আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ছোট গল্পঃ উপলব্ধি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১১-১১ ০০:২১:১৫

লেখক

লিটন সরকার ::    জমানো টাকায় গাড়ি কিনেছি। ড্রাইভিং আগেই জানতাম, তাই নিজের গাড়ি নিজেই চালাচ্ছি। অবশ্য না চালিয়ে উপায়ও নেই।  ড্রাইভার যে রাখব তাকে পয়সা দিব কেমনে? সামান্য টাকা বেতনের চাকরিজীবী আমি।

বয়স ৫বছরের কিছু বেশি হবে। বুঝতে পারছেন বয়সটা আমার নয় চাকরির। আমার বয়স চাকরির বয়সের গুণিতক। হতে পারে সেটা ৩০, ৩৫ বা ৪০। ছেলেদের বয়স জানাতে কোন সমস্যা নেই, বেতন জানাতে সমস্যা। আমি বয়স বেতন কোনটাই বললাম না।আপনারা আমাকে বুড়ো ভীম ভেবে নিতে পারেন। তবে হা এই বুড়ো ভীম কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে।

সংসার খরচ হিসেবে আমাকে কোন টাকা দিতে হয় না। যদিও বড় ছেলে আমি। কিন্তু ভাগ্যবান বড় ছেলে । কারণ আমার বাবা এখনো চাকরি করে আর উনার কোন মেয়েকে বিয়েও দিতে হবে না। সুতরাং পাত্র হিসেবে আমি যে বেশ আকর্ষণীয় তা খুব ভাল করেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু তারপর ও মনমত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছি না।

যে দুইজনকে পছন্দ হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনকে আমি না করে দিয়েছি আর অন্যজন আমাকে। আমি না করেছি কারণ উনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। নেটে সার্চ দিলেই নাকি উনার ক্লিপস পাওয়া যায়। এত জনপ্রিয় মানুষ নিয়ে আমি চলব কেমনে! পাছে যদি উনাকে নিয়ে হুমরি খেয়ে পড়ি । তাই না করে দিয়েছি।

অন্য আরেকজনের ভাষ্যমতে ,আমি নাকি এখনো বিয়ের যোগ্য পাত্র হয়ে উঠতে পারিনি।আমাকে দেয়া উনার ভাষণের কিছু অংশবিশেষ আপনাদের বলি,

অযোগ্য পাত্রকে কে বিয়ে করবে বলেন।আজকাল যে ছেলে বিয়ের আগে গাড়ি কিনতে পারে না সে বিয়ের বাজারে মোটে ও যোগ্য না। সো...

এতদিনের অযোগ্য আমি আজ একনিমিষেই বোধহয় যোগ্য হয়ে গেলাম।যোগ্য আর অযোগ্যের মাঝে  তফাৎ শুধু একটাই- গাড়ি।
গাড়ি কিনে আসার সময় তার বাসার সামনে হয়ে এসেছি ।তীব্র হর্ণে ঠিকতে না পেরে ঘর থেকে বের হয়েই সে আমাকে দেখেছে। খুব চমকেও গিয়েছে।
সে মনে হয় ধারণাই করতে পারেনি যে, আমাকে অযোগ্য বলার পরের দিনই আমি যোগ্য হবার জন্য গাড়ি কিনে ফেলব।

আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, আজ আমার বাসায় রাত্রিদের বাসা থেকে একটা ফোন আসবে।
আজ আমার মন ভাল । তবে সেটা গাড়ি কেনার জন্য নয়।নিজেকে কেন জানি আজ বেশ স্বাধীন স্বাধীন মনে হচ্ছে ।হাতে স্টিয়ারিং , মোবাইল সুইচ অফ করা । কেউ আজ চাইলেও আমার স্বাধীনতায় কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আজ নিজেকে খুব হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।গাইতে ইচ্ছে করছে, কোথায় আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে।

মন ভাল থাকলে মানুষের সব কিছু ভাল লাগে। ধূতরা ফুলকে মনে হয় শরতের কাশফুল।আজকের দিনটা আমার কাছে সেরকমই।গান চালিয়ে দিয়েছি।লো ভলিউমে রবীন্দ্র সংগীত চলছে।
গান চলছে সেই সাথে গাড়ি।
" সেদিন দুজনে দুলেছিল বনে" শুনতে শুনতে কখন যে নিজেকে গানের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি খেয়ালই করিনি।খেয়াল হল তখন, যখন আমাকে গাড়ির ব্রেক কষতে হল। সামনে যেন কিসের ঝটলা।
কোন এক্সিডেন্ট হল নাতো ??।না। তা হলে তো গাড়ি বা পুলিশ থাকতো। কিন্তু সেটাতো নেই। তাহলে নিশ্চয়ই সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে।ছোটবেলায় কত সাপের খেলা দেখেছি।খেলা দেখে অনেকে পয়সা দিত।আমি কিছু দিতাম না।শুধু হাততালি দিতাম।
গাড়ি থেকে নামলাম।আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি সাপের খেলা দেখব বলে।
বীণার সুরও তো ভেসে আসছে না।ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখি- এক মেয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে।চুল এলোমেলো। পড়নের কাপড়খানা ছেড়া। লজ্জায় সে মুখটি ঢেকে রেখেছে।
হৃদয় বিদারক এই দৃশ্যটা উপভোগ করছে চারপাশের মানুষজন। কেউ জানতে চাইছে না ঘটনাটা কি??
কাউকে বলতে শুনলাম পাগল বোধহয়। আমার সেটা মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই মানুষরূপী কোন নরপশু তার সর্বনাশ করেছে। লজ্জায় অপমানে সে হয়তোবা আত্মহত্যা করতেই চেয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই হয়তোবা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে কোন প্রিয়মুখ।
আমি মায়ের জন্য কিনা একটা শাল তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললাম, আপনার কি হয়েছে বোন??
সে কোন উত্তর দিল না । এমনকি ফিরে ও তাকাল না।
পাগলিরে আবার কি জিগান? জটলা থেকে কেউ একজন একথা বলতেই মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো, আমি পাগল নই।
বুঝতে পারলাম ,  কেউ তাকে এতক্ষণ ধরে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।  শুধু তামাশা দেখেছে।মানুষ এই জঘন্য কাজটা কেমন করে করতে পারে আমি ভেবে পাই না।অন্যের দুঃখ কষ্ট নিয়ে মজা করার জন্য তো সৃষ্টকর্তা আমাদের পাঠাননি।আমরা মানুষরা যদি মানুষের পাশে না দাড়াই শিয়াল কুকুরেরা তো আর দাঁড়াবে না।
গাড়ি চলছে।এবার আর আমি একা নই।আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে বিধ্বস্ত সেই মেয়েটি।এই স্বাধীনতা হারানোর মধ্যে কোন আক্ষেপ নেই। আছে পরিতৃপ্তি।
মেয়েটি ধর্ষিতা নয়। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক।
জয় পরাজয় থাকবেই।কিন্তু এ পরাজয় যে ভীষণ লজ্জার,অপমানের।
যার হাত ধরে ভালবাসার সেতু দিয়ে সে পাড়ি দিয়েছিল বাবার বাড়ি থেকে অন্যের বাড়ি তার সেই ভালবাসার মানুষটি যে আজ তার হাত ছেড়ে দিয়েছে।পাচঁ বছরের পরিণয় শেষে সে যার সাথে
জীবন শুরু করেছিল , আজ বুঝতে পেরেছে এতদিন তার সাথে করা সবই ছিল অভিনয়। প্রেম ভালবাসা সেখানে কিছুই ছিল না।
ছেলেটি নাকি মেয়েটিকে জানিয়েছে, বাবার কাছ থেকে যেন সম্পত্তির ন্যায্য পাওনা নিয়ে আসে।
কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটি বলে দিয়েছে, জীবদ্দশায় সে তার বাবার বাড়ি যাবে না সেখানে যাবে তার লাশ। একথা বলার জন্য সে শুধু ভালবাসার মানুষের আশ্রয়ই হারায়নি সেই সাথে হয়েছে নিগৃহীত।
ভালবাসার বদলে তাদের সংসার আজ স্বার্থের সংসার।
সবকিছু হারিয়ে দিক্বিদিক শুন্য হয়ে মেয়েটি পথের ধারে এক বটগাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল।  উৎসুক জনতা সেখানেই ভীড় জমিয়েছিল।
সেখান থেকে মেয়েটি এখন আমার গাড়িতে।না আমি তাকে বাবার বাড়ি পৌছে দিচ্ছি, না পৌছে দিচ্ছি  তার পাষণ্ড স্বামীর কাছে।আমার ছুটে চলা একজন নির্যাতিত মেয়ের ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়ার জন্য।
এতক্ষণ যে আমি রবীন্দ্রসংগীত শুনছিলাম সেই আমাকে এখন না চাইলেও শুনতে হচ্ছে কান্নার সংগীত।
কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে বলেছিল, জানেন আমি আমার বাবামায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম।অতি আদরে বড় হয়েছি।তাদেরকে কাঁদিয়ে ওর কাছে এসেছিলাম। অথচ সেই কিনা...
আচ্ছা ছেলেরা কি সবাই এরকম লোভী হয়??
আমি মুখে কিছু বললাম না।
তবে মনে মনে ভাবছি মেয়েটি একেবারে মিথ্যে বলেনি।
আমি আমার কিছু কিছু বন্ধুদের বিয়েটাকে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যাবহার করতে দেখেছি। কেউ ধনীর দুলালী দেখে বিয়ে করেছে আবার কেউ ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড এর সিটিজেনশীপ পাওয়া কোন মেয়েকে। সে হিসেবে তারা লোভী।
সাপলুডুর এই জীবনে সবাই মই বেয়ে উপরে উঠতে চায়।বিয়েটাকে তাই মনে হয় তারা সোপান হিসেবেই বেছে নেয়।কেন নিজ যোগ্যতায় কি উপরে উঠা যায় না ??
আর এত হিসেব নিকেশ কষে কি বিয়ে করা ঠিক?কই আমিতো এত হিসাব কষছি না।
ভালবাসা কি বিনিয়োগ করার জিনিস যে একটা সময় পর তা সুদেআসলে তুলে নিতে হবে।তারপর ও টাকা পয়সা বদলের মতই আজকাল ভালবাসার বদল হয়।ভালবাসা আজকাল ভাল বাসার জন্য,ভাল গাড়ির জন্য।অমূল্য ভালবাসা আজ সামান্য অর্থ দিয়েই কেনা যায়।
অর্থের কাছে তাই আজ ভালবাসার কোন মূল্য নেই।

হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো।
"বাবা,রাত্রিদের বাসা থেকে ফোন এসেছে। মত পাল্টিয়েছে তারা।কি বলব??
"
ফোন রেখে দিলাম।কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।অভিমান মায়ের সাথে নয়।সমাজের লোভী মানুষগুলার সাথে।
গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি আমি। আর মা বাজিয়ে যাচ্ছে আমার মোবাইল।আমি মোবাইল আবার সুইচ অফ করে দিলাম।
মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল,কই বললেন নাতো  ,ছেলেরা সবাই লোভী কি না?

বললাম,হয়তোবা লোভী।হয়তোবা না।

আপনি কি লোভী??

হয়তোবা! আবার  হয়তোবা না...



লেখক: ব্যবস্থাপক, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন