Sylhet View 24 PRINT

প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যঃ স্মৃতি বিস্মৃতির আত্মকথন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২৫ ১৪:৪১:১৬

শিশিরমনির :: জীবন থেকে নেওয়া প্রতিটি গল্প একক ও মৌলিক। প্রতিটি গল্পের থাকে পৃথক নিজস্বতা, অনুভূতি ও অনুভব। এসব গল্পের আবেদন যেমন কখনো ফুরোয় না, আবার এই গল্পগুলো প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করে। রাহাত তরফদার তার স্মৃতির পাতার মনোগ্রাহী একঝাঁক গল্পগুচ্ছের স্থান দিয়েছেন ‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ বইটিতে।

বইয়ের শিরোনাম থেকে অনুমান করা যেতে পারে এটি একটি ভ্রমণকাহিনী। প্রকৃতপক্ষে এটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণকাহিনীর বই না বলা গেলেও, বইটির বিশাল অংশ জুড়ে লেখকের ভ্রমন বৃত্তান্ত ফুঁটে উঠেছে। বিশেষ করে, ‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ অনুচ্ছেদে ১৪টি কিস্তি জুড়ে লেখকের পাশ্চাত্য ভ্রমনের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে।

বইটিতে লেখকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক ঘটনাবলিসহ বিভিন্ন বিশেষ মুহুর্তের একান্ত অনুভূতি বিবৃত হয়েছে। লেখক স্মৃতির ভেতর গল্পগুলোকে বের করে গল্প বলার মত করেই সরল ভঙ্গিতে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। প্রতিটি অনুচ্ছেদে লেখক নিজস্ব ঢংয়ে গল্প বলায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ধরনের দিক থেকে বইটিকে আত্মকথনমূলক বই বলা যেতে পারে।

‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ বইটির প্রতিটি অক্ষর লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির সঞ্চয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় বা নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলির ওপর লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আলোকপাত করেছেন। বিশেষ করে বইয়ের প্রথম লেখাটিতেই ‘গণমাধ্যম ও আমার ভাবনা’ শিরোনামে রাহাত তরফদার স্বাধীন দেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা ও বেনামি অনলাইন পোর্টালের ভিত্তিহীন সংবাদের প্রভাব নিয়ে অভিমত দিয়েছেন। ‘জুতাও আমার, গালও আমার’ লেখাটি গতবছরের শেষ দিকে ঘটে যাওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে লেখকের বিশ্লেষণ। ব্যক্তিগত পর্যালোচনার ক্ষেত্রে রাহাত তরফদারের সবচেয়ে বড় গুণ এই যে, তিনি আপাদমস্তক একজন রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও তার কোনো লেখায় রাজনৈতিক পক্ষপাতের ছায়া পড়েনি। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে তার পর্যালোচনায় তিনি এই আন্দোলনকে সাধুবাদ জানান। সড়ক আন্দোলনকে পুঁজি করে একটি মহলের প্রোপাগান্ডা ও গুজব রটানোর সমালোচনা যেমন করেছেন, পাশাপাশি পুলিশ ও সরকারদলীয় মহলকে এই আন্দোলনের মুখোমুখি হিসেবে দাঁড় করানো উচিত হয়নি বলে মত দিয়েছেন। ইসলাম ও হজ্ব নিয়ে সাবেক সরকারদলীয় এক মন্ত্রীর আপত্তিকর মন্তব্যের সমালোচনা করেও তিনি পৃথক একটি লেখা লিখেছেন। সামগ্রিকভাবে তার কোনো লেখায় রাজনৈতিক পক্ষপাত সমর্থন পায়নি। রাহাত তরফদারের লেখায় সিলেটের শিশু রাজন ও ব্লগার অনন্ত দাশ হত্যাকান্ডের বিষয়টিও উঠে এসেছে। বিশেষ করে নিহত ব্লগার অনন্তের সাথে লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতি প্রকাশ পায়। আরেকটি লেখায়রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে পোড় খাওয়া নিঃস্ব রাজনৈতিক কর্মী মঞ্জু মিয়ার পাশে দাঁড়াতে লেখকের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার কথাও জানা যায়।

বইটিতে কয়েক ধাপে লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়। নিজের পাঠশালা, স্কুলের মজার গল্প,  শহরের বাসা, গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার গল্প, আত্মীয়-স্বজনের সাথে স্মরণীয় ঘটনার বৃত্তান্ত, লেখককে নিয়ে তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের মূল্যায়ন, রেল ভ্রমণ, মৎস্য বিহার, পারিবারিকসহকারির বিয়োগ, বন্ধুর পিতৃবিয়োগসহ আরও বিভিন্ন বিষয়েরমিশ্র অনুভূতির কথা বিবৃত হয়েছে।

বাবাকে নিয়ে ‘আব্বু’ শিরোনামে রাহাত তরফদার ছয় পৃষ্ঠার মূল্যায়নে পিতার বেড়ে উঠা, কর্মজীবন, সাহসিকতা ও সততার বিভিন্ন উদারহণ উঠে এসেছে।

বিদেশ ভ্রমণের স্মৃতি অত্যন্ত যত্নের সাথে বেশ কয়েক জায়গায় উঠে এসেছে বইটিতে। বিশেষ করে আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য ভ্রমনের গল্প। ‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ শিরোনামে লেখাটি লেখকের যুক্তরাজ্য ভ্রমনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। যুক্তরাজ্য ভ্রমনের ক্ষেত্রে লেখকের ম্যাজিকাল সংখ্যা চার– কারণ তিনি চারবার যুক্তরাজ্য গিয়েছেন এবং তা চারবছর পর পর। চারবার দেশটিতে ভ্রমনকালে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ, সেখানকার আত্মীয় স্বজনের সাথে মেলামেশা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রা আর সংগ্রামের যেসব চিত্র তার চোখে ধরা পড়ছে সেসব নিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা দিয়েছেন। এ লেখায় লন্ডনে কীভাবে বাংলাদেশিরা নিজস্ব অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন, সেখানকার রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন সে সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

লেখক সম্প্রতি আরব আমিরাত ভ্রমণ করেছেন। আরব আমিরাত প্রায় বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে স্বাধীন হয়। অথচ দেশটি আজ বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র। সুবিশাল ও সুসজ্জিত বিমানবন্দর, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন আর চাকচিক্যের দেশ আরব আমিরাত। যেখানে দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কেবল- সমুদ্র সৈকত। বাকিসবকিছু মানুষের হাতেগড়া। রাজনীতিক ব্যক্তি হয়েও রাহাত তরফদার যেকোনো দেশকে কেবল রাজনৈতিক মানচিত্র দিয়ে মূল্যায়ন করেননি। সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। লেখার এক জায়গায় এসে রাহাত তরফদার আরব আমিরাত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘এসব বিশালতাকে (আরব আমিরাতের আভিজাত্য) হার মানায় মরুর দেশটির প্রবাসীদের ত্যাগ ও হার না মানা সংগ্রামী জীবন।’  লেখক সেখানকার লেবার ক্যাম্প ঘুরে প্রবাসীদের জীবনযাপনের চাক্ষুষ বর্ণনা দিয়েছেন। মানবেতর জীবনযাপন করে পারিবার সদস্যদের আবদার ও চাহিদা পূরণ করা এসব লোকদের আমরা ‘টাকার গাছ’ বলে থাকি। অথচ লেখক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এসব ‘টাকার গাছ’য়ের অন্তরালের ভিন্নচিত্র অবতারণা করেছেন।
লেখক তার ছাত্ররাজনীতির বিদায়লগ্নে নিজের আবেগ ও ভালোবাসা মেশানো‘ছুটি’ শিরোনামের লেখাটি লিখেছেন। লেখাটিতে ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতা, অনুভূতি বর্ণনা করে মূলধারার রাজনীতির প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা তুলে ধরেছেন।

ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ থাকার ফলে বইটির ‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ নামটি অত্যন্ত সার্থক নামকরণ হয়েছে দাবি করা যায়। ‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ লেখাটি লেখক শেষ করেছেন এভাবে, ‘আমি দেশ ও রাজনীতির মায়া ছাড়তে পারলাম না তাই দেশেই থিতু হয়েছি।’ পুরো লেখাটি পড়লে জানা যাবে, লেখকের নিজ ভাই বোনসহ অধিকাংশ আত্মীয় স্বজন প্রবাসে বসবাস করছেন। শুধু তাই নয়, তারা অনেকেই সেখানকার রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন ও সেখানকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই বরং এ কথা বলা চলে যে–দেশের মায়া ছাড়তে না পারার কারণেই লেখক দেশে থেকে গেছেন এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেকাজ করছেন।

‘প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য’ বইটি মূলত লেখকের আত্মকথন, অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা। দাবি করা যায়–শুধুমাত্র পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার আশায় তিনি বইটি লিখেননি। নিজের অভিজ্ঞতা আর অনুভবের কথাগুলো ছড়িয়ে দিতেই কেবল তিনি বইটি প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। নিজের কথা হলেও, বইটির কিছু কিছু কথা পাঠকের মনে বেশ প্রভাব ফেলবে ও উপলব্ধির জায়গা তৈরি করবে এটা বলা যেতেই পারে।

লেখক: শিশির মনির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.