আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

প্রয়োজনে ঘরে ঘরে মশারি বাঁধবেন, তাতে দোষ কী?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৭-১৮ ০১:২৭:০৬

সত্যিই মাঝে-সাঝে কিছু কিছু অপ্রীতিকর, অপ্রত্যাশিত ঘটনা অনেক কিছু উল্টাপাল্টা করে দেয়। একেবারে বিনা কারণে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের জন্য তেমন এক চরম নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলক জেএসডি-প্রধান জননেতা আ স ম আবদুর রবের বাড়িতে। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি ও সভা-সমিতি করা প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার। আর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের যখন তখন যেখানে সেখানে দেশের কল্যাণে আলোচনায় বসা সাংবিধানিক অধিকার এবং সেই অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা যে কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। মনে হয় সেই দায়িত্ব থেকে সেদিন সরকার হয়তো অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। ‘হয়তো’ বললাম এই কারণে যে সেদিনের সেই কর্মকাণ্ডে সরকারের আদৌ সমর্থন ছিল কিনা, এখনো আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বেশ কয়েকটি পত্রিকা এ ব্যাপারে যথার্থই লিখেছে যে, সেদিন জননেতা আ স ম আবদুর রবের বাড়িতে বেশ কয়েকটি নিবন্ধিত দলের নেতৃবৃন্দের বৈঠকে পুলিশের ন্যক্কারজনক বাধায় যদি সরকারের নৈতিক সমর্থন না থেকে থাকে তাহলে যারা এই চরম নিন্দনীয় কাজটি করেছেন তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক এবং যথাযথ শাস্তি দেওয়া হোক। যদি যথার্থই তা দেওয়া হয় তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভাবব বর্তমান সরকার স্বৈরাচারের পথে পা দেয়নি, গণতন্ত্রের পথেই আছে। মাঝেমধ্যে তাদের চলার পথে কোনো অপশক্তি এসে ভিড় জমালেও সত্যিকার রাজনীতির প্রবল বাতাসে সেসব শেষ পর্যন্ত খড়কুটোর মতো উড়ে যায় বা যাবে।

প্রায় দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলক স্বাধীনতাযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা জননেতা আ স ম আবদুর রব ফোন করেছিলেন, ‘কাদির, একটু বসতে চাই। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনসহ অন্য আরও কিছু প্রবীণ দেশের এই গুমোট পরিস্থিতি নিয়ে বসতে চান। তুমি এলে ভালো হয়। ’ আমার ডাকনাম বজ্র। হুজুর মওলানা ভাসানী ডাকতেন ‘কাদরী’ বলে, বঙ্গবন্ধু ‘আমার কাদের’, শেখ রেহানা বুক উজাড় করে ডাকে ‘কাদের ভাই’, বাবা-মার ‘বজ্র ’ এখন বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে শোভা পায়। ‘বজ্র’ ডাক আমার খুবই প্রিয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রীর ‘বজ্র’ ডাকার রহস্য তার শ্বশুরের নাম আবদুল কাদের মিয়া। তাই তিনি কাদের নাম মুখে আনেন না। সাধারণত বজ্র নামেই সব সময় ডাকেন। তাতে আমি বেশ পুলকিত বোধ করি। মানুষ বড় হলে তার ছোট নাম প্রিয় হয়। আমারও তেমন হয়েছে। ইদানীং সব নতুনের কেতন উড়ছে, সবকিছু তাদের দখলে। তাই প্রবীণদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সম্মান করার চেষ্টা করি। জনাব আ স ম আবদুর রবও তার মধ্যে একজন। কোনো কিছু বললে খুব একটা না করি না। তাই ১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম ছিল। তবে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলাম ২৫-৩০ মিনিটে। কিন্তু সেখান থেকে প্রায় ৫০ মিনিট লেগেছিল নেতার বাড়ি যেতে। ঘরে ঢুকেই এক বিব্রতকর পরিবেশ। কী হয়েছে? ‘না তেমন কিছু না। তবে পুলিশ তাড়াতাড়ি আলোচনা শেষ করতে বলেছে। ’ শুনে অবাক! বলে কী? আলোচনা শুরুই হয়নি। প্রবীণ নেতারা আসবেন। তাদের রেখে আলোচনা করা যায়? আনুষ্ঠানিক আলোচনার বাইরেও কথা বলা খুব একটা ভালো নয়। বিস্মিত হয়ে নানা কিছু ভাবছিলাম। চা-নাস্তা দেওয়া হচ্ছিল। ভাবী তানিয়া রব তদারক করছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টা হয়েছিল। শুনলাম সাবেক রাষ্ট্রপতি রাস্তায়। ড. কামাল হোসেনের আসার সম্ভাবনা। কিন্তু রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। হঠাৎই দেখি এক বেঁটেখাটো পুলিশ বৈঠকখানায়। চমকে গিয়েছিলাম। সত্যিই আমি আমার জীবনে কখনো এ রকম অবস্থার সম্মুখীন হইনি। আক্রমণ করে মিটিং-মিছিল ভেঙে দিয়েছে, ঘর থেকে ধরে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে একেবারে একটি নির্বিবাদী আলোচনায় অনুমতি ছাড়া বৈঠকখানায় পুলিশ কল্পনায়ও ছিল না। একটি পত্রিকা লিখেছে, মিলিটারি শাসনের সময় একবার ড. কামাল হোসেনের বৈঠকখানা থেকে ওইভাবে কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে তো ছিল গ্রেফতার। কিন্তু আলোচনা করা যাবে না, বৈঠক শুরুর আগেই শেষ করতে হবে— এ তো হিটলার মুসোলিনিকেও হার মানায়। সব নাগরিক অধিকারের খেলাপ। কোনো সভ্য সমাজে এটা চিন্তাই করা যায় না। পুলিশি অপতৎপরতা বা নিন্দনীয় আচরণের প্রতিবাদে চলে এসেছিলাম। পরদিন টাঙ্গাইলে নির্ধারিত সভা ছিল। ভেবেছিলাম সেখানেও অমন করবে কিনা। কিন্তু কই, কতজনের সঙ্গে কত ঘরে-বাইরে আলোচনা করলাম কোনো পুলিশ দেখলাম না। তাহলে সেদিন অমন হলো কেন জনাব আ স ম আবদুর রবের বাসায়? কোনো উত্তর পাইনি। কেউ কেউ বলছেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার জন্য হতে পারে। তা কেন হবে? তিনি কি কোনো গুপ্ত সংগঠন করেন, নাকি ফেরারি? ক্ষমতাবান অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, এটা কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত নয়। তাহলে যারা অমন করেছে তাদের কী হবে? কোনো বিচার-আচার হবে? দেশটা যে একেবারে জাহান্নামের দিকে চলে যেতে বসেছে সেদিকে কি কারও কোনো খেয়াল আছে? সরকার কি সত্যিই সবাইকে বৈরী করে খুব আনন্দ পায়? দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। জনাব রবের আহূত ওই সভাকে বিএনপির সঙ্গে মিলেমিশে একটা কিছু করার প্রয়াস বলে অনেকের মনে হতে পারে, তবে তা সত্য নয়। আমি যত দূর জানি গোপনে গোপনে দু-এক জনের তেমন আশা থাকলেও প্রায় সবার ইচ্ছা একটি সুস্থ সমাজ ও সুন্দর রাজনীতির জন্য একটা নিরপেক্ষ প্রয়াস। কারও দালালি নয়। প্রকৃত দালালি যদি করতেই হয় তা হবে দেশের, দেশের জনগণের আর শুধুই দেশের অতন্দ্র প্রহরী হওয়ার প্রয়াস। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদে যখন ভারতে ছিলাম সেটা ছিল জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর দিন। বিবিসি শোনার জন্য একমাত্র ছোট্ট রেডিও সম্বল। ’৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতন হলো জনতা সরকারের কাছে। বড় বেশি নির্যাতিত নিগৃহীত অবহেলিত হলাম। আশির দিকে ছোট বোন শুশুকে শান্তিনিকেতনে আর সম্ভব হলে নিজে পড়তে বর্ধমানে গিয়েছিলাম। তারও এক বছর পর ১২০০ টাকা দিয়ে ১৫-১৬ ইঞ্চির একটি সাদা-কালো টেলিভিশন কিনেছিলাম। অ্যান্টেনা অনেক উঁচুতে বাঁধলে মাঝে মাঝে বিটিভি ধরা পড়ত। সেখানে জনাব আনিসুল হকের উপস্থাপনা শুনতাম। বিদেশে থাকলে দেশের কাকপক্ষীর জন্যও মায়া লাগে। তা-ই লাগত। দেশে ফিরে আনিসুল হককে অনেক দেখেছি। আমরা একসময় অনেক কিছু ছিলাম। আমাদের হাত ছোঁয়ার জন্য অনেক সময় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত। বঙ্গবন্ধু নেই, প্রাণহীন দেহের কোনো মূল্য নেই। তাই হয়তো ইদানীং আমরা অনেকটাই অপাঙেক্তয়। জনাব হকেরা কোনো দিন পুলিশের লাঠি খাননি, রোদ-বৃষ্টিতে ভেজা-পোড়া হননি। জননেত্রীর কল্যাণে ঢাকা উত্তরের মেয়র হয়েছেন। জন্ম দিয়ে লালন-পালন করে সর্বস্ব দিয়েও শেষ পর্যন্ত অনেকে পিতা হতে পারেন না, কিন্তু তিনি নগর পিতা। সেদিন বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে গিয়ে মশারি বেঁধে দিতে পারবেন না। ’ ঘরে ঘরে ভোট চাইতে দোষ নেই, মশারি বাঁধতে যত দোষ। কত বড় কথা! আমরা রাজনীতি করে ফুলচন্দন দিয়ে জনতার পা ধুয়েও দোষী। অরাজনৈতিক লোকেরা গাড়ির চাকার কাদা ছিটিয়েও প্রিয়। এসবই বিধির লিখন। জনাব আনিসুল হকের অমন অরাজনৈতিক বক্তব্য আমাকে দারুণ মর্মাহত করেছে। এসব কথার নিন্দার ভাষা নেই। বড় মারাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছেন বিনা ভোটে নির্বাচিত মেয়র জনাব আনিসুল হক। লোকটিকে আমি সারা জীবন গভীর মমতায় হৃদয়ে লালন করেছি। এ-কাজে ও-কাজে তিনি প্রায়ই সাহায্য করেছেন। আগে ধনবানেরা আমাদের সম্মান করে সহযোগিতা করতেন, এখন মোটেই তেমন করেন না। কারণ দেশে উপযুক্ত ধনবান নেই। যে কোনো স্থানে উপযুক্ত লোক না থাকলে যেমন হয় আমাদের সমাজে প্রায় সব ক্ষেত্রে তেমন হয়েছে। সমস্ত জীবন সমস্ত শক্তি ও অস্তিত্ব দিয়ে আনিসুল হকের এই বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছি।

এবার মেজর কামরুল হাসানের কথা বলি। দিনপঞ্জির শেষ প্যারায়, ‘এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ জরুরি সিদ্ধান্ত নিল গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ঢাকায় পৌঁছার পর খন্দকার সাহেব দেখেন যে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চরম বিশৃঙ্খলা। এত লোকের সমাবেশে কিছুই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। শৃঙ্খলা তো দূরের কথা তার ওপর ছিল আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানিদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই ওই পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব দলিলে দস্তখত করে ওখান থেকে চলে যাওয়াই ছিল শ্রেয়। ’ এখান থেকেই বোঝা যায় কার কত কৃতিত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল। এ কে খন্দকার তার বইয়ে লিখেছেন, যখন তিনি হাফশার্ট গায়ে কলকাতা নিউমার্কেটে ঘুরছিলেন তখন সেখান থেকে তাকে ধরে এনে দমদম বিমানবন্দর দিয়ে আগরতলা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে এতিমের মতো তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং সেভাবেই কলকাতা ফিরেছিলেন।

একাত্তরের দিনপঞ্জির ২১২ পাতা থেকে ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, বিশেষ করে ৩ ডিসেম্বর ভারত তথা মিত্রবাহিনী প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। আজ যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে, কাল সেটা মুক্ত হয়ে নতুন আরেকটা ফ্রন্ট খুলে গেছে। যুদ্ধের পরিচালনা বিষয়াদির দায়িত্বে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার। তার ওপর সদর দফতরের দায়িত্ব দিয়ে কর্নেল ওসমানী চলে যান শত্রুমুক্ত সিলেটে। ১৩/১৪ ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তার পরিবহন ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। ১৬ ডিসেম্বর সকালে যখন সংবাদ এলো যে, ওই দিনই বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে সেই সময় অনেক চেষ্টা করেও মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ’

কামরুল হাসানের লেখামতো বিশৃঙ্খলা দেখে দলিলে স্বাক্ষর করে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় সেটাই মঙ্গল তাই তারা করেছিলেন। আমি কিন্তু তা করতে পারিনি। কাদেরিয়া বাহিনীর ৪-সাড়ে ৪ হাজার এবং ভারতীয় বাহিনীর ২ হাজার যোদ্ধা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তায় ছিল। এটা ঐতিহাসিক সত্য সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিন্দুমাত্র কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি।

তিনি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক রোজনামচা দিয়েছেন একাত্তরের দিনপঞ্জিতে। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি ডায়েরি লেখেন। কিন্তু তিনিও কাজের চাপে ওভাবে তারিখ দিয়ে প্রতিদিন লিখতে পারেন না। যুদ্ধের সময় শুধু খাবার নয়, কাগজেরও অভাব ছিল। তিনি কীভাবে অমন রোজনামচা লিখলেন? মনে হয় তার যেন কোনো কাজ ছিল না। রোজনামচা লেখাই ছিল প্রধান কাজ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এভাবে লিখলে কীভাবে তাকে সাধুবাদ দেব। ’৭২-’৭৩-এ লিখতেন। তা না লিখে পাকাপোক্ত হয়ে এখন লিখেছেন। যখন তার লেখার কোনো সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যাবে না। আমি না থাকলে এসবের আলোচনাও হতো না।

নিজের এবং নিজের জায়গা নিয়ে কিছু আলোচনা করি। আমাদের যতই অবহেলা করা হোক কাদেরিয়া বাহিনীই একমাত্র মুক্তিবাহিনী যাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধু রাজধানীর বাইরে প্রথম অস্ত্র নিয়েছেন। সে ছিল ২৪ জানুয়ারি ’৭২। ৩১ জানুয়ারি ’৭২ পল্টনে শেখ ফজলুল হক মণি, জননেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের মুজিববাহিনীর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু অস্ত্র নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণহীন ছাত্ররা যেভাবে অস্ত্র দিতে পারেন সেভাবেই দিয়েছিলেন। কারও গায়ে ছিল পাঞ্জাবি, কারও গায়ে হাফশার্ট তবু তারা দিয়েছিলেন। আমরা কাদেরিয়া বাহিনী সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুর পায়ের সামনে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম।

এখন আওয়ামী নেতা এবং সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় ওভাবে অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছিলাম। কয়েক বছর আগে প্যারিসের এক ছাত্র পিএইচডির উপকরণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী সম্পর্কে জানতে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র বিছিয়ে দেওয়া বা জমা দেওয়ার প্রসঙ্গ এলে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার ওপর না হয় শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধুর প্রভাব ছিল; কিন্তু আপনি যে আপনার দলের সব অস্ত্র এক দিনে দিয়ে দিলেন দলের লোকজন বা সদস্যরা কোনো আপত্তি তোলেনি?’ না, সেদিন কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। মনে হয় সেদিন আমার নির্দেশের বাইরে তারা মনে মনেও ভাবেনি। কিন্তু এখন হয়তো ভাবত। জানুয়ারিতে অস্ত্র দিয়ে দিলেও ’৭২-এর মে, জুন পর্যন্ত প্রশাসনের প্রায় সবকিছুই আমাদের করতে হতো। আমরা সানন্দে তা করতাম। ৩১ জানুয়ারি যেদিন পল্টন ময়দানে মুজিববাহিনী অস্ত্র জমা দেয় সেদিন বাতেনসহ আলমগীর খান মেনুর তিন-চারটি গাড়ি কাদেরিয়া বাহিনী আটক করেছিল। কারণ কাদেরিয়া বাহিনীর অনুমতি ছাড়া শহরে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরার পথ ছিল না। ৭২টি অস্ত্রসহ এক শ কজনের তালিকা আমাকে যখন দেওয়া হয় আমি তখন তাদের সসম্মানে আগে-পিছে স্কট করে কালিয়াকৈর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে বলেছিলাম। সেই বাহিনীর খন্দকার আবদুল বাতেন কোনো কমান্ডার ছিলেন না। মুজিববাহিনীর টাঙ্গাইল জেলা কমান্ডার ছিলেন আলমগীর খান মেনু, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন খন্দকার আবদুল বাতেন। খন্দকার আবদুল বাতেনের কেউ কখনো কোনো যুদ্ধ করেনি বা করতে পারেনি। জুন মাসে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার লাবিবুর রহমান এবং জাহাঙ্গীর তাদের হাতে লাউহাটি-কেদারপুরের মাঝামাঝি নিহত হলে তারা সেই যে পালিয়ে বেড়াতে শুরু করে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সে পালানোর শেষ ছিল না। অথচ জনাব কামরুল হাসান তার একাত্তরের দিনপঞ্জির ১৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মে মাসের ৪ তারিখ খন্দকার বাতেনের দল সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে। বাহিনীপ্রধান খন্দকার বাতেন তার হাতে চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করে। দুই ঘণ্টা লড়াই হয়, তাতে বিপুল প্রাণহানি ঘটে। শত্রুরা মৃতদেহ ফেলে থানা ত্যাগ করলে বাতেনের হাতে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র দখলে আসে। সিঙ্গাইর থানা দখলের পর ২টা স্যাবরজেট জঙ্গি বিমান বাতেন বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। তখন সুবেদার আবদুল বারী বিমান দুটিকে গুলি করার জন্য কমান্ডারের অনুমতি চায়। খন্দকার বাতেন তাকে অনুমতি দিলে সুবেদার বারী ও নায়েক আজহার জে-থ্রি রাইফেল দিয়ে বিমান দুটিকে গুলি করে। জে-থ্রির গুলির মুখে অতি দ্রুত বিমান দুটি পালিয়ে যায়। সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে সফলতা পাওয়ায় যোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যাপক বেড়ে যায়। ’ সেনাবাহিনীতে থাকা এমন একজন চৌকস লেখকের লেখায় ২টা স্যাবরজেটকে জি-থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি করে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা মুক্তিযুদ্ধের এত দিন পর শুনলাম। সিঙ্গাইর, দৌলতপুর, ঘিওর আমাদের কাছাকাছি। একটু ভাটির মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছেন ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী। লেখক একবারও তার নাম নেননি। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর বাহিনীর তুলনায় বাতেনের কোনো বাহিনীই ছিল না। বাতেন যদি মুজিববাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক হয়, ৩১ জানুয়ারি ৭০-৮০ বা ১০০ জন ৭২টি অস্ত্র জমা দিয়ে থাকে তাহলে বাতেন বাহিনী কোথায়? আর এটা শতসিদ্ধ শতভাগ সত্য মুক্তিযুদ্ধের পর মেনু, বাতেন, শাজাহান সিরাজ এরা গণবাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখনো তারা জননেত্রীর ছায়ায়— এটা কী করে সম্ভব ভেবে পাই না। পরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম ৪ মে বাতেন বাহিনী নামে কোনো বাহিনী ছিল না, যুদ্ধ তো দূরের কথা। ওই সময় অস্ত্রের জন্য খন্দকার আবদুল বাতেন আমার কাছে ধরনা দিয়েছেন। আমি তাকে কিছু অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। লেখককে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, খন্দকার বাতেন এখনো যদি কোনো চাইনিজ রাইফেল অথবা স্টেনগান লোকজনের সামনে চালিয়ে দেখাতে পারে লেখকের সব বক্তব্য মেনে নেব। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রথম দিকে কোনো চাইনিজ অস্ত্র ছিল না। তিনি চাইনিজ অস্ত্র পাবেন কী করে? আমরা শুরুর দিকে চাইনিজ রাইফেল দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈন্যদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। এরপর এপ্রিল, মে মাসে নানা দিক থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনের কাছে ৫-৬টা চাইনিজ এলএমজি, ১৫-২০টা রাইফেল, ৬-৭টা কারবাইন বা স্টেনগান পেয়েছিলাম। সে সময় বাতেনের দলের কোনো নামগন্ধ ছিল না। জার্মানির তৈরি ২-৪টা জি-থ্রি রাইফেল দেখেছি আগস্টের পরে। মে মাসে আমাদের সম্বল ছিল একনলা দোনলা বন্দুক, ২-৪টা রিভলবার, পিস্তল আর পুলিশের মার্ক থ্রি-ফোর রাইফেল। মেজর সাহেব কী বলছেন! একটা থানা দখলের পর সেখানে ২টা স্যাবরজেট আক্রমণ করার পরও প্রশিক্ষণহীন বাতেন বাহিনী টিকে ছিল— এটা ভাবা যায়? ছেলেবেলায় কত শুনেছি, গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়ে যায়। এ তো দেখছি তার চাইতেও মারাত্মক গাঁজা!

লেখক : রাজনীতিক।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন