটা প্রভাব রয়েছে তাদের কথাবার্তায়। তারা প্রচুর উর্দু, আরবি ও হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেন। আমি দেশে এবং বিদেশে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আমার কথা বুঝতে পারেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বার্মার দক্ষিণে বাস করত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ‘মগ’ এবং উত্তরে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ‘রোহিঙ্গা’ সম্প্রদায়। তবে আরাকান প্রদেশের মালভূমিতে ‘রাখাইন’ ও সমতলে ‘রোহিঙ্গা’ জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত। মঙ্গোলীয় মগ ও রাখাইনদের একটি অংশ জলদস্যু ছিল। এক পর্যায়ে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজার ও পটুয়াখালী অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এখনো আছে। মধ্যযুগে স্বাধীন রাখাইনকে ‘রোসাং’ বা ‘রোসাঙ্গ’ বলা হতো। রোসাং থেকেই সম্ভবত রোহাঙ্গা বা রোহিঙ্গার উৎপত্তি। তখন মুসলমানগণ এই রাজ্য শাসন করতেন। ফলে রাজভাষা ছিল ফার্সি। তবে বাংলাও সমভাবে সমাদৃত হতো। বাংলা কবি আলাউলসহ অনেকেই রোসাং রাজ্যের রাজকবির মর্যাদা লাভ করেছিলেন। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করেন ১৭৮৪ সালে। তার পর থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। বর্মীদের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধের (১৮২৫, ১৮৫২ ও ১৮৮৫) পর ১৮৮৬ সালে ইংরেজরা বার্মায় কলোনি স্থাপন করে। তারা বার্মাকে ভারতের অংশ হিসেবে শাসন করে ১৯১৯ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। ওই বছর থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বার্মা ছিল ব্রিটেনের ‘ক্রাউন কলোনি’। বিদায়ের আগে ইংরেজরা বার্মার ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করে। রোহিঙ্গার নাম সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটি ছিল বার্মায় অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান রাখার লক্ষ্যে  ব্রিটিশদের একটি রাজনৈতিক চাল। ভারত ছাড়ার আগেও তারা তা করেছিল। সীমান্ত ভাগাভাগির নামে পাঞ্জাব ও বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। এর পরিণামে পাঞ্জাবের হিন্দু-মুসলিম সহিংসতায় ১০ লাখ লোক তাদের গন্তব্যে (পাকিস্তান বা ভারত) পৌঁছতে পারেননি, পথিমধ্যেই কচুকাটা হয়েছিলেন। এই অদূরদর্শী ভাগবাটোয়ারার ফলে কলকাতা চিরদিনের জন্য আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল এবং সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমাসহ কয়েকটি থানা চলে গেল ভারতে। বার্মায় অশান্তির যে বীজ ব্রিটিশরা বপন করে গিয়েছিল কালান্তরে তাই এক আন্তর্জাতিক মানবিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বার্মায় বসবাস করার পরও রোহিঙ্গারা আজ নিজ দেশেই পরদেশি। বার্মার প্রথম পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর সবকিছু পাল্টে যায়, রাতারাতি রোহিঙ্গারা হয়ে যায় ‘কালা’ ও ‘বিদেশি’। বাহ্যত তখন থেকেই শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অবিচার ও লাঞ্ছনা। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। কক্সবাজারের উখিয়াসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা বাঙালি নই, বার্মাইয়া। আমাদের দেশ বার্মা। সেখানে বাপ-দাদার ভিটে আছে, তাদের কবর আছে। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। ’ কিন্তু কে তাদের দায়ভার গ্রহণ করবে? চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ তো প্রকারান্তরে মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন করছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, তবে তিনি ট্রাম্পের সহায়তা প্রত্যাশা করছেন না। ট্রাম্প নিজেই তো বলেছেন, ‘সবার আগে আমেরিকা’। তার নির্দেশেই কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যেতে পারবে না। ক্ষমতাধর এই দেশগুলো তাদের স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে মিয়ানমারে এসব দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের কাছে মার খেয়ে গেছে বিশ্ব মানবতা। দেশান্তরে যাওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। ইউরোপের ইমিগ্রেন্টরা গড়ে তুলেছেন আধুনিক আমেরিকা। বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন প্রভৃতি দেশে। মুঘলদের বংশধর তো ভারতেই অবস্থান করছেন। তাদের কাউকেই এখন আর তাদের পূর্বপুরুষদের দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। তাই মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, শত শত বছর বার্মায় বসবাস করার পর বর্তমান প্রজন্মের রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই বাঙালি নয়, তারা বর্মী। এককালে বার্মার কয়েকটি শহরে বিদেশিরা গিয়ে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসাবাণিজ্য করেছে, কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর সেই আকর্ষণ আর অবশিষ্ট ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে উগ্র বর্মীরা যে প্রচারণা চালাচ্ছে তাও সত্য নয়। বাংলাদেশ বর্মী রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। তবে সু চির রূপরেখায় তা অসম্ভব। কারণ তিনি ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তিকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ শরণার্থীর তো বৈধ কোনো কাগজপত্রই নেই। বল এখন সু চির কোর্টে। সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, এর সমাধানও তাকেই করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে মানবাধিকার ও নাগরিকত্ব প্রদানের গ্যারান্টি দিয়ে তার সরকারকেই ফেরত নিতে হবে এই জনগোষ্ঠীকে। সারা বিশ্বের নজর এখন সু চির দিকে। তার ফাও বক্তব্যে চিড়ে ভিজবে না, কাজও হবে না। তার যদি কোনো মানবিক গুণাবলী অবশিষ্ট থেকে থাকে তাহলে তাকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব তারই। এখন দেখতে হবে উগ্র জাতীয়তাবাদের বুলি প্রত্যাহার করে তিনি তার কথা রাখেন কি না। 

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও বিশ্লেষক; কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন