Sylhet View 24 PRINT

২৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরী হত্যার বিচার হয়নি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১৬ ১৩:১২:১৯

কাউসার চৌধুরী :: দীর্ঘ ২৩ বছরেও জগন্নাথপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। ১৫ বছরে ১৮ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এরপরও ঘোষণা করা হয়নি মামলার রায়। এ অবস্থায় নিহতের সহোদর এ্যাটর্নী জেনারেলের নিকট আবেদন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন। আর মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, যুগের পর যুগ অতিবাহিত হবার পরও আলোচিত এই মামলার বিচার শেষ না হওয়াটা দুঃখজনক। তবে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট সোহেল আহমদ জানান, মামলার আগামী ধার্য্য তারিখেই রায় ঘোষণা করা হবে। সুনামগঞ্জের পিপি এডভোকেট ড. খায়রুল কবির রুমেনও একই তথ্য জানিয়েছেন।


সাক্ষ্য গ্রহণের ৫ বছর অতিবাহিত
বহুল আলোচিত এই মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জের আদালতে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এর প্রায় দু’বছর পর ১৯৯৯ সালের ৯ মার্চ শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেন আদালত। অভিযোগপত্রে মামলার সাক্ষীর সংখ্যা ৪০ জন। ১৫ বছরে আদালতে ১৮ সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য গ্রহণের পর মামলার যুক্তিতর্ক শেষে গত বছরের ফেব্রুয়ারীতে রায় ঘোষণার জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এরপর চলে গেছে প্রায় ১৪ মাস। কিন্তু এখনো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়নি। আদালত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২৭ মে মামলার ধার্য্য তারিখ রয়েছে। ঐদিন রায় ঘোষণা করা হতে পারে। সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বর্তমানে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপি এডভোকেট সোহেল আহমদ জানিয়েছেন।


প্রধান আসামী লিয়াকতসহ ৩ জন পলাতক
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার প্রায় ৬ মাস পর ১৯৯৬ সালের ১১ জুন ২৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। জগন্নাথপুর থানার তৎকালীন ওসি হুমায়ুন কবির সরকার ও সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম মজুমদার তদন্ত শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩০২/১০৯ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্র নং ৩৬। অভিযোগপত্র দেয়ার পর এ পর্যন্ত মামলার ৪ নং আসামী জালাল, ৭ নং আসামী করম আলী, ১১ নং আসামী ওয়াজিদ উল্লা, ১৩ নং আসামী আব্দুল হাসিম, ১৬ নং আসামী রফিক মারা গেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া মামলার প্রধান আসামী লিয়াকত আলী, রিপন ও শাহীন মিয়া দীর্ঘদিন ধরে পলাতক রয়েছে। মূল ঘাতক লিয়াকতের অবস্থানের ব্যাপারে আইন শৃংখলা বাহিনীর নিকট কোনো তথ্য নেই। বাকী আসামীরা জামিনে রয়েছেন।


ফিরে দেখা ৭ জানুয়ারী ১৯৯৬
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ৭ জানুয়ারী দুপুরে জগন্নাথপুর উপজেলার গাদিয়ালা নদীর পশ্চিম পাড়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চুকে (৪২) কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত বাচ্চু পার্শ্ববর্তী বেতাউকা গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরীর ২য় পুত্র। তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সাহসী রাজনীতিক মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। নিজ বাড়ীর অদূরে এভাবে খুন হবেন তিনি তা যেন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই আব্দুল মুকিত চৌধুরী লেবু মিয়া বাদী হয়ে পরদিন ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে জগন্নাথপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১। মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘লিয়াকত আলী, আব্দুল হক, রিপন, জালাল, ছাদ আলী, আব্দুল কাইয়ুমসহ আরো ৫-৬ জন মিলে দৌড়াইয়া এনে ঘটনাস্থলে বাচ্চু চৌধুরীকে ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই বাচ্চু চৌধুরীকে হত্যা করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। বাচ্চু চৌধুরীর লাইসেন্সকৃত বন্দুক দেহরক্ষী করম আলীর নিকট থাকলেও করম আলী বন্দুক নিয়ে চলে যায়। ফলে কোনো ধরণের বাধা ছাড়াই সন্ত্রাসীরা নির্বিঘেœ মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরীকে হত্যা করে। লোকমুখে দ্রুত প্রচার হয়ে যায় কমান্ডার বাচ্চু চৌধুরী হত্যাকান্ড। ঘটনাস্থলে মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ হাজার হাজার মানুষ ছুটে যান। কেবল জগন্নাথপুরই নয় বর্বর এই হত্যাকান্ডে পুরো সুনামগঞ্জে ক্ষোভ দেখা দেয়। এলাকায় দেখা দেয় আতংক। জগন্নাথপুর ও সুনামগঞ্জে সর্বদলীয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।


৫নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার
মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫ নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু। জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লাসহ অনেক এলাকায় দাস পার্টির (মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর হাওর এলাকার বিশেষ দল) সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। অদম্য সাহসী বাচ্চু ছুটে যেতেন পাক বাহিনীর খোঁজে। তার অসীম সাহসের কথা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে শোনা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ ‘দাস পার্টির খোঁজে’ গ্রন্থের লেখক হাসান মুরশেদ গ্রন্থটিতে লিখেছেন, দাস পার্টির প্রধান জগৎ জ্যোতি শহীদ হবার পর শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু দাস পার্টিকে কমান্ড করেন। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ কমান্ডার। তিনি লাল বাহিনী নামের আরেকটি বাহিনীরও কমান্ডার ছিলেন।
যুদ্ধকালীন তার অসীম সাহসে ভাটি বাংলায় অনেক ঘর-বাড়ী পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদরদের আগুন ও লুটপাট থেকে রক্ষা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। দুবার জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ভোটে পরাজিত হন। এছাড়াও তিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। জগন্নাথপুরের উন্নয়নে তাঁর ভুমিকা রয়েছে।


মুক্তিযোদ্ধাদের আক্ষেপ
যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও বাচ্চু চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান। মুক্তিযুদ্ধকালীন তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা ও সুনামগঞ্জের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, বাচ্চুসহ আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্যে যুদ্ধ করলাম।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৬ মে ২০১৯/কাচৌ/ইআ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.