Sylhet View 24 PRINT

বাবার কামলা দেওয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৬-১৬ ১৬:৩০:০৩

ফরিদ উদ্দিন :: প্রখর কাঠফাটা রোদে প্রশান্তি পেতে ফাহিম ছেলেটা গ্রামের ফল বাগানে আসন বসায়। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় হাওয়া খায় গান গান।আর তার বাবা ক্ষেতে নিড়ানি দিতে দিতে গলাটা মরুভূমি হয়ে যায়! বলদগুলোকে আরাম দিতে তাদের গায়ে কাদা মাখিয়ে দেন।কিন্তু নিজের কিছু করার নাই। ভোরের নিয়ে আসা পানির জগটি অনেক আগেই খালি হয়ে গেছে। এতক্ষনে ছেলেটা ভাত -পানি নিয়ে আসার কথা! কিন্তু আসে নি। দুপুর পার হবার পথে। ছেলের মা ছেলে খোজে পাচ্ছেন না। গত মাসে নিজের নৌকা বিক্রি করে কিনে দেওয়া ছেলের কলিজার মোবাইলে রিং হয় কিন্তু ছেলে সাড়া দেয় না! সে দলবল নিয়ে পুকুরে নেমেছে। ঠান্ডা আরামে সাতরায়। আর তার অপেক্ষা করতে করতে বাবা ঘেমে গোসল সেরে নেন। বাবা বাড়ি এলেন। ছেলে কে না পেয়ে রাগ না করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলে কি খেয়েছে? ফাহিমের মা বলেন, হ্যা তার প্রিয় মাগুর মাছ রান্না করে দিয়েছি খেয়ে বেরিয়েছে। বাবার মনে পড়লো বাকিতে আনা ছেলের প্রিয় মাছের দাম আজ পরিশোধ করার কথা কিন্তু...

ফাহিমের আব্বা, গোসল সেরে খেতে বসলেন, ফাহিমের মা মাছে দুটি টুকরো পাতে তুলে দিলেন। ফাহিমের বাবা থম হয়ে গেলেন, বললেন মাছ খেতে ভাল লাগছে না তাছাড়া কাটাও ভয় করে বলে মাছ তুলে দিয়ে ঝোল দিয়ে ভাত মাখালেন। ফাহিমের মা বললেন, শুনো আরো মাছ আছে ফাহিমের জন্য তুমি খাও। ফাহিমের বাবা বুঝলেন ধরা খেলেন তাও মাছগুলো ছেলের জন্য রেখে দিলেন। খাবার শেষ করে ভেঙ্গে যাওয়া লাঙ্গল মেরামত করতে যেয়ে হাত কেটে ফেললেন। বেশ রক্ত পড়ছে। উঠানে রক্ত জমে আছে। ফাহিমের মা অনেক চেষ্টা করে হাত বেধে দিয়ে বললেন, ডাক্তারের কাছে যাও সেলাই লাগবে মনে হয়। আবারও থম খেলেন ফাহিমের বাবা, তার কাছে আছেই ১০০টাকা কিন্তু বিকালে মাছওয়ালা কে তিনশো টাকা দিতে হবে। এখন একশো টাকা খরচ করা যাবে না। তিনি চেপে গেলেন ছোট্ট করে বললেন হ্যা যাব ডাক্তারে। ঘরে শুয়ে শুয়ে ছেলেটার লেখাপড়া, পকেট খরচ, টিচার খরচের ভাবনার চাপে তিনি বুঝতেই পারলেন না হাত দিয়ে আবার রক্ত পড়ছে...।

তিনি বের হলেন-হাওর থেকে গরুগুলো আনতে হবে। টের পেলেন হাতে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। পাত্তা দিলেন না। ফাহিমের বাবাদের এসব পাত্তা দিতে নেই। ফাহিম এলো। কিন্তু খোড়াচ্ছে! বাবা জিজ্ঞেস করলেন কিরে খোড়াচ্ছিস কেন? ফাহিম বললো পুকুর পারের গাছ থেকে পড়ে গেছে। পা ফুলে গেছে। ফাহিমের বাবা বললেন চল বাবা ডাক্তারের কাছে আহা ছেলেটা কত ব্যাথা পেয়েছে! তিনি হুলুস্থুল শুরু করে দিলেন। কাটা হাত ভূলে ফাহিম কে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। ফাহিম উনার কাধে ভর দিয়ে হাটতে লাগলো। নিজের কাধে ছেলের হাত! কত দিন পর!! ফাহিমের বাবার প্রচন্ড আনন্দ হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। ছেলেটা কত দিন পর জড়িয়ে ধরলো! তিনি মনে বললেন ইস ডাক্তারের চেম্বার যদি আরো একটু দূরে হত! ফাহিম এভাবেই তাকে ধরে রাখত। এসময় ফাহিম কু করে উঠলো। ফাহিমের বাবা টের পেলেন ফাহিমের পায়ের ব্যাথা বাড়ছে। তিনি দাঁড়িয়ে গেলে। রিকশার অপেক্ষায়। পেলেন না। পরে ভ্যান রিজার্ভ করে ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন। ভ্যানকে ত্রিশ টাকা দিলেন। ডাক্তার, ঔষধ কত লাগে কে জানে!

ডাক্তার ফাহিমকে দেখে এক্সরে লিখে দিলেন। তিনি ফাহিম কে বেডে শুইয়ে বের হয়ে গেলেন। বাজারের ও মাথায় মহাজন চাচার দোকান। কামলা খাটার সাতশো টাকা পাওয়া আছে তার। কিন্তু মহাজন দোকানে নাই। ম্যানেজারের হাতে পায়ে ধরেও কাজ হল না। পরে ম্যানেজার কে প্রস্তাব দিলেন, আপনার তো আরো কয়েক কামলা লাগবে আমি করে দিব আমাকে টাকা দিন ছেলেটা ডাক্তার চেম্বারে শুয়ে আছে। ম্যানেজার খোচা দিয়ে বললো- বেটা! নৌকা বিক্রি করে ছেলেটে ক্যামেরা ওয়ালা মোবাইল কিনে দিলি ঐ নৌকাটা আমি কিনব বলেছিলাম কিন্তু দিলিনা! বেটা পাগল! ছেলের আবদারের জন্য একমাত্র নৌকাটা বিক্রি করে দিবি? বেটা বেকুব এই যে বন্যা আসছে এখন কি করবি? ফাহিমের বাবার রাগ উঠলো - কলা গাছের ভেলায় ভাসব! বলে বেরিয়ে এলেন। ডাক্তার চেম্বারে ফিরার পথে দেখলাম রিকশা করে মহাজন চাচা আসছেন।

রিকশা থামিয়ে তিনিই বললেন, তোমার বাড়িতে গেছিলাম। শুনলাম তোমরা বাপ বেটা আহত! হুম ফাহিমের বাবার খেয়াল হল তার তো হাত কাটা! তিনি আড় চোখে নিজের হাত দেখলেন। মহাজন চাচা পাচশো টাকা দিয়ে বললেন, এটা নে বাকি হিসাব পরে করব চিকিৎসা কর ঔষধ লাগবে বাবুর দোকান থেকে আনিস আমি বলে দিব। ফাহিমের বাবার মনে হল হাত কেটে যা রক্ত পড়েছিল তা পুরন হয়ে গেছে। তিনি চেম্বারে গেলেন। দেখলেন ফাহিম মোবাইল কি করছে। ফাহিমের এক্সরে হল। ডাক্তার বললেন ভাঙ্গেনি। ঔষধে সারবে। বিশ্রাম নিতে হবে। তিনি আবার ভ্যান নিয়ে ফাহিম কে নিয়ে বাড়ি এলেন। ফাহিম কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাওরে ছুটলেন গরু আনতে। সন্ধ্যা হল বলে। যেতে যেতে রাস্তা থেকে কাটা বনজ পাতা মাড়িয়ে নিজের হাতে লাগিয়ে নিলেন। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটা কয়েকদিন বাড়িতে থাকবে। তিনি প্রান ভরে ছেলেকে দেখবেন! গোসল করিয়ে দিবেন খাইয়ে দিবেন আহ সুখ! কিন্তু খাওয়ার কথায় আবার থম খেলেন তিনি! মাগুর মাছ এনেছিলেন! মাছওয়ালাকে টাকা দিতে হবে! আবারো নিজের কাছে চুপসে গেলেন তিনি।

বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বললেন, শুন হঠাৎ করেই ছেলে বড় হয়ে গেল! স্কুলে যারাব পর থেকে ছেলে যেন অনেক বড় হয়ে গেল! সে তার মত ঘুরে বেড়ায়, স্কুলে যায়,হৈচৈ করে মা বাবা আদর করার সুযোগও পান না। পা ভাল হওয়া পর্যন্ত ছেলে বাড়ি থাকবে। তিনি স্ত্রী কে বললেন, শুনো। আমাদের কয়টা মোরগ আছে। আজ রাতে একটা জবাই করো রাতে বাপ বেটা খাব। ফাহিমের মা বললেন, কিছু মসলা কিনে আনতে হবে। ফাহিমের বাবা দেখলেন পঞ্চাশ টাকার মত উনার কাছে আছে। বললেন আচ্ছা আমি দোকানে যাচ্ছি তুমি ছেলে কে দেখো। কাঠাল ভেঙ্গে দাও। এসময় ছেলে ডাক। বাবা প্রায় দৌড় গেলেন। ফাহিম বললো বাবা আমার কিছু টাকা লাগবে। ইন্টারনেট শেষ হয়ে গেছে। ইন্টারনেট দিয়ে কি হয় তিনি বুঝেন না। বললেন আচ্ছা, আমি রহিমের ফ্লেক্সির দোকানে বলে যাব তুই আনিয়ে নিস। তিনি জিজ্ঞেসই করেন কি কত টাকা লাগবে। গত জুম্মাই রহিম মিয়া বলেছে তার খাতায় ছয়শত টাকা হয়ে গেছে! ফাহিমের বাবা বলেছিলেন, রহিম ভাই সমস্যা নাই, আপনার ক্ষেতে দুই কামলা দিয়ে দিব। রহিম মিয়া সেদিন বলেছিল- এভাবে বাবারা কত কামলা দেয় ছেলেরা টের পায়না...।

লেখক: ফেঞ্চুগঞ্জ প্রতিনিধি, সিলেটভিউ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.