আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

হাকালুকি হাওর আমায় হিজলের কথা বলে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৬-২৮ ২৩:২০:২০

মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন :: হিজল ফুল খুব সুন্দর। সুন্দর তার ঘ্রাণ। হিজল ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে মিলন ও বিরহের মিশ্র অনুভূতি জাগে। হিজল গাছ দূর থেকে কাছে টানে, কাছে গেলে দূরে ঠেলে। হিজলের ডালে ডালে আলো-ছায়ার ভূত খেলা করে। হিজলের বিচির ঘ্রাণ নাকে তীব্র আস্বাদ আনে। বুকের ভেতর হুহু পরাণ প্রিয়জন হারানোর শঙ্কা নিয়ে কাঁপে। বিলের দেশে ছাড়া-ভিটায় ভারী হিজল গাছ অজস্র শাখা ছড়িয়ে শূণ্যে বানায় পালঙ্ক। শিশুদের আরাম করে বসে সময় কাটানোর আসন বিছিয়ে হিজল গাছ যেন চাঁদের হাট বসায়। আমি বলছি আমার দক্ষিণবঙ্গের কথা। আমি আমার বাড়ির পাশে বিলের ধারে জন্মানো ঘন-শ্যামল হিজল গাছের কথা বলছি।

অনেকের স্মৃতি আছে না, শৈশবে হিজলের ডাল ধরে গাছ-মাছ খেলা? গাছ মানে ডাল, মাছ মানে মাটি। একজন চোর হয়ে গাছের তলায় বিচরণ করে আর গাছে থাকা সবাইকে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করে। ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করার সময় অন্য দিক দিয়ে কেউ একজন গাছ থেকে নেমে মাটি স্পর্শ করতে পারলেই চক্র শেষ। কেউ গাছ থেকে নেমে পড়ার আগেই চোর যদি কাউকে ছুঁয়ে দিতে পারে তবে চোর উঠে যায় গাছে আর ছোঁয়া পাওয়া বেচারা চোর হয়ে নেমে পড়ে মাটিতে। আবার খেলা শুরু, আবার ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা, আবার ফাকি দিয়ে মাটিতে নামার চেষ্টা সকলের। সাত চক্র শেষ হলে চোর তখন ডাকাত হয়ে যায়। অমনি সবাই মিলে দুপদাপ কিল চড়াতে শুরু করে ডাকাতের পিঠে। ডাকাত বেচারার বেজায় দুর্দশা হয় তখন। মিলে-মিশে সবাই আবার লটারি করে, নতুন কেউ চোর হয়, নতুন করে খেলা শুরু হয়।

হিজল গাছে কাঁটা নেই, ডালগুলো মোলায়েম, ঘষা লাগলে ব্যথা করে কম। ভূতুড়ে গাছ কিন্তু শিশুদের অভয়ারণ্য। হিজল গাছ তাই শৈশবের পরম বন্ধু, শিশুদের চোখে পরম আদরের ধন। বাড়ির আনাচে-কানাচে, বিলের ধারে পুকুরের পাড়ে নিঃসঙ্গ হিজল গাছ দুরন্ত কিশোরের চোখে বিশেষ স্নেহের বস্তু হয়ে বিরাজ করে। হিজল গাছ ভরা বিলের থৈথৈ পানির ভেতর মায়া ছড়িয়ে দাড়িয়ে থাকে। বিরহী প্রাণে কিশোরের রাতগুলো নিঃসঙ্গ হিজলের ব্যথা অনুভব করে। হিজলের ডালে মাছের খাবার হয়, হিজলের ডালে চুলো জ্বালানোর চ্যালাকাঠ হয়। হিজলের বিচি কেটে বদনার পানিতে ফ্যানা তৈরী করে কতো খেলেছি সাবান সাবান খেলা। সেই খেলাতে মিছামিছি কাপড় ধুয়ে কত করেছি সংসারখেলা। হিজল গাছ জঙলা গাছ। তথাপি দুরন্ত কৈশোরে গাছটির প্রতি সামান্যতম বিরক্তিও অনুভব করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে ভীতির ব্যাপার আছে কিছু। একাধিক কোটর থাকে ডালগুলোর জঙ্ঘায়। কোটরের ভেতর বিষাক্ত সাপ লুকিয়ে থাকে কখনো কখনো। সেই সাপ কাউকে কামড় দিয়েছে এমনটা কোনোদিন শুনি নি।

ভাসমান বৃক্ষ হিজল। ঘন সবুজ, নিবিড় পত্র-পল্লবের রহস্য ছড়ানো গাছ। বর্ষার ভরা বিলে নিঃসঙ্গ দাড়িয়ে থাকে রাত-দিন অষ্টপ্রহরের সাক্ষী হয়ে। বর্ষার শেষে ঠায় দাড়িয়ে থাকে শুকনো বিল আর হাওরের মাঝখানে। হাওরের জলে হিজলের বিচি পড়ে স্রোতের সাথে নদীর পথে ক্রমেই দক্ষিণে ছুটে। ছুটে ছুটে ঘুরেঘুরে অবশেষে আটকা পড়ে আচমকা কোনো ডাঙায়। বিলের দেশে দক্ষিণবঙ্গে ভরা বিলের ভেতর পুকুরের পাড়ের মাটিতে লেগে যায়। গাছ হয়ে বাড়তে থাকে হিজল গাছের ভ্রুণ। ফরিদপুরের বিলগুলোতে এভাবেই জন্মেছে হিজল গাছের সারি। গ্রামের ভেতর বসতবাড়ির কানায় লেগে হিজলের বিচি রুপ নিয়েছে গাছে। আমাদের শৈশব রাঙানো বর্ষীয়ান হিজল গাছগুলোর এই হলো বিত্তান্ত।

পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার 'পল্লী-বর্ষা' কবিতায় লেখেন,
"হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!"

আজ এই হিজল গাছ বিলুপ্ত প্রায়। আগের মত সচরাচর চোখে পড়ে না। যেগুলো দেখা যায় সেগুলোও আছে অতি সংকটে, অনাদরে অবহেলায়। কাঠ হবার উপযোগিতা নেই বলেই কি? সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে ফুলের লতিকা দুলে দুলে হিজল গাছের গায়ে কতোই না রূপের ঝিলিক আনে।
জীবননান্দ দাশের কবিতায় হিজল গাছের নাম এসেছে বাংলার রূপ-লাবণ্য বর্ণনায়। যেমনঃ--
''মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল — বট — তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ''
"তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;"
"সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;"

বিল-বাওড়ের দেশ ফরিদপুরের মানুষ আমি। হাওরের ঘ্রাণ আমি পেয়েছি সেই শৈশব কালে হিজল গাছের গায়ে। আজ এত বছর পর চাকরি সূত্রে হাওরের কাছে এসে অনুভব করছি শৈশবের সেই যোগসূত্র। আমার বাড়ির পাশের চতলবিল আমাদের কাছে সাগর সমান। হাকালুকি হাওরের পেটে অমন দুই শতাধিক বিলের উপস্থিতি রয়েছে। বিলের দেশের মানুষ তাই হাওরে এসে মহাসাগরের অনুভূতি পায়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর দেখেছি তো। মহাসাগরের মুখও হয়েছে দেখা। এই বিপুল জলরাশি তাই হয়তো বিস্ময় আনে না মনে। কিন্তু মেঘে আর পাহাড়ের মিতালিতে হাওরের উপর দিয়ে যে দৃশ্যের জন্ম হয়, এক কথায় সেটা অলৌকিক। অলীক আনন্দের ঝিলিক ওঠে চোখে-মুখে।

হাকালুকি হাওরের ভেতর মাঝে মাঝে দু'একটা হিজল গাছ চোখে পড়ে। হিজলের বাগান, বনভূমির মতো হাওরের ভেতর হিজলের ছড়াছড়ি আজ আর আগের মতো নেই। সাগরের মতো বিরাট জলরাশির সুবিস্তৃত উদোম বুক থৈথৈ অবিরাম। জেলে-নৌকার ছড়াছড়ি। মাঝখানে গ্রাম। উত্তরে মেঘালয়ের পাহাড়, পূর্বে ত্রিপুরার পাহাড়। সারি সারি পাহাড়ের ঘন কালো বেষ্টনী হাওরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে যেন। পাহাড়ী ভূমির ভাটিতে হঠাৎ উপস্থিত গভীর সমতল ভূমিতে জল জমে সাগরের আকৃতি তৈরী হয়। বর্ষাকালে এই জলরাশির চেহারা দাড়ায় ঠিক সাগরের মত। হাকালুকির বুকে সাগরের মহিমা ভাসে। সাগর থেকে নাকি হাওর নামের সৃষ্টি। হাকালুকি আমাকে হিজল গাছের গল্প শোনায়। হাকালুকি আমাদের বাংলার চিরচেনা খেলার সাথী, বৃক্ষ-সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিজল গাছের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। আমি নির্বাক তাকিয়ে তার বুকের উপরের দৃশ্য দেখি একের পর এক। কেবলি দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম হয়।

আজ এই হাওরের পেটে মাছের রমরমা নেই আগের মত। এখন আর সময় মতো বৃষ্টি হয় না। যখন হয়, তখন একসাথে অতিবৃষ্টি হয়। হাওর পানিতে ভরে গেলেও তা স্থায়ী হয় না, তাই জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণীবৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। হাকালুকির চিরচেনা হিজল, করচ, জারুল, বরুণসহ বৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত জলজ উদ্ভিদের অবস্থা বিপন্ন। পানির অভাবে পানিবাহিত প্রজণনের অভাবে অনেক গাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যেমন কিছু গাছের ফল গাছে থাকতেই সেগুলোতে শিকড় গজাতে শুরু করে, সেগুলো বোঁটা ছিঁড়ে নিচে পড়লেই চারা গজানো শুরু করে। নিচে যদি পানি থাকে, ফলগুলো ভাসিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছ জন্মাতে পারে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে এক জায়গায় সব ফল পড়ে। এতে করে তেমন কোনো উপকারই হয় না।

হাকালুকি হাওরের আয়তন একশো একাশি বর্গ কিমি। হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। এই জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারন করে। দেশের বৃহত্তম এই হাওর অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানিরও জলাভূমি। পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত। ছোট-বড় প্রায় আড়াইশোটি বিল ও ছোট-বড় দশটি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় আঠারো হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়।

এখানে এসে একটি বিশেষ ব্যাপারে জানতে পারলাম। সেটি হলো বাথান। হাকালুকি হাওরের বিশাল প্রান্তরে শুষ্ক মৌসুমে অবাধে বিচরণ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। হাওর উপকূলবর্তী এলাকার লোকজন, ফসল উঠে গেলে, বছরের শুষ্ক মৌসুমের নির্দিষ্ট কয়েক মাস তাদের গৃহপালিত গবাদি পশু পাঠিয়ে দেয় হাওরে বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের কাছে, যারা এগুলোর তত্ত্বাবধান করে। এই কাজের বিনিময়ে এরা দুধ পায়। মেয়াদ শেষে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নিয়ে নেয়। এই পুরো ব্যবস্থাকে হাওর এলাকায় 'বাথান' বলা হয়। বাথানের মালিকেরা এসকল গবাদি পশুর দুধ বিক্রী করে প্রচুর উপার্জন করে থাকেন। একারণে হাকালুকি হাওর এলাকা স্থানীয়ভাবে দুধ ও দৈ এর জন্য বিখ্যাত। তবে এ ধরনের গরু বর্গা দিয়ে লালন-পালন করার প্রচলন বাংলাদেশের সর্বত্রই আছে। এক এক অঞ্চলে এক এক রকম। কোথাও টাকা নেয়, কোথাও বাছুর নেয়, কোথাও দুধ-বাছুর দুটোই নেয়। হাওর এলাকায় বাথান ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি প্রথা।

হাওরের নাম হাকালুকি হবার বেশ কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকি দেয় বা লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় 'হাঙ্গর লুকি', ধীরে ধীরে তা 'হাকালুকি'তে পর্যবসিত হয়। আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে 'আকা' নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় 'আকালুকি' বা হাকালুকি। আরো প্রচলিত যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে 'হেংকেল' নামে একটি উপজাতি বাস করতো। পরবর্তীতে এই 'হেংকেলুকি' হাকালুকি নাম ধারণ করে। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাঁদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় 'হাকালুকি' যার অর্থ 'লুকানো সম্পদ'।
সর্বশেষ কারনটি অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হবার যথেষ্ট কারন রয়েছে। তবে অন্য জনশ্রুতিগুলোকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বাংলার নৈসর্গিক অলংকার হিজল গাছের মত সিলেট অঞ্চলের অলংকার হাওরগুলোও সংকটকাল অতিক্রম করছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিরুপ হয়ে চলছে। তারই প্রভাবে হাওরেরও স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে।

ভালো থাকুক রাঙা হিজল, ভালো থাকুক হাকালুকি হাওর, ভালো থাকুক হাওরের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো।
লেখক :: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, বালাগঞ্জ, সিলেট।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন