Sylhet View 24 PRINT

শাহজালালের দেশে সার-কারখানায় এসে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-০৪ ২২:৪৩:২০

:: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::

মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি দেখে সারাদিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দিনটা শুক্রবার। ছুটির আয়েশে ঘুরে বেড়ানোয় বেজায় মজা। বালাগঞ্জ থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ বাসে চড়ে যাত্রা। বামে হাওর, ডানে কুশিয়ারা নদী। খানিক পর হাওর শেষ হলেও কুশিয়ারা নদী রাস্তার ডান পাশ ধরে একেবারে ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেলো। বৃষ্টিমুখর সকালটা অপরূপ মায়ায় ভরা। স্নিগ্ধ এক অনুভূতি ভর করে আছে মনে। রোদহীন এই গরমকালে একটু ঠান্ডার পরশের জন্য আকুল থাকে পরাণ। সেটি আজ ষোল আনা পাওয়া যাচ্ছে। দৃশ্য সকল বৃষ্টিতে ভিজে ঝকঝকে তকতকে হয়ে আছে। হেলেদুলে বাস চলছে। খানিক পরপরই যাত্রী উঠা-নামা করছে। ধীরগতিতে বাসটা চলছে দেখে মন্দ লাগছে না। সময়ের তাড়াহুড়ো নেই। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত অফুরন্ত সময় রয়েছে। বাসটা আধাঘন্টার পথ দুই ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে চানপুর পৌছুলো। বাস থেকে নেমে সিলেট থেকে আসা আরেকটা বাসে উঠলাম। নামলাম সারকারখানার সামনে। শাহজালাল ইউরিয়া সারকারখানার মেইনগেটে দাড়িয়ে গ্রামদেশের ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার জাহিদকে ফোন দিতেই গেটে গাড়ি পাঠিয়ে দিলো। ওর বসের গাড়ি। জাহিদ এখানে চৌদ্দ সাল থেকে চাকরি করছে। ড্রাইভার এসে আমাকে খুঁজে নিয়ে গাড়িতে বসালো। গাড়ি আমাকে নিয়ে গেলো প্রশাসনিক ভবনের সামনে। জাহিদ এসে রিসিভ করলো। তারপর নিয়ে গেলো প্রধান প্রকৌশলীর অফিস কক্ষে। প্রধান প্রকৌশলী বিল্লাল হোসেন একজন পরিশীলিত মানুষ। দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে তার ভাবনাটি আমাকে মুগ্ধ করলো। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দেখে খুব খুশি। সরকারি চাকরি করতে গিয়ে সকলেরই দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকা উচিৎ। কাজে-কর্মে, চিন্তা-চেতনায় দেশপ্রেম না থাকলে নিমকহারামি করা হয়। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। লোকটা আমার চাকরির ধরন সম্পর্কেও দেখলাম বেশ ওয়াকিবহাল। আমাদের চাকরিতে সুবিধা-অসুবিধা, প্রতিবন্ধকতা, বিড়ম্বনা সম্পর্কে অনেক কিছুই বললেন আমাকে। অনেক ক্ষণ ধরে একটা মুগ্ধতার রেশ লেগে থাকলো আমার মনে।

বৃষ্টি একটু থেমেছে মনে হলো। চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবার আমাকে কারখানাটা ঘুরে দেখতে অনুরোধ করলেন। জাহিদকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। অতপর আমি আর জাহিদ অফিস কক্ষ ত্যাগ করে কারখানার দিকে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে দেখতে দেখতে আবার বৃষ্টি। এমোনিয়া গ্যাসের বিরাট রিজার্ভারের নিকট একটা ছাঁদ পেয়ে মাথা বাঁচাতে দাড়িয়ে পড়লাম। টানা একঘন্টা দাড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করলাম বৃষ্টি থামার। বেশ আদ্র আদ্র লাগছে সব। বৃষ্টিভেজা দৃশ্যের ভেতর গরম কারখানাটিকে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। উদোম মাঠের ভেতর খাড়া দাড়িয়ে থাকা প্লান্টগুলোকে স্টাচুর মতো দেখাচ্ছে। রাস্তার পাশে একটু পরপর হাইড্রান্ট স্থাপন করা। যেকোনো জায়গায় হঠাৎ আগুন লাগলে হাইড্রান্ট খুলে পানি ছুড়ে ত্বরিত আগুন নেভানো যায়। অন্যান্য সারকারখানার মতো এখানেও নিজস্ব বিদ্যূত প্লান্ট রয়েছে। এই প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যূত দিয়ে কারখানা এবং আবাসিকের সবটুকু চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। লোডশেডিং বলে কিছু নেই এখানে। তবে আকাশ থেকে বড় আকারের বজ্রপাত হলে নাকি মুহূর্তে সব বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তিনদিন লাগে পুনরায় চালু করতে।

কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ফেঞ্চুগঞ্জ ইউরিয়া সারকারখানা। দুহাজার এগার সালে শাহজালাল সারকারখানা নামে যাত্রা শুরু করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির উদ্বোধন করেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন পরিবেশবান্ধব সার কারখানাটি বাংলাদেশের ষষ্ঠতম সার কারখানা। প্রতিদিন সতের হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে বিসিআইসির তেরটি প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে যার মধ্যে ছয়টিই হচ্ছে ইউরিয়া সার কারখানা। এই ছয়টি ইউরিয়া সার কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা তেইশ কোটি এমটি। পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে সারকারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রতিবছর শুধু এক মৌসুমে ত্রিশ লাখ এমটি। এই চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সার কারখানা নামে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সার কারখানা নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো, যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা পৌনে ছয় লাখ এমটি। চাহিদার তুলনায় সারের উৎপাদন খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের কৃষিতে ব্যবহারের জন্য বেশিরভাগ সার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এই খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমান অনেক বেশি। শাহজালাল সারকারখানার সার উৎপাদন খরচ প্রতি বস্তা নয়শো পঞ্চাশ টাকা। সরকার কৃষকের হাতে পৌছে দেয় সাতশো টাকা বস্তা দরে। এভাবে বিপুল পরিমান ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। এই ভর্তুকিকে কোম্পানির ক্ষতি হিসেবে দেখানো হয়। সারকারখানাগুলোর লাভের মুখ দেখা তাই সুদূরপরাহত।

গ্রামের ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার জাহিদের সুবাদে কারখানা ও সার-উৎপাদনের খুটিনাটি সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করলাম। হযরত শাহজালালের পূণ্যভূমি সিলেট এলাকায় চাকরি করতে এসে আমারও কিছু পূণ্য সঞ্চয় হচ্ছে বটে। সারা জীবন বইয়ে পড়া বর্ণনার সাথে চোখের দেখা মিলিয়ে নেবার অপূর্ব সুযোগ। জাহিদ আমাকে সার উৎপাদনের ক্রিয়া-কৌশল হাতে-নাতে বুঝিয়ে দিতে থাকলো। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বুঝতে আমার কোনো সমস্যাই হয় নি। কেমন করে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্যাস সংগ্রহ করা হয়, অতপর মিথেন(প্রাকৃতিক গ্যাস) থেকে হাইড্রোজেন আলাদা করে নাইট্রোজেনের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। তৈরি হয় এমোনিয়া গ্যাস। এমোনিয়া গ্যাসকে তরলীভূত করে কার্বনডাই অক্সাইড ও ইস্টিমের সাথে বিক্রিয়া করানো হয়। বিক্রিয়াতে ইউরিয়ার অনু গঠন হয়, তরল ইউরিয়াকে পাঞ্চ করে দানা দানা সার প্রস্তুত হয়। এইসব প্রক্রিয়ার প্লান্টগুলোসহ সকল বিষয় ছোট ভাই তুলে ধরলো আমার সামনে। এই যে বিপুল লোহালক্কড়ের পাইপ ও হলারের স্তুপ, সব কেমন বোধগম্য হয়ে গেলো। তাবৎ কারখানাটিকে নিতান্তই ইস্পাত-লোহার সমাহার মাত্র মনে হবার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম। আড়াই কিলোমিটার দূরের কুশিয়ারা নদীতে বস্তা বস্তা সার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিতায় ভেসে পৌছুনোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অচিরেই নদীতে জাহাজ এসে সারবোঝাই হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌছে যাবার প্রক্রিয়া চালু করা হবে। গোডাউনে সঞ্চিত দানা ইউরিয়ার স্তুপ থেকে স্বয়ংক্রিয় মেশিন দ্বারা পূর্ণ করে বস্তা বস্তা সার ট্রাকে করে পাঠানো হচ্ছে এখন। কৃষির প্রাণ এই সার। ইউরিয়া সার আবিষ্কার হবার পর পৃথিবী থেকে দুর্ভিক্ষ বিদায় নিয়েছে। ইরি ধান ও ইউরিয়া সার-- পৃথিবীর মানুষের ক্ষুধা দূর করেছে।

এখানে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে সরাসরি পরিচিত হলাম। তাহলো ইটিপি। ইটিপি হচ্ছে একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত পানি পরিশোধিত করা হয়। এর মাধ্যমে দুষিত পানি কে বিশুদ্ধ করা হয় । ইফ্ল্যুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। অর্থাৎ তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার। খাবার পানি পরিশোধন আর কারখানার বর্জ্য-পানি পরিশোধনে পার্থক্য অনেক। নদীর পানি পরিশোধন করে স্বাস্থ্যকর বানানো হয়, কারখানার বর্জ্য পরিশোধন করেও খাবার উপযোগী করা হয়। খাবার উপযোগী পানি মানে পরিবেশবান্ধব পানি। পরিশোধিত তরল, বিশুদ্ধ পানি হয়ে পরিবেশে মিশে গেলে ক্ষতি নাই। কিন্তু কারখানার বর্জ্য-তরল পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

শাহজালাল সার কারখানায় যে ইটিপি রয়েছে সেটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কাজ করে। প্লান্টে রাখা ব্যাকটেরিয়ার দল তরল বর্জ্য থেকে সকল আবর্জনা খেয়ে ফেলে। পড়ে থাকে বিশুদ্ধ পানি। সেই পানি পরিবেশে নিষ্কাশিত হয়। রাসায়নিক আবর্জনা খেয়ে খেয়ে ব্যাকটেরিয়ার দল দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিদিন পরিমান মতো গ্রুকোজ দেয়া হয়। গ্লুকোজ খেয়ে সবল হয়ে ওঠে ব্যাকটেরিয়া। ফলে বর্জ্য থেকে পুনরায় আবর্জনা খেতে থাকে।  ইটিপি কয়েক প্রকারের আছে। রাসায়নিক দ্বারা, জৈব প্রক্রিয়া দ্বারা ইত্যাদি উপায়ে ইটিপি কাজ করতে পারে। প্লান্ট বিদ্যূত দিয়ে চালাতে হয়। সৌর বিদ্যূতে চললে ব্যয় সাশ্রয়ী হয়। আমাদের দেশের ব্যক্তিগত মালিকানার কারখানাগুলো খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ইটিপির ব্যবহারে নিরুৎসাহ দেখায়।

কারখানার সাথে নদীর যোগ রাখা হয়। পণ্য পরিবহনের সুবিধার কথা ভেবে সাধারনত নদীর পাশে নির্মিত হয় কল-কারখানা। আমাদের দেশের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে শুরু থেকেই শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে থাকে। এই নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শত শত মিল-কারখানা। ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা। এই দুটি নদী সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। চট্রগ্রামের কর্ণফুলি নদীও মারাত্মক দূষণের শিকার। পত্র-পত্রিকা মারফত জানা যায়, সরকারি নির্দেশনার পরও, নারায়ণগঞ্জের দুই শতাধিক শিল্প কারখানায় চালু হয়নি ইটিপি প্লান্ট। আবার, যেসব কারখানায় এ প্রযুক্তি রয়েছে, সেগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে কেমিকেল ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি। এমনি করে বাংলাদেশের নদী তীরবর্তী কারখানাগুলোর তরল বর্জ্য নদীতে মিশে ক্রমাগত দূষিত করে চলছে নদীগুলোকে। যেই নদীর পাড়ে কোনো কারখানা নেই সেই নদীও হচ্ছে দূষণের শিকার, কেননা দূষিত নদীর পানি এই নদীগুলিরও ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গে এসে আরেকটি দূষণকারী বস্তুর কথা মনে পড়ে গেলো। পলিথিন। শহর এবং গ্রামে দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন। সহজে পঁচে না। পাঁচশো-হাজার বছর অক্ষত থেকে যায়। ফলে বাস্তুসংস্থানের অংশ হতে পারে না, রুপান্তরিত না হওয়ায় দীর্ঘকাল ধরে ইকোসিস্টেমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে থাকে। পলিথিন শহরে জলাবদ্ধতার একটি অন্যতম কারন। পলিথিন জলে ভেসে নদী দিয়ে সাগরে চলে যায়। সাগরের তলদেশে ইতিমধ্যেই জমা হয়েছে পলিথিনের বিরাট স্তুপ। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে এরকম স্তুপের আয়তন নাকি পুরো অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের সমান! বিভিন্ন পঁচনশীল বর্জ্য বাস্তুসংস্থানের অংশ হতে পারে। কিন্তু বর্জ্যের পরিমান যদি বেশি হয় এবং উপর্যুপরি জমা হতে থাকে, তাহলে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। যেমন শহরে এই ব্যাপারটি দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামে পঁচনশীল বর্জ্য বাস্তুসংস্থানের অংশ হবার সুযোগ পায়। তবে পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে গ্রামগুলি মুক্ত নয়। বর্জ্য দ্বারা দূষণ প্রতিরোধে দরকার শক্তিশালী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে জাপান দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদাহরণ হতে পারে। জাপান বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সারা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। আমাদের মত স্বল্পোন্নত দেশের সেই সক্ষমতা নেই। তবে শুরুটা তো করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এই ভাবনাটি শুরুও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটু জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। শহরে ব্যবস্থাপনা কাঠামোটি তৈরি হয়েই আছে। পৌরসভা, সিটিকর্পোরেশন প্রভৃতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটিকে সর্বোচ্চ গুরত্ব দিয়ে থাকে। এই কাজে তাদের যন্ত্রপাতি, লোকবল এবং প্রচারনার চর্চা অব্যাহত আছে। দরকার আধুনিক আরো প্রযুক্তি এবং পর্যাপ্ত লোকবল। সেই সাথে প্রতিটি নাগরিককে প্রচারণার আওতায় নিয়ে আসা।বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যমান আইনগুলোকেও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।

প্রতিটি বাসা বাড়িতে, দোকানপাটে তিন ধরনের ঝুড়ি থাকতে পারে। একটিতে পঁচনশীল বর্জ্য, আরেকটিতে কাঁচের বর্জ্য এবং অপরটিতে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য রাখা হবে। পৌরসভার লোকজন বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে এবং পুনরুৎপাদনের কাজে লাগাবে। এই মুহূর্তে ঝুড়িতে করে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ চলমান আছে। কিন্তু সব বর্জ্যকে একই শ্রেণির গণ্য করে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা হয়। কাঁচ, প্লাস্টিক, পলিথিন ভাগাড়ে গিয়ে শুধু জায়গা দখল করে পড়ে থাকে, পুনরুৎপাদনের কাজে লাগে না, পরিশেষে অপচয়ের নমুনা হয়। আলাদা করে সংগ্রহ করলে পুনরুৎপাদযোগ্য বর্জ্যকে উৎপাদনের কাজে লাগানো যেতে পারে। পুনরুৎপাদনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সেটি এখনো হয় নি বাংলাদেশে। পুনরুৎপাদন কারখানা এবং কাঠামো গড়ে তুললে বাকি কাজটুকু খুবই সহজ। পরিবেশ ও নদী-সমুদ্র দুষণ থেকে রক্ষা পাবে দেশ। সম্প্রতি পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ তৈরি শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করা পাটের তৈরি সোনালী ব্যাগ আমাদের আশান্বিত করে। এই ব্যাগ পঁচনশীল এবং সাশ্রয়ী। পঁচনশীল হলেও রিসাইক্লিং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরত্ব কিন্তু কমে না তাতে। কেননা সোনালী ব্যাগও পুনরুৎপাদনযোগ্য। এটি করা হলে ব্যাগের উৎপাদন খরচও কমে আসবে এবং পলিথিনের চেয়ে সাশ্রয়ী হবে।

আরেকটি বড় ধরনের দূষণ তৈরিকারী উৎপাদন প্রক্রিয়া হলো ইটভাটা। ইটভাটায় কাঠ এবং কয়লা পুড়িয়ে আগুন তৈরি করা হয়। কাঠ ও কয়লা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রচুর কার্বন ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস বহন করে। গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া তৈরির পাশাপাশি আশপাশের পরিবেশকেও ভয়ংকর রকম দূষিত করে। পুরোনো আমলের ইটভাটা বাদ দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে ইট তৈরি প্রক্রিয়া চালু হলে এর থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে। তার উপর রয়েছে মাটির ব্যবহার জনিত ক্ষয়ক্ষতি। চাষের জমির উপরিভাগ থেকে ইট তৈরির মাটি তুললে জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সেটাই করা হচ্ছে।

পরিবেশ সুরক্ষায় অটো ইট উৎপাদনের পরিবেশবাদ্ধব আধুনিক মেশিন ব্যবহারের দিকে মনোযোগ বাড়ানো দরকার। হাইব্রিড হফম্যান কিলন, জিড়জ্যাগ কিলন, ভারটিক্যাল স্যাফট ব্রিফ কিলন এবং টানেল কিলন মেশিন। এসব মেশিনের গুন হচ্ছে, জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশ দূষণ কম হয়। তবে টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান ভাটায় আধুনিক মেশিনের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইট প্রস্তত করা হয় বলে এই দুটি ভাটায় প্রতিটি ইট প্রস্তুতের জন্য তুলনামূলক কম কয়লা ব্যবহার প্রয়োজন হয়। ফলে পরিবেশ দূষণও কম হয়। কৃষিজমি, ভূ–উপরিভাগের মাটি ও পানির ব্যবহার কমানো, ইট প্রস্তুতকারীদের লাভ নিশ্চিত করা এবং কর্মরত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি সাধন করার মাধ্যমে ইটভাটা জনিত দূষণ বহুলাংশে কমানো সম্ভব। সবচেয়ে বেশি জরুরী ইটভাটা আইনের প্রয়োগ।

আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নের রোলমডেল হবার সুবাদে পরিবেশ দূষণ রোধ করা এখন সময়ের দাবি। মানব সম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সুন্দর-স্বাস্থ্যকর এবং সবুজ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটছে। ডিজিটালাইজেশনের কল্যাণে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। পরিবেশ দূষণ রোধ করে সুস্থ দেহে সুন্দর মন নিয়ে আগামী দিনের শিশুদের বেড়ে উঠার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

ইউরিয়া সারকারখানা ঘুরে দেখা শেষ হলে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আবার বৃষ্টি। মাথায় হেলমেট দিয়ে গেট পর্যন্ত পৌছুলাম। আমার কাছে থাকা অতিথির গেটপাশটি মূল গেটে জমা দিয়ে বের হলাম। বাইরে এসে ইঞ্জিনিয়ার ছোট ভাইকে বিদায় দিয়ে ফিরতি গাড়িতে চড়ে বসলাম। ততোক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে অবস্থা আমার। মনের ভেতর অপূর্ব তৃপ্তির অনুভূতি। একটা উজ্জ্বল দিনের সাক্ষর থেকে গেলো আমার স্মৃতির মণিকোঠায়।

লেখক : সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.