আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গোবিন্দ ধর: একজন সংগঠক ও উচ্চারণের কবি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-০৩ ১৪:৪৮:২৬

বামে গোবিন্দ ধর ও ডানে লেখক সঞ্জয় দেবনাথ

সঞ্জয় দেবনাথ :: গোবিন্দ ধর। ত্রিপুরার একজন শিক্ষক, কবি, প্রকাশক, নাট্যকর্মী, গল্পকার, সর্বোপরি একজন প্রগতিশীল লেখক, সংগঠক। যেনো এক শব্দের কড়াই। জ্বলন্ত উনুনে শব্দগুলো পুড়ে পুড়ে সেখানে তৈরি হয় এক কঠিন ইস্পাত। যে ইস্পাতে সভ্যতা বিনির্মিত হয়। কালি ও কলমের সত্তাগুলো শাণিত হয়। সময়কে ধারণ করার, সময়কে উল্টোপথে দ্রোহী করে তোলার অগ্নিমন্ত্র তাঁর শিরায় শিরায়। বহুমাত্রিক ধ্যান-জ্ঞান যার মস্তকে অহর্নিশ সাধনায়রত। তাইতো গোবিন্দ ধর হয়ে উঠেন সকলের প্রিয়। আবার একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে সর্বজনের প্রিয় হয়ে ওঠা তাঁর ধাতে সয়না। তিনি হয়ে যান সবহারাদের কবি। এখানেই তাঁর চিন্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সৃজনশীলতা।

একজন মনীষী বলেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষ তার জন্মকাল থেকে সমান।’ আমরা বুঝতে পারি, মানুষের এই বিভাজিত-বৈষম্যের বেড়াজাল সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা সৃষ্টি করে। মানুষকে দেয়াল আর কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে দেয়। কিন্তু পাখির ডানার স্বাধীনতা কোনকালে কেউ রুখ্তে পেরেছে কী? স্বপ্নকে কেউ আটকাতে পেরেছে? পারেনি। প্রাণের অভিব্যক্তি আর অনুসন্ধিৎসু মনের দুর্বার অনুসন্ধান যার মনন-মগজে গ্রোথিত তাকে তো রুখা যায়না। গোবিন্দ ধর সেই স্বকীয় বোধে ছুটছেন উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ‘স্রোত’ নামক প্রকাশনার স্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমগ্র ভারতবর্ষসহ বহির্বিশ্বে। একীভূত হওয়ার শ্লোগানকে অঙ্গীভূত করে প্রতিষ্ঠা করতে চান সাহিত্য-স্বরাজ মানুষের মনন-মেজাজে। তাঁর এই বোধের মিছিলে সাঁতার দিতে প্রস্তুত প্রাণ-প্রকৃতি। গোবিন্দ ধরের লেখা ছাপা হয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের অনেক পত্রিকায়। তাঁর লেখায় মানুষ আর প্রাণের ক্রম বিকাশের ইতিহাস সে তো প্রবাহমান স্রোতধারার আওয়াজ মুখরিত।

বিদগ্ধজনের কাছ থেকে গোবিন্দ ধর একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। গুণের কদর না করলে গুণী সৃষ্টি হয় না- এই আপ্তবাক্যে লেগে পড়ে থেকে মানুষকে সম্মানিত করেছেন বারংবার। গত ২৫ মে আগরতলার সুকান্ত একাডেমীতে স্রোতের রজতজয়ন্তী প্রকাশনা উৎসব হলো। সেখানে দক্ষিণারঞ্জন ধর স্মৃতি পুরস্কার পেলেন কথাশিল্পী শ্যামল বৈদ্য। স্রোতের সব শাখা কমিটির সদস্যসহ কবি-সাহিত্যিকদের সম্মান জানানো হলো। আর এ সবকিছুর মূলে ছিলেন গোবিন্দ ধর। আমার মতো এক ক্ষুদ্র অভাজনের তাঁকে কাছ থেকে দেখার এবং তাঁর ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে এ অনুভবগুলো মোটেও অতিশয়োক্তি নয়। এটা তাঁকে যারা জানেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন। গোবিন্দ ধরকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায়। ইতোমধ্যে অনেক সৃষ্টিশীল প্রাজ্ঞজনেরা তাঁর সম্বন্ধে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনসহ অনেক প্রখ্যাত লেখক লিখেছেন।

‘এক বইয়ের পাঠক সম্পর্কে সাবধান’ হুমায়ুন আজাদের বই প্রণিধানযোগ্য উক্তিটি আমাদের ভাবাদর্শে ভীষণ নাড়া দেয়। এই কারণে যে, যারা শিল্পী না হয়ে শিল্পের সমালোচনা করেন, তারা শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। গোবিন্দ ধর এক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই ‘সার’ বিষয়টি বুঝেছেন বলেই তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত। দিনমজুর থেকে গণমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠা দ্রোহী বোধে শিল্পের আগুন থাকা স্বাভাবিক। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের কবি, সম্পাদক, লিটলম্যাগ কর্মী, এইরকম বহু অভিধায় ভূষিত হওয়া গোবিন্দ ধর, জলঘর, সূর্যসেন লেন, মনসুন মাছি, দ্রোহবীজ পুতে রাখি; একা, শ্রীচরণেষু বাবা, দেওনদীসমগ্র, আনোয়ারা নামের মেয়েটি, আষাঢ়ের দিনলিপি’র মতো কবিতার বই প্রকাশ এবং স্রোত,  কুসুম, কবিতাঘর, বইবাড়ি, অন্যপাঠ প্রভৃতি কাগজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও যৌথ কবিতা সংকলন, ছড়া সংকলন, শ্রীহট্টীয় লৌকিক সংস্কৃতি ও শব্দকোষ এর মতো অসংখ্য প্রবন্ধ ও গবেষণাসহ ভিন্ন স্বাদের বই বের করেছেন। ভিয়েতনামের মহান বিপ্লবী হো চি মিনের ভাষায়- ‘আমাদের কালের কবিতাকে সাজাতে হবে ইস্পাতের অস্ত্রেবর্মে। কবিদের শিখতেই হবে লড়াই করতে।’ গোবিন্দ ধরের সেই বোধ সত্তায় স্নাত হওয়া কবিতাগুলোও মানুষের ভেতরের মানুষকে লড়াই করতে শেখায়।

ভাবি এই বুঝি সব ভালো হয়ে উঠবে
আমিও ভালো হয়ে যাবো
ঠিক ভালো মানুষের মতো
দেখি সকল মানুষদের মানুষ করে
মানুষের মতন দেখি
মানুষের চোখ দিয়ে দেখি
মানুষের ভিড়ের ভেতর মানুষগুলো
এক একজন
মানুষের অবয়ব হাত পা
চোখ নাক
সব অবিকল মানুষ।

তাঁর ‘নিজেই নিজের কাছে’ কবিতার পংক্তিগুলো সরল অনুভবে ভরে তুলে হৃদয়ের উঠান। যা একান্তই মানুষের। শব্দ দিয়ে ভিতর বাহিরের বিচ্ছিন্ন শরীরকে এক করার ব্রত নিয়ে মানুষের গল্প বলা গোবিন্দ ধরকে কখনোই থামানো যাবেনা। যেমন থামানো যায়না প্রবাহিত স্রোতধারাকে এটা আস্থার সহিত বলতে পারি।

লেখক: কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন