আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সত্যিই কি বাজারে আসছে ভারতের করোনা ভ্যাকসিন? যা বললেন বিশেষজ্ঞরা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৭-০৪ ১৩:৪৯:২৭

সিলেটভিউ ডেস্ক :: হায়দরাবাদের সংস্থা ভারত বায়োটেক ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ‘কোভ্যাকসিন’ নামক টিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ‘ত্বরান্বিত’ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ।

কাউন্সিলের প্রধান ডা. বলরাম ভার্গব শুক্রবার সমস্ত পরীক্ষাকেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে জানান, আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে এই ভ্যাকসিনের সমস্ত চিকিৎসা-সম্বন্ধীয় পরীক্ষা, যাতে সেদিনই এটির বাজারে আনা যায় বা প্রকাশ্য উদ্বোধন করা যায়।

তবে ‘বায়োএথিকস’ অথবা ‘জীবনীতিশাস্ত্র’ বিশারদরা এই সময়সীমা সম্পর্কে সন্দিহান। তাদের মূল প্রশ্ন, যেখানে এখনও মানবদেহে শুরুই হতে পারল না এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ, সেখানে একমাসের মধ্যে কীভাবে সম্ভব হবে সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা বিচার করতে তিন তিনটি ধাপ পেরোনো? বিশেষ করে যেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বছর শেষের আগে তাদের ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়তে পারবে না বলে জানিয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক স্তরে যেখানে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষার কাজ।
কোভ্যাকসিন কী?

অল্প কথায় বলতে গেলে, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ভ্যাকসিন, যা প্রস্তুত করছে ভারত বায়োটেক।

আইসিএমআর-এর অধীনস্থ ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজির সঙ্গে যৌথভাবে প্রস্তুত হচ্ছে এই ভ্যাকসিন। কোনও এক উপসর্গবিহীন করোনা রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত করোনাভাইরাসের একটি স্ট্রেইন পৃথক করে নিয়ে মে মাসের গোড়ার দিকে বিবিআইএল-এর কাছে পাঠিয়ে দেয় এনআইভি। এই স্ট্রেইন ব্যবহার করে হায়দরাবাদে তাদের অতি সুরক্ষিত গবেষণাগারে একটি “নিষ্ক্রিয়” ভ্যাকসিন – অর্থাৎ যা মৃত ভাইরাস থেকে তৈরি – প্রস্তুত করে বিবিআইএল।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, “মানবদেহে প্রবেশ করানোর পর সংক্রমণ বা অনুকরণের ক্ষমতা থাকে না এই ভ্যাকসিনের, যেহেতু এটি মৃত ভাইরাস। দেহের ইমিউন সিস্টেমের কাছে এটি মৃত ভাইরাস হিসেবেই গণ্য হয়, তবে ভাইরাস-বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে অ্যান্টিবডি।” সঙ্গে আরও জানানো হয় যে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার রেকর্ড সাধারণভাবে প্রমাণিত।

কবে কোভ্যাকসিন বাজারে ছাড়তে চায় আইসিএমআর?
আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যেই জনগণের ব্যবহারের জন্য এই ভ্যাকসিন জনসমক্ষে আনতে চায় আইসিএমআর, যে কারণে সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাকেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন ডা. ভার্গব। চিঠিতে তিনি যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হল, “সমস্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করে ১৫ আগস্ট, ২০২০ এর মধ্যে জনস্বাস্থ্যের খাতিরে এই ভ্যাকসিন বাজারে আনার কথা ভাবা হয়েছে। সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে পুরোদমে এগোচ্ছে বিবিআইএল, যদিও সম্পূর্ণ ফলাফল নির্ভর করবে সমস্ত পরীক্ষাকেন্দ্রের সহযোগিতার ওপর।”

তিনি আরও লিখেছেন, “এটি ভারতে প্রস্তুত প্রথম দেশজ ভ্যাকসিন, এবং সরকারের উচ্চতম স্তরে এই  প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এর ওপর নজর রাখা হয়েছে।”

সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, কোনওরকম অসহযোগিতা হলে বিষয়টি “গুরুত্ব” সহকারে নেওয়া হবে।

বর্তমানে পরীক্ষার কোন স্তরে রয়েছে কোভ্যাকসিন?

ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল, যার আওতায় পড়ে কেন্দ্রীয় ঔষধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন, এখন পর্যন্ত বিবিআইএল-কে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল-এর অনুমোদন দিয়েছে।

১ জুলাই এই দুই স্তরের ট্রায়ালের জন্য তাদের ভ্যাকসিন নথিভুক্ত করে বিবিআইএল। ভারতের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রির খাতায় ট্রায়ালের বিশদ পড়লে জানা যায়, এই দুই ধাপে মোট ১ হাজার ১২৫ জনের ওপর প্রয়োগ করা হবে এই ভ্যাকসিন এবং ১৩ জুলাই শুরু হবে ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তালিকা গঠন।

রেজিস্ট্রির নথি অনুযায়ী, বিবিআইএল মনে করছে, ট্রায়ালের এই দুই ধাপ সারতে সময় লাগবে এক বছর তিন মাস। স্রেফ প্রথম ধাপের ট্রায়ালেই সময় লাগবে অন্তত এক মাস। মনে করা হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ২৮ দিনের মাথায় সিডিএসসিও-এর কাছে ট্রায়ালের প্রথম ধাপের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেবে বিবিআইএল।

“শেষমেশ লক্ষ্য হল একটি নিরাপদ, সর্বজনগ্রাহ্য, ইমিউনোজেনিক ইন্ট্রামাসকুলার ভ্যাকসিন নির্বাচন করা, যার পরবর্তী মূল্যায়ন করা হবে দ্বিতীয় ধাপের গবেষণায়,” বলা হয়েছে রেজিস্ট্রিতে।

তা কি আদৌ সম্ভব?
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই দেড় মাসের মধ্যে তিনটি ধাপের পরীক্ষা সম্পন্ন করার ব্যাপারে সন্দিহান। বায়োএথিকস অ্যান্ড হেলথ পলিসির গ্লোবাল হেলথ বিভাগের গবেষক ডা. অনন্ত ভান বলছেন, “এমনটা হলে খুবই অবাক হব। দুনিয়ার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্থাগুলো, যাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষানিরীক্ষা আরও অনেকটা এগিয়েছে, তারাও আরও অনেক বেশি সময় হাতে রেখেছে। এখানে সবেমাত্র প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হচ্ছে, সুতরাং সম্ভাবনা কম বলেই বোধ হয়।”

ডা. ভান আরও বলছেন, নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এই সময়সীমা বিপজ্জনক রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

তার কথায়, “এটা ধরে নেওয়া যে প্রথম দুই ধাপের পর এমন তথ্য পাওয়া যাবে, যার ভিত্তিতে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করা যাবে, এবং ১৫ আগস্টের মধ্যে সব ট্রায়াল শেষ করে ভ্যাকসিনটিকে প্রকাশ্যে আনা যাবে, আইসিএমআর-এর কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত।”

ডা. ভান আরও বলেন, “১৫ আগস্টের মধ্যে নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা সংক্রান্ত তথ্য সমেত সব ট্রায়ালের ফলাফল হাতে আসাই দুষ্কর। এখানে অজস্র প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।”

ভারত এবং পৃথিবীর অন্যত্র কোভিড-১৯ এর কোন কোন ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চলছে? তাদের সময়সীমাই বা কী?

বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে একশ'টিরও বেশি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চলছে বিভিন্ন স্তরে। ইতিমধ্যেই তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন, তবে সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক চললেও বছরের শেষেই প্রস্তুত হতে পারবে ভ্যাকসিন।

জার্মানির বায়োএনটেক-এর সহযোগিতায় ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কম এবং মাঝারি ডোজে মানবদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের কাজ শুরু করেছে ফাইজার। ফাইজার-এর আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রেসিডেন্ট মিকায়েল ডোলস্টেন সম্প্রতি জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ধাপের আরও একটি পর্যায়, অথবা তৃতীয় ধাপের জন্য চলতি মাসে কাজ শুরু হবে, যার জন্য প্রয়োজনীয় রোগী সংগ্রহ করা হবে আগস্টের শেষ বা সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। অক্টোবরের শেষের দিকে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে পারে ফাইজার। এক্ষেত্রেও বছর শেষের আগে বাজার আসার বিষয়টি আশা করা যাচ্ছে না।

গত ৩০ জুন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের উদ্দেশে একটি ২৪ পাতার নির্দেশিকা জারি করে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। এই নির্দেশিকায় কোনও সময়সীমার উল্লেখ নেই, তবে এক বিশ্লেষকের মতে, সংশোধিত নির্দেশিকা জারি করার অর্থ হল আগামী বছরের আগে কোনও ভ্যাকসিন বাজারে আসার সম্ভাবনা নেই।

এসভিবি লেয়ারিঙ্ক সংস্থার বিশ্লেষক জেফরি পোর্জেস ১ জুলাই একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেন, “এফডিএ যা বলছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে, কোনও ভ্যাকসিন অনুমোদিত হওয়ার আগে প্রয়োজন কয়েক হাজার নিরাপত্তা বিষয়ক খুঁটিনাটি, অন্তত ছয় মাসের পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত কার্যকারিতার নিশ্চয়তা। যেসব প্রস্তুতকারক দাবি করছেন এই বছরের মধ্যেই বাজারে ভ্যাকসিন ছাড়তে পারবেন, তাদের দাবির সঙ্গে এই নির্দেশিকার সামঞ্জস্য নেই।”

ভারতে বিবিআইএল ছাড়াও শুক্রবার জাইডাস-ক্যাডিলা সংস্থা ঘোষণা করে যে তারা জীবজন্তু ছেড়ে এবারে মানবদেহে ভ্যাকসিন পরীক্ষা করার অনুমতি পেয়েছে সিডিএসসিও-এর পক্ষ থেকে। চলতি মাসেই তাদেরও ট্রায়াল শুরু হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৪ জুলাই ২০২০/ডেস্ক/মিআচৌ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন