আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

ডা. দেবী শেঠির কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে যায় না কোনো ‘গরিব’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-০৯ ২২:৩৭:৩১

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ডা. দেবী শেঠিকে বলা হয় বাইপাসওয়ালা বাবা। তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোকে তারা মনে করেন এক একটি আশ্রম।

ভারতের নিম্ন আয়ের অনেক নাগরিক মনে করেন, দেবী শেঠির হাসপাতালে গেলে হৃদরোগে আক্রান্ত কেউ চিকিৎসা ছাড়া ঘরে ফেরেন না। ধনী, মধ্যবিত্ত কিংবা একেবারে নিতান্ত কৃষক সবার দুয়ার খেলা দেবী শেঠির হাসপাতালে। ধনীদের চিকিৎসক সে তো সোজা ব্যাপার, পয়সা দিবেন চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু দেবী শেঠি কি করে হয়ে উঠলেন কৃষক পরিবার কিংবা মধ্যবিত্তের চিকিৎসক? এমন প্রশ্নের উত্তর জানা যায় দেবী শেঠির সাক্ষাৎকারে। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বিবিসি’র হার্ডটক অনুষ্ঠানে তিনি জানান সহজলভ্য চিকিৎসার আদ্যোপান্ত। যেখানে সেবা ও ব্যবসা হেঁটেছে একে-অপরের হাত ধরে। জীবনের শুরুর দিকে দেবী শেঠি ছিলেন মাদার তেরেসার চিকিৎসক।

মাদার তেরেসার সঙ্গে কাটানো প্রায় ছয়বছর সময় তার জীবনবোধ বদলে দেয়। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেবী শেঠি বলেন, চিকিৎসা পদ্ধতি আধুনিক করে তেমন ফল নেই, যদি না সেই পদ্ধতি সাধারণের কাছে সহজলভ্য করা যায়। চিকিৎসাকে সাধারণের দুয়ারে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা থেকেই জন্ম হয় নারায়ণা হেলথের। নব্বইয়ের দশকে কলকাতার বিড়লা হার্ট ফাউন্ডেশনে কাজ করার সময় অসংখ্য হৃদরোগী পেতেন, যাদের অধিকাংশেরই অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করতেন এমন রোগীদের বেশির ভাগই অস্ত্রোপচারের জন্য আর ফিরে আসতেন না। রোগীদের চিকিৎসার জন্য ফিরে না আসা শেঠির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। চিকিৎসার জন্য এসব রোগীকে হয় টাকা ধার নিতে হয়, অথবা বিক্রি করতে হয় তাদের সম্পত্তি। এমন অবস্থায় অধিকাংশ মানুষই যে, ব্যয়বহুল চিকিৎসাকে এড়িয়ে যেতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই ভারতে প্রতিবছর যেখানে গড়ে ২০ লাখ সার্জারির দরকার পড়তো, সেখানে সার্জারি হতো মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার। ডা. শেঠী বুঝলেন, অবস্থার উন্নতি করতে হলে সার্জারির খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নেই।

বিদেশি প্রযুক্তি আর দেশের সেবার মিশেলে তিনি গড়ে তুলতে চাইলেন এক অনবদ্য প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে মানের বিষয়ে কোনো আপস করবেন না বলেও মনস্থির করেছিলেন ডা. দেবী শেঠি। সেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যবসাকেও এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কারণ, শুধু দানে কোনো উদ্যোগে সামনে টেনে নেয়া যায় না। এমন ভাবনা থেকে দেবী শেঠি দাঁড় করান আদর্শ ব্যবসার মডেল। তিনি মনে করেন, দানশীলতার মাধ্যমে যত মানুষের সাহায্য করা সম্ভব, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের সাহায্য করা সম্ভব একটি আদর্শ প্রক্রিয়ার ব্যবসার মাধ্যমে। এছাড়া ব্যবসার পরিধি ধীরে ধীরে বাড়বে, দানশীলতার নয়। এ উদ্দেশ্যেই তিনি ২০০১ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে ‘নারায়ণা হেলথ’ প্রতিষ্ঠা করেন। একটি ২২৫ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করা নারায়ণা হেলথ এখন ২৩টি হাসপাতাল, ৭টি হার্ট সেন্টার ও ১৯টি প্রাথমিক সেবা কেন্দ্রের এক বিশাল নেটওয়ার্ক, রয়েছে ছয় হাজারেরও অধিক শয্যা। এ পর্যন্ত নারায়ণা হাসপাতালে লক্ষাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক রোগীই ছিল দরিদ্র, যাদের কেউ স্বল্পমূল্যে, কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন। নারায়ণা হাসপাতাল এটি সম্ভবপর করেছে সার্জারির ব্যয় কমানোর মাধ্যমে। দেড় লাখ থেকে এ খরচ তারা কমিয়ে এনেছেন ৬০-৬৫ হাজার রুপিতে।

ডলারের হিসাবে যা মাত্র ৮০০ ডলার, যেখানে এ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রে ১,৪৪,০০০, মেক্সিকোতে ২৭,০০০ ও কলাম্বিয়ায় ১৪,৮০০ ডলার। নারায়ণা হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসার এত কম খরচের প্রধান কারণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। হাসপাতালটির অপারেশন কক্ষে একজন রোগীকে অস্ত্রোপচারের পর সেলাই করা হচ্ছে, পাশের কক্ষে গিয়ে দেখা যাবে অন্য একজনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে অস্ত্রোপচারের জন্য। এভাবে একই বিশেষজ্ঞ ও সহকারী চিকিৎসকদের কাজে লাগিয়ে পাঁচজন রোগীর অপারেশন করা হয় একই সঙ্গে। একজন ডাক্তার বা নার্স একই কাজ করে থাকেন সকল রোগীর ক্ষেত্রে। ডা. শেঠির এমন চিকিৎসা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সময় সংক্ষেপ করা। বিশেষজ্ঞ সার্জনের সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের সময়ের যথাযথ ব্যবহার করা হয় এমন পদ্ধতিতে। সাধারণত যা হয়, একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন ও অন্য সকল ডাক্তার নার্সরা উপস্থিত থেকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু এসব কাজের অনেকগুলো অংশ অন্যান্য ডাক্তার বা নার্সরা, সার্জনের পুরোটা সময় এক্ষেত্রে ব্যয় করার খুব একটা প্রয়োজন নেই। ডা. শেঠি তাই এ প্রক্রিয়া শুরু করলেন, অন্যান্য ডাক্তার নার্সরা একজন রোগীকে সার্জারির জন্য সম্পূর্ণ তৈরি করে রাখেন, এরপর তিনি এসে কেবল মূল কাজটি করেন।

তার কাজ শেষ হতে হতে আবার অন্য একজন রোগী প্রস্তুত হয়ে পড়ে, আর এ রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচারের পরের ধাপের জন্য। ভারতে যেখানে অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে দিনে গড়ে মাত্র চার-পাঁচটি অস্ত্রোপচার করা হয়, সেখানে দেবী শেঠির হাসপাতালে এ সংখ্যা ত্রিশেরও অধিক। এ সময়ের সাশ্রয়ই অস্ত্রোপচারের ব্যয় কমিয়ে আনে। এছাড়া এতে অন্য একটি সুবিধাও আছে। যেহেতু একজন নার্স ও ডাক্তার কেবল একটি কাজই করেন, তাই তারা ঐ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কোনো সমস্যা হলে তারা দ্রুত টের পান। এছাড়া নারায়ণা হাসপাতাল থেকে কখনো কাউকে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ফিরে যেতে হয় না। তারা অনেক দরিদ্র মানুষকে স্বল্পমূল্যে সেবা দিয়ে থাকেন। তবে এটি কোনো দান হিসেবে করেন না তারা। এ ব্যয় বহন করতে তারা ‘ভর্তুকি মডেল’ অনুসরণ করেন। ধনী ব্যক্তিরা দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি দেন, ধনীরা এজন্যে হয়তো বিলাসবহুল কক্ষ কিংবা এ ধরনের অতিরিক্ত কিছু সুবিধা পান। কিন্তু মূল চিকিৎসার মান সকলের জন্যই বিশ্বমানের বলে জানান ডা. দেবী শেঠি। মাগুরার তানজেল হোসেন খান ও কামরুল লায়লা জলি দম্পতি দু’বছর হলো চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণা হেলথে।

তাদের ছেলে রিফাত খান জানিয়েছেন সেখানকার এমন চিকিৎসা পদ্ধতি ও হাসপাতালের বর্ণনা। তিনি বলেন, হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই মন চাঙ্গা হয়ে যায়। একই ছাদের নিজে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও গুরুদুয়ারা। যে যার মত প্রার্থনা করার অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে মন সত্যি জুড়িয়ে যায়। মূল ভবনে ঢুকতেই একদম মুখোমুখি শ্রী শ্রী ভিরুপতি মন্দির ও সামনের পানিতে রাশি রাশি ফুল। নারায়ণার রোগীরা হিন্দি বা ইংরেজি বলতে না পারলেও দোভাষীদের আন্তরিকতায় মুহূর্তের সব টেনশন গায়েব। ভাষা সমস্যা একদমই নেই। নারায়ণায় চিকিৎসা নিতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি শুধু বাংলা জানলেও সেবা পেতে খুব একটা সমস্যা হয় না। আর চিকিৎসক তারা তো আরও আন্তরিক। সেবা আর মানবতার এক নাম নারায়ণা হাসপাতাল। ১৯৫৩ সালের ৮ই মে দেবী শেঠি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের দক্ষিণ কনাডা জেলার কিন্নিগলি গ্রামে জন্ম নেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম শেঠি পঞ্চম গ্রেডে পড়ার সময় কার্ডিয়াক সার্জন হওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। সে সময়ে প্রথমবারের মতো হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ঘটনা থেকে নিজেকে হৃদরোগের সার্জন হিসেবে দেখবার আকুল আগ্রহ ছিল দেবী শেঠির।

পঞ্চম গ্রেডে পড়ুয়া শেঠি ১৯৯১ সালে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নয়দিন বয়সী এক শিশুর হৃৎপিণ্ড অপারেশন করেন। এরপর প্রায় চল্লিশ বছরের সার্জারি জীবনে তিনি প্রায় ১৫,০০০ এর বেশি কার্ডিয়াক সার্জারি করেছেন। দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেয়া দেবী শেঠি ১৯৮২ কস্তুরবা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করেন। পরে ইংল্যান্ড থেকে সার্জারি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ১৯৮৯ সালে লন্ডনের উচ্চাভিলাষী চাকরির লোভ ত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ডা. রায়ের সঙ্গে কলকাতায় গড়ে তোলেন ভারতের প্রথম হৃদরোগ চিকিৎসা হাসপাতাল বিএম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টার। ২০০১ সালে ব্যাঙ্গালোরে গড়ে তোলেন নারায়ণা হেলথ নামে এক আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে কম খরচে হৃদরোগের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা দেয়া শুরু হয়। চিকিৎসা সেবার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০০৪ সালে পদ্মশ্রী ও ২০১২ সালে পদ্মভূষণ পদক পান। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা. দেবী শেঠি বলেন, চিকিৎসক জীবনে আমার সব থেকে কষ্টের মুহূর্ত হলো মানুষের জীবনকে টাকার নিক্তিতে মাপা। একটি বাচ্চার হৃদযন্ত্রে ফুটো আছে, আমি তার মা’কে বললাম অপারেশন করলে ভালো হয়ে যাবে।

মায়ের প্রথম প্রশ্ন কত টাকা লাগবে? আমি মনে করি চিকিৎসক হিসেবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের জীবনকে প্রাইস ট্যাগ বন্দি করে ফেলি। অথচ ওই শিশুর পরিবারের ন্যূনতম ৬০ হাজার রুপি দিয়ে অপারেশন করারও সামর্থ্য থাকে না। তাদের কাছে জীবন তখন মাত্র ক’টা রুপিতে বন্দি হয়ে যায়। আমি আমার চিকিৎসক জীবনে সব সময় চেয়েছি জীবনকে প্রাইস ট্যাগের বাইরে নিয়ে আসতে। চিকিৎসা পদ্ধতিকে সাধারণের কাছে আরও সহজলভ্য করতে চেয়েছি। এজন্য অবশ্য রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের সহায়তা করছে। আমরা ছোট করে হলেও একটি স্বাস্থ্যবীমা করতে পেরেছি। কৃষকদের প্রতিদিনের জমানো ৫ রুপি থেকে তারা অনেকে এখন সেবা পাচ্ছে। আমি চাই, মানুষের জীবন হবে অর্থের ঊর্ধ্বে, যেখানে রুপি কিংবা ডলারে বন্দি থাকবে না চিকিৎসা।


সিলেটভিউ ২৪ডটকম/৯মার্চ ২০১৯/গআচ

সৌজন্যেঃসময়২৪

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন