আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

নারায়নগঞ্জের ওসমান এবং চুনকা পরিবার || সুজাত মনসুর

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-১৯ ১৯:৫৫:২৫

ভেবেছিলাম শামীম ওসমান-সেলিনা হায়াত আইভি বিতর্কে জড়াবো না। কিন্তু মুজিবাদর্শের কিছু নেতাকর্মী তাদের স্ট্যাটাসে শামীম ওসমানের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে আরেক আওয়ামী পরিবারের সন্তান আইভি সম্পর্কে এমন সব শব্দ ব্যবহার করছেন যা, দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছি। কিছু কিছু স্ট্যাটাসে মন্তব্য করে নিজের মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

মানুষের স্বভাবজাত ধর্মই হলো শক্তির পূজা করা। শামীম ওসমানের পরিবারের অবদান আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জন্মের সাথে জড়িত, বিশেষ করে নারায়নগঞ্জের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তাই বলে আইভিদের পরিবারের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আইভির বাবা আলী আহমেদ চুনকাও বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি মূলত শ্রমিকদের বিষয়টিই দেখাশুনা করতেন। আর শামীম ওসমানরা বংশ পরস্পরায় ক্ষমতাশালী, জমিদারশ্রণীর মানুষ। এই দুই পরিবারের দ্বন্ধ অতি পুরাতন ও এখনো চলমান।

সেই দ্বন্ধের জের ধরেই গত নির্বাচনের আগে যখন স্থানীয়ভাবে মেয়র প্রার্থী নির্ধারণ করা হয় তখন, শামীম ওসমানরা সেলিনা হায়াত আইভির নাম সিলেক্ট করেননি ইচ্ছে করেই। পরে জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্রণোদিত হয়ে আইভিকে নমিনেশন দেন এবং গণভবনে সবার উপস্থিতিতে কেন আইভির নাম তাদের তালিকায় নেই সেকথা শামীম ওসমানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে শামীম ওসমান বলেছিলেন, আইভির দলের নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্ক নেই এবং আইভি নাকি নেত্রী সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেন। নেত্রীর উত্তর ছিলো, ‘আমার সম্পর্কে কথা বললে তোমার কি?’ একপর্যায়ে শামীম ওসমান ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পদত্যাগ করবেন বলেন। তখন নেত্রী বলেছিলেন, পদত্যাগ করো আমি তা গ্রহণ করবো। উনারা অবশ্য পদত্যাগ করেননি।

পরে শামীম ওসমান আইভির পক্ষে কাজ করেছেন এবং তাঁকে জিতিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। অবশ্যই বিদ্রোহী হলে কি হতো তা জানার সুযোগ আমাদের হয়নি।

যাইহোক, এই দুই পরিবারের দ্বন্ধের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এখন আসি অতিসাম্প্রতিক ঘটনা প্রসঙ্গে। আইভি নারায়নগঞ্জের মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেত্রী। শামীম ওসমানও একটি আসনের এমপি এবং লড়াকু আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আইভির অধিকার আছে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার। ফুটপাতে হকারদের দৌরাত্ম ও পথচারিদের বিড়ম্ভনা শুধু নারায়নগঞ্জে নয়, সারা বাংলাদেশেই। প্রায়ই দেখা যায় ঢাকাসহ সারাদেশের শহর-নগরগুলিতে হকার উচ্ছেদ অভিযান চলছে। কিন্তু কোন জায়গায়ই মেয়র কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কখনো্ই হকার হঠাতে গিয়ে একজন জনপ্রতিনিধির বাঁধার সম্মুখিন হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু নারায়নগঞ্জে হতে হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থার ঘোষণার পরও রেহাই পাওয়া যায়নি। শুধু বাধাই নয়, সাংবাদিক সম্মেলন করে একজন মেয়রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে, যিনি নিজ দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। যিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি শুধু জনপ্রিয় নন, অনেক শক্তির অধিকারী। উনার সাথে দলের মিলিট্যান্ট ফোর্স রয়েছে। আছে পারিবারিক ও টাকার শক্তি। তিনি আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, হকার বসবে কেউ আটকাতে পারবে না। সুতরাং এই অবস্থায় আইভির দুইটি পথই খোলা ছিল, (১) শামীম ওসমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করে ঘরে বসে থাকা ও হকারদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়া। (২) চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। প্রথমটি অনুসরণ করলে আইভির রাজনৈতিক মৃত্যু হত। তাই তিনি দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছেন। ফলে দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, মৃত্যর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন এবং হাসপাতালে পড়ে আছেন।

আইভির এই চ্যালেঞ্জ করাটাই হয়েছে তাঁর জন্য কাল। দলীয় নেতার হুমকি মোকাবেলা ও দলের নেতাকর্মীদের সমর্থন না পাওয়ার কারনে তিনি জনতার শক্তির ওপর ভর করেছেন। সেই সুযোগ নিয়েছে বিএনপি-জামাতসহ আওয়ামী বিরোধীশক্তি। আইভি চাইলেই তাঁদের এড়িয়ে যেতে পারতেন না। তাছাড়া মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন মানুষের সামনে এগুনো ছাড়া কোন পথ খোলা থাকে না। এছাড়া ডু্বন্ত মানুষ যে কোনকিছুকে আশ্রয় করেই ভেসে থাকতে চায়।

ধরেই নিলাম শামীম ওসমান মানবিক কারণে হকারদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। একজন প্রকৃত জনপ্রতিনিধির দায়িত্বও তাই। যদিও অকূস্থলটি উনার নির্বাচনী এলাকায় পরে না। তিনি সরাসরি সংঘর্ষে কিংবা চ্যালেঞ্জে না গিযে অন্যভাবেও বিষয়টি মোকাবেলা করতে পারতেন। (১) ‍তিনি হকারদের প্রতিনিধিদের নিয়ে মেয়রসহ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের সাথে বসে ফয়সালা করতে পারতেন। (২) তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। (৩) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, এমনকি জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথেও বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারতেন। কেননা, আর কেউ না পারুক, ওসমান পরিবারের সদস্যদের নেত্রীর সাথে দেখা করা কঠিন কোন বিষয় নয়। কিন্তু তিনি তা না করে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের নগ্ন অভ্যন্তরিণ কোন্দল আমরাই প্রকাশ্যে রাজপথে টেনে নিয়ে এসেছি। আর এখন করছি অতিভক্তির কারণে ফেইসবুকে অশালীন সব সট্যাটাস দিয়ে আইভিকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, একজন মহিলা বলেও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। অতিভক্তির কারণে অনেক প্রতিভাবান নেতাদের ধ্বংস হয়ে যাবার ইতিহাস আমাদের সামনেই আছে। মনে রাখতে হবে কোন ব্যক্তি বিশেষ কখনোই আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য ছিলেন না, এখনো নেই। যতক্ষন তিনি আওয়ামী লীগার ততক্ষণ তিনি প্রয়োজনীয়।

আইভির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো তিনি বিএনপি-জামাতসহ আওয়ামী বিরোধী শক্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। কেন তিনি তা করেছেন তা নেত্রীই দেখবেন এবং তিনি নেত্রীর কাছে জবাবদিহি করবেন। কিন্তু একবারও কিন্তু আমরা চিন্তা করে দেখছি না এই আইভিই কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা রাস্তায় লাঞ্ছিত হয়েছেন। একজন মহিলা হিসেবেও তিনি সামান্যতম সম্মানটুকু পাননি। এখন আবার বাক্যবানে লাঞ্ছিত হচ্ছেন।

আমরা জানি ইতোমধ্যে শামীম ওসমান এবং সেলিনা হায়াত আইভিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় তলব করেছেন। তিনি বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছেন। সুতরাং আমরা কাউকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা কারো বিচারের দায়িত্বটা নাইবা নিলাম। আমরা নিশ্চয় শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার নই। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হবার কোন কারণ আছে কি? শেখ হাসিনা নিশ্চয় দলের ভালোমন্দ আমাদের চেয়ে ভালোই বুঝেন? কি বলেন আপনারা? আরেকটি বিষয় নাসিম ওসমান কিন্তু আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে গিয়ে এমপি হয়েছিলেন। তেমনি সেলিম ওসমানও। সুতরাং অন্য কারো উপর শতভাগ আস্থা না রেখে আস্থা রাখুন শেখ হাসিনার উপর।

*সুজাত মনসুর: সাংবাদিক-কলামিস্ট।
সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু লেখক-সাংবাদিক ফোরাম, ইউকে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৯ জানুয়ারি ২০১৮/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন