Sylhet View 24 PRINT

আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-০১ ২১:৪৬:৩৪

মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন :: বরফগলা ঠান্ডা জল নিয়ে আসে পিয়াইন নদী। আসামের উমগট নদী পঁয়ষট্টি কিলোমিটার পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে শীতল জলের স্রোত নিয়ে এসে বাংলাদেশের সীমান্তে ফেলে। ঠিক যেখানটাকে আমরা জাফলং বলে চিনি। পাহাড়ের পরিচিত পথ হারিয়ে উমগট নদী তার নাম ভুলে যায়। আমরা আদর করে ডাকি পিয়াইন বলে। পিয়াইন নদী বাংলাদেশের ভেতর আশি কিলোমিটার প্রবাহিত হবার পর সুরমা নদীর কোলে গিয়ে অস্তিত্ব ভুলে যায়।

ভারতের সীমানার ডাউকি বাজার থেকে অদূরে বাংলাদেশের সীমানায় পিয়াইন নদীর তীরে দাড়িয়ে আকাশে হেলান দেয়া পাহাড়গুলোকে উত্তরের দৃশ্য আড়াল করে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ওপাশে কি আছে, দেখতে পাই না কিছুই। সিলেট থেকে বাসে যেতে যেতে জাফলং এর কাছাকাছি পৌছুলে সুউঁচ্চ পাহাড় সারির যে মালা দেখা যায় সেটা ভারতের সম্পত্তি। মেঘবতী মেঘালয় আসমান ছুঁয়ে দাড়িয়ে। চোখ দিয়ে দেখা যায়, হাত দিয়ে ছুঁইতে মানা, পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

ডাউকি ব্রিজ পার হয়ে কত কত নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়, পর্যটকদের ভাষ্য থেকে জানি, ভাটির নদীতে দাড়িয়ে ওসব চোখে পড়তে পারে না। অলৌকিক দৃশ্যের হাতছানি সব পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। আমরা অসহায় চোখ দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখি, দেখে চোখের তৃপ্তি মেটাই। কত কিছুই তো চোখ দিয়ে দেখি, সব কি আর ছুঁইতে পারা যায়? আকাশের তারা, নীলিমার নীল, চন্দ্র-সূর্য কিংবা রঙধনু। কিংবা তারার ওপাশে, আকাশের ওপারে কি আছে কি না আছে,আমরা কি আর দেখি? পায়ে হাটার পথ যেখানে থেমে যায় সেখান থেকেই মানুষের অসহায়ত্ব শুরু হয়।

মেঘালয়ের পাহাড়সারি কাঁটাতারের বিভেদে অচ্ছূত, অস্পৃশ্য। খাড়া খাড়া পাহাড়ের গা থেকে নিঃসৃত ফেনিল ঝর্ণার দৃশ্য চোখে পড়ে। অজস্র ঝর্ণার সাদা ফোয়ারা দাত বের করে হাসে। ঝর্ণার হাসিতে সারা শরীর জ্বলে-পুড়ে যায়। একদিন পাহাড়গুলো আমাদের কাছে সুগম ছিলো। আজ একেবারেই দুর্গম। সুগম যে ছিলো, থাকার কথা ছিলো আজো, এই তথ্যটুকু না জানাই বরং ভালো ছিলো। পাহাড়গুলোর চূড়া থেকে আসা লাস্য ইশারার চমকে চমকে আহত হয়ে চলি। আহত মনে বিষণ্ন অনুভূতি নিয়ে পিয়াইন নদীর বুক দিয়ে নৌকায় ভেসে চলি। এপার থেকে ওপারে যেতে বাধা নেই কোনো। ঘাট থেকে খেয়া-নৌকা যাত্রী পারাপার করে। ওপারের ভূমিটুকু বাংলাদেশের অংশ। খাসিয়া পল্লীর আদি-অকৃত্রিম পান-পাতার ভিটে।

খাসিয়াদের প্রধান জীবিকা পান-পাতার চাষ। পান তাদের কাছে খুব পবিত্র এবং আদরের জিনিস। মৃতদেহ সৎকারের সময় পুরোহিত যে মন্ত্র পড়ে তার বাংলা অর্থ, 'বিধাতার রাজ্যে গিয়ে তুমি পান খাবে'। খাসিয়া পানের খ্যাতি জগৎ জোড়া। এখানকার শতকরা আশি ভাগ পান বিদেশে রপ্তানী হয়। পান বিক্রি করতে খাসিয়াদের বাজারে যেতে হয় না। পাইকাররা এসে নিয়ে যায়। বাগান থেকে পান তুলে আনার কাজটি সাধারনত পুরুষরা করে। বাড়িতে বসে নারীরা পান পাতা গুছিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে রাখে। পান বিক্রির টাকাও যায় তাদেরই হাতে।

খাসিয়াদের ইতিহাস খুবই বিচিত্র। বলা হয় প্রায় সাতশো-আটশো বছর আগে তারা এই অঞ্চলে আগমণ করে। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভূখন্ডে আশ্রয় নিয়েছিলো যারা, তারাই আজ বাংলাদেশের নাগরিক। বলা যায়, ইতিহাসের আকস্মিক উলোট-পালোটের শিকার হয়ে ছোট্ট দেশটির সীমানায় বন্দী হয়ে গেছে। তারা জঙল পছন্দ করে, জঙলেই তাদের সাবলীল বিচরণ। ঘন জঙলের নিবিড় বনভূমি, হোক সমতল হোক পাহাড়ী, তাদের বসবাসের জন্য আদর্শ জায়গা। এই সূত্রে একটি মজার তথ্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্য-অনার্য যুদ্ধ একটি বহুল প্রচলিত অধ্যায়। আর্যদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠতে না পেরে অনার্যরা পালিয়ে যায় গভীর অরণ্যের ভেতর। সেই থেকে তারা ঘণ জঙলের সাথে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়, অভিযোজিত হয়। সেই অনার্যরাই কি আজকের পাহাড়িরা? এটি একটি গভীর নৃতাত্ত্বিক প্রশ্ন।

বাংলাদেশে সাকুল্যে যে ছয়টি পুঞ্জির খাসিয়া জনগোষ্ঠীর বাস তার চারটিই বাস করে সিলেটের জাফলং এ। এখানে এলে মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া জাতির জীবন ও সংস্কৃতি খুব কাছে থেকে দেখা যায়। সহজ-সরল খাসিয়া জনতা মানুষের সাথে ভালো ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত। নীতি-আদর্শ আর পরোপকারের স্বভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে তাদের শিশুরা। শিশুদের শিক্ষার জন্য তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়লো যেতে যেতে।

বল্লাপুঞ্জি, সংগ্রামপুঞ্জি এবং নকশিয়াপুঞ্জি নামে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা পৌছে যাচ্ছে খাসিয়া শিশুদের কাছে। তবে মাতৃভাষা বাংলা না হওয়ায় ভাষাগত একটি সংকট এখানে প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয়। এক সময় খাসিয়াদের ভেতর পড়াশোনার আগ্রহ ছিলো না বললেই চলে। পানের পাতায় রুটি-রুজির পর্যাপ্ত আশ্বাস ছিলো। আজ সেদিন পাল্টেছে। পড়াশোনা করে মূলধারার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টায় চাকরি-বাকরির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে তারা। দক্ষিণ দিকের বিস্তৃত চা-বাগানেও কাজ করে অনেকেই। মূলধারায় পিতৃতন্ত্র আর খাসিয়াদের মাতৃতন্ত্র, দুই সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ায় পারিবারিক স্থিতাবস্থা মাঝে মাঝে ঝুঁকির মুখে পড়ে। কিন্তু খাসিয়াদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য এবং জাতীয় বিশুদ্ধতার তাগিদ থেকে আজো তারা ধরে রেখেছে তাদের বংশগত সংস্কৃতি।

নাঁচ-গানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে খাসিয়াদের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সর্বজনবিদিত। গোষ্ঠী তথা পুঞ্জির প্রধানকে এরা মন্ত্রী সম্বোধন করে। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন মেনে চলার পাশাপাশি পুঞ্জি প্রধানকেও খুব মান্য করে চলে। ধর্মীয় পরিচয়ে বেশিরভাগ খাসিয়া প্রোটেস্টান্ট খ্রীস্টান। কিছু আছে সর্বপ্রাণবাদী। এদের হিন্দু হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্ক এক গোত্রের ভেতর হয় না। মেয়ে পক্ষ থেকে মেয়েদের বরযাত্রী গিয়ে বরকে বরের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে। স্বামী থাকে স্ত্রীর কর্তৃত্বে। খাসিয়াদের সম্পত্তির ভাগ পায় না ছেলেরা, ছোট মেয়ের উত্তরাধিকার থাকে মায়ের সবটুকু সম্পত্তির উপর।

বিস্তৃত পানের বাগান পার হয়ে সামনে যেতে থাকলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম পানতুমাই গ্রাম। পাহাড়ি স্বচ্ছ জলের ছড়া পেরিয়ে গাঁয়ের মেঠো পথ, বাঁশ বাগান। হাঁটু জলের নদী পার হয়ে প্রতাপ্পুর গ্রাম। এর পরের গ্রাম পানতুমাই। প্রতাপ্পুর গ্রাম পাড়ি দিয়ে সামনে উঁচু পাহাড় ঘেঁষে বিশালাকার এক ফুটবল মাঠ পাওয়া যায়। মাঠ পেরিয়ে কিছুটা জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতর কিছুটা এগুলেই শোনা যায় জল গড়িয়ে পড়ার কলকল শব্দ । জঙ্গলের মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে রূপবতী ঝরনা পানতুমাই। বড় বড় পাথরের গা বেয়ে অনেক উঁচু থেকে ইংরেজি এস অক্ষরের মতো এঁকেবেকে পড়ছে। স্থানীয়রা ঝরনাটিকে ফাটাছড়ির ঝরনা বা বড়হিল ঝরনাও বলে। কিছু দূর সামনে এগিয়ে গেলে হঠাৎ দেখা মেলে সতর্কবাণী লেখা সাইন বোর্ড 'সাবধান সামনে ভারত, জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ'। এই হয়েছে জ্বালা। সুন্দর শুধু কাছে টানে, যেতে দেয় না কাছে। জাফলং এর দৃশ্যগুলো যেন বিরহী পরাণের হাহাকার নিয়ে ভাসে। চির বিরহের গল্প বলে বেড়ায় আকাশে হেলান দেয়া পাহাড় আর পাহাড়ী ঝরণার সারি।

অপরূপ ঝরণার কাছে যেতে না পারা, পিয়াইন নদী সাতরে পাহাড়সারির ভেতর প্রবেশ করতে না পারা, দুই পাহাড়ের মাঝে ডাউকি ব্রিজে চড়তে না পারা আর মনোহর ডাউকি বাজারে গিয়ে চা খেতে না পারার কষ্ট বুকে নিয়ে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর দিকে তাঁকিয়ে থাকি আর ভাবি, কাজি নজরুল কি এখানে এসেই লিখেছিলো সেই গান, 'আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ'? সেটা সীমানা ভাগের আগের কথা। আজ এই যুগে আমার মত বিরহীর চোখ দিয়ে তাকালে পাহাড়গুলোর ঘুম তার কাছে কিসের মত মনে হতো? শুধু ভাবি। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ঐ সুন্দরের কাছেও যেতে মানা।

‘রূপের ঝিলিক মেরে আমায় ডেকে এনে কাছে
অদৃশ্য আড়াল রেখে ছুঁইতে দিলো না পাছে।’

হয়তো বিরহের মধ্যেও রয়েছে অসহ্য-অনাবিল সুখ। বিরহের সুখ মনের ভেতর যে মাদকতা আনে, তারই টানে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। দলে দলে ছুটে আসা মানুষ হৈ-চৈ করে কিছুটা সময় এখানে কাটায়। অপরূপ দৃশ্য আর ঠান্ডা জলের নীচে পাথরের স্পর্শ পেতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ছুটে আসে জাফলং এ। পাহাড়ের নদী বেয়ে পাথর এসে পড়ে এদেশের সীমানায়। পাথর কুড়িয়ে অনেক মানুষের জীবিকা চলে। তামাবিল স্থলবন্দর একেবারেই কাছে। প্রতিদিন শত শত ভারতীয় ট্রাক ভরে পাথর আসে এদেশে। পাথর নামানো-উঠানো আর স্টোনক্র্যাশারের শব্দে পুরো এলাকা সারাক্ষণ ব্যস্তমুখর হয়ে থাকে। পিয়াইন নদী থেকে উঠে এসে ব্যস্তমুখর তামাবিল পার হয়ে বিরহী-পর্যটক ফিরে চলে সিলেট শহরের অভিমুখে।

লেখক : সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, বালাগঞ্জ, সিলেট।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.