আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ইং

যুদ্ধের জন্য ছায়াবাহিনীকে দক্ষভাবে গড়ে তুলেছে ইরান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১৮ ১৮:০৬:২৫

সিলেটভিউ ডেস্ক :: মানববিহীন একটি ইরানি নৌকা বড় বড় ঢেউ ঢেলে ঝড়ো গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এরপর মার্কিন রণতরীতে ধাক্কা দিয়ে কমলা রঙের একটি আগুনের বল ছুড়ে মারল। কুণ্ডলী পাকিয়ে সেটি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

২০১৫ সালে দেশটির বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর ব্যাপক নৌ-যুদ্ধ মহড়ার অংশ ছিল এই দৃশ্য। নকল মার্কিন রণতরীতে হামলা করে যুদ্ধের মহড়া দিয়েছিল ইরানি বাহিনী।-খবর রয়টার্সের

ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েক ডজন স্পিডবোট ও জাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হচ্ছে। হেলিকপ্টারও জড়িত এতে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে কয়েক ঘণ্টা ধরে এই মহড়ার ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, নৌযুদ্ধের এই কৌশল ও দক্ষতা আঞ্চলিক ছায়া বাহিনীর কাছেও ছড়িয়ে দিতে পারে ইরান। গত রোববার আরব আমিরাতের উপকূলে চারটি তেল ট্যাংকারে হামলায় ইরানের ওপর দোষ চাপাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু ইরানি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করতে তাদের শত্রুরা এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ছায়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তি করেনি ইরান।

দেশটি হুশিয়ারি করে বলেছে, তার আঞ্চলিক মিত্রদের কাছে অস্ত্র রয়েছে। ইরানি স্বার্থ হুমকিতে পড়লে তারা শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা দিনে দিনে বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। যার মধ্যে বিমানবাহী রণতরী, বি-৫২ বোমারু বিমান ও প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

মার্কিন বাহিনী ও আঞ্চলিক স্বার্থের ওপর ইরানি হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে নিজের শক্তি প্রদর্শন করতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

বছরখানেক আগে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানি তেল রফতানি সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হয়েছে, যাতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের দাবি, বিশ্ববাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে তারা উত্তোলন বাড়িয়ে দেবে।

গত মাসে বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীকে বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে ইরান যদি তেল রফতানি করতে না পারে তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে বিপ্লবী গার্ডস। বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ তেলের প্রবাহ এই প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়।

ইরানি হুমকি অনুভূত হওয়ায় চলতি সপ্তাহে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ও ইরলিবের কনস্যুলেট থেকে অগুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীদের সরিয়ে নেয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ট্যাংকার হামলায় যদি ইরান কিংবা তার ছায়াবাহিনী জড়িত থাকে, তবে তারা কেন এগুলো সাগরে ডুবিয়ে দেয়নি কিংবা কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা হচ্ছে সতর্কবার্তা।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও সিআইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নরম্যান রুল বলেন, পদক্ষেপগুলো এমনভাবে পরিচালনা করে ইরান যে তা বোঝা গেলেও যুক্তরাষ্ট্র সেই পরিসরে জবাব দেয়ার ন্যায্যতা নির্ধারণ করতে পারছে না। অর্থাৎ ইরান এমনভাবে পদক্ষেপ নেয় যে তা সহজেই অস্বীকার করতে পারে কিন্তু দেশটির ওপর দোষ চাপানোও সম্ভব।

তিনি বলেন, তেল ট্যাংকার হামলার ঘটনায় ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। তেলের দাম বৃদ্ধি সাময়িক হলেও তা চীন ও পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

ইরানের বিশ্বাস এতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়াতে বাধ্য হবে চীন ও ইউরোপ, যাতে ভবিষ্যতে এমন হামলা থেকে বাঁচতে ইরানকে ছাড় দেয়া হয়।

ট্যাংকার হামলার দুদিন পরে বুধবার সৌদি আরমাকো কোম্পানির দুটি পাম্পিং স্টেশনে সশস্ত্র ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম চার শতাংশ বেড়ে গেছে।

আরব আমিরাত বলছে, তেল ট্যাংকারে নাশকতামূলক হামলার ঘটনায় একটি তদন্ত চলছে। ইরানের আচরণের কারণে আঞ্চলিক সংকট কমিয়ে আনতে দেশটি চেষ্টা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তেল পাইপলাইনে ড্রোন হামলার জন্য ইরানকে নির্দেশদাতা হিসেবে দোষী করছে সৌদি আরব। ইরানঘেঁষা হুতি বিদ্রোহীরা ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে। গত চার বছর ধরে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে হুতিরা।

সামরিক ও গোয়েন্দা বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আমিরাত উপকূলে ট্যাংকার হামলায় যে কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, তা আধুনিক না। একদল ডুবুরির বসানো ভাসমান কিংবা চৌম্বুক মাইনের মাধ্যমে জাহাজে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ইসলামি বিপ্লবের আগে ও পরে ইরানি নৌবাহিনীতে ১৮ বছর কাজ করা সামরিক বিশ্লেষক হোসেইন আরিয়ান বলেন, ইরানের অভিজ্ঞ নৌশক্তি রয়েছে, যারা এ ধরনের হামলা চালাতে সক্ষম। কিংবা স্থানীয় ছায়া বাহিনীর মাধ্যমেও তারা এমনটা ঘটাতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের হামলার ব্যাপক মহড়া দিয়েছি। এটা স্বাভাবিক হামলা। লিমপিট মাইন বা জাহাজের বিস্ফোরক লাগিয়েও এমন অভিযান চালানো সম্ভব। কাজেই ইরানি নৌবাহিনীর এমন দক্ষতা রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব কিংবা গুরুত্বপূর্ণ লোক পাঠিয়ে স্থানীয়দের সাহায্যে তারা এমন কাজ করতে পারেন। এটা হচ্ছে সফট টার্গেট।

এছাড়া মানববিহীন নৌকা দিয়েও জাহাজে হামলা চালাতে পারে ইরান, চার বছর আগে যেটার মহড়া দিয়েছে তারা।

ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের এক কর্মকর্তা বলছেন, মিত্র সামরিক বাহিনীর কাছে নিজেদের মানববিহীন নৌ ও ড্রোন অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিচ্ছে ইরান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক ওই কর্মকর্তা বলেন, লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলনের অর্ধশত গেরিলা ইরান থেকে প্রশিক্ষিত। এছাড়া হুতি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী।

সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র জানায়, হুতি যোদ্ধারা সাগরে নৌকা থেকে ড্রোন হামলা চালাতে পারে। তবে ইয়েমেন যুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখছে না বলে জানিয়েছে ইরান।

পারস্য উপসাগরে ইরান ও মার্কিন উত্তেজনা নতুন কিছু না। জাহাজ রুটে ইরানের বিরুদ্ধে মাইন ব্যবহারের অভিযোগ তোলার পর আশির দশকের শেষ দিকে মার্কিন ও ইরানি নৌবাহিনীর সংঘাত হয়েছে।

এরপর থেকে উপসাগরে নিয়মিত সামরিক মহড়া ও অভিযানের মাধ্যমে নিজেদের নৌশক্তি প্রদর্শন করে আসছে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী।

২০০৪ ও ২০০৭ সালে ব্রিটিশ সেনা সদস্যদের আটক করেছে বিপ্লবী গার্ডস। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ১০ মার্কিন নাবিক ইরানি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পারস্য উপসাগরের বাইরে গিয়ে অভিযান চালাচ্ছে বিপ্লবী গার্ডস। ফারস নিউজকে গার্ডসের কমান্ডার বলেছেন, ২০১২ সালে এডেন উপসাগরে চার মাস ধরে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে বিপ্লবী গার্ডসের বিশেষ বাহিনী।

ইরানের সামরিক বাহিনী যেসব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে, নৌযুদ্ধে তারা নিজেদের দক্ষতা ভালোভাবেই দেখাতে পারছে।

২০০৬ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটির যুদ্ধজাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে চার নাবিককে হত্যা করেছে হিজবুল্লাহ আন্দোলন।

গত বছর সৌদি তেল ট্যাংকারে কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। এতে বাব-এল মানদেব প্রণালীতে সৌদি তেল রফতানি সাময়িক স্থগিত হয়ে পড়েছিল।

বৃহস্পতিবার হিজবুল্লাহপন্থী পত্রিকা আল-আখবারের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহীম আল আমিন লিখেছেন, ইরান-মার্কিন চলমান উত্তেজনা যদি প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নেয়, তবে ইরানের শত্রু-মিত্র সবাই এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননের মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা পাবে ইরান। কাজেই এক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই কিংবা হামলার প্রকৃত ধরন নিয়ে কেউ জানেন না, এমন ভান করার সুযোগ নেই। এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে হিজবুল্লাহ।



সৌজন্যে : যুগান্তর

সিলেটভিউ ২৪ডটকম/১৮ মে ২০১৯/গআচ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন