আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ইং

চায়ের দেশের চায়ের কথা, পানের কথাও বলতে হয়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-১১ ২২:৩৩:০৯

:: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::

সমরেশ মজুমদারের 'সাতকাহন' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপাবলী চরিত্রটি চা-বাগান থেকে উঠে এসেছে। বাপ চাকরি করতো চায়ের বাগানে। দশ বছরের বালিকা বাপের আদরে বড় হয়ে জীবনের অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। বহু বাক আর ঠিকানা বদল করার পরও তার স্মৃতিতে অম্লান থেকে যায় চাবাগানের দুরন্ত শৈশব ও স্মৃতি। দীপা এক খাপ না-খাওয়া মানুষ। চির-বিদ্রোহি নারীর প্রতীক। কিছুতেই হার না-মানা দুঃসাহসী নারী। চা-বাগানের অক্লান্ত পরিশ্রমী শ্রমিকদের চাক্ষুষ মানবী পরবর্তী জীবনে অসীম তেজ ও সাহস নিয়ে দুর্বার লড়াই চালিয়ে এগোতে থাকে। সদা অটল ধনুর্ভঙ্গ পণ, মরন-পণ সংগ্রামী মানুষের জীবন কেমন হতে পারে, দীপাবলী চরিত্র আমাদের সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।

আমরা জানি, গোড়ার দিকের চা-বাগানগুলো অসংখ্য মানুষের অমানুষিক শ্রমে ও ঘামে গড়ে উঠেছে। অসংখ্য মানুষ ঠিকানা বদল করে এসে চা-বাগানে কামলা খেটেছে। তিলতিল করে সাহেবদের ফরমায়েশ মোতাবেক বাগান গড়ে তুলতে ও চা উৎপাদনের কাজে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছে। এই খাটুনি খাটতে হয় আজো। উঁচু-নিচু, ঢালু ভূমির বাগান থেকে চা তুলে আনার কাজ খুব পরিশ্রমের কাজ। চা-বাগানের শ্রমিক তাই লড়াকু মানুষের প্রতীক। চা-বাগানের জীবন স্বতন্ত্র এক জীবন। ভিন্ন এক জগৎ যেন এ। চা গাছের ফাঁক দিয়ে যে মাটি চোখে পড়ে সেখানে লাল রঙের সাথে রক্তের রঙ মিশে থাকে। খোলা আসমানের নিচে চা-বাগানের প্রশস্ত সবুজ জমীন ঘোর কোলাহল ও তুমুল ব্যস্ত শ্রমিকের নিঃশ্বাসের ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকে। দেশান্তরি এবং সাঁওতালি নারীর অভঙ্গ দেহ-পল্লবের হাতছানিতে উঠে আসে অজস্র পাতার দল, দুইটি পাতা একটি কুঁড়ি অফুরান। সেই পাতা থেকে আমাদের চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ার অবকাশ নামে। গরম চায়ে চুমুকের তৃপ্তিতে গেয়ে উঠি গান জলের গানের সুরে--

'হরেক রঙের বাহারে সকাল হল আহারে।
চুলার পারে উড়ছে ধোঁয়া এক কাপ চা।
শিশির ভেজা দেহটাকে ঢাকছে কুয়াশা... অই হই...'

আখতারুজ্জামান আজাদের কবিতার মতো ভাবতে থাকি, ভেবে ভেবে আকুল হই--

'হয়তো এই কাপেই চা খেতে খেতে কোনো খুনি এঁকে গেছে কোনো খুনের নকশা,
কোনো মুণী আবিষ্কার করে গেছে দর্শনের নয়া নয়া ধোঁয়াশা,
প্রেমবঞ্চিত কোনো কবি কারো প্রেমকেলী দেখে ফেলে গেছে দু ফোঁটা চোখের জল,
সদ্য-অঙ্কুরোদগম-ঘটা কোনো প্রেমিকা লাগিয়ে গেছে ঠোঁটের ছল।

প্রেমিক থেকে শ্রমিক,
খুনি থেকে মুণী,
কবিনেতা থেকে অভিনেতা —
প্রত্যেকের মুখস্থ তপ্ত থুতু লেগে এই চায়ের কাপে!

এই ঐতিহাসিক কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে আমি পাই ইতিহাসের ছোঁয়া,
কেতলির নলে আমি দেখি ইতিহাসের দাউদাউ ধোঁয়া।'

এতসব অনুভূতি, আমেজ ও আয়েশ আসে যার বদৌলতে সে হলো চায়ের পাতা। আদতে পাতা নয়, বরং পাতার কষ কিংবা রস। চাগাছের পাতার কষে সুস্বাদের ঘ্রাণ আসে নাকে, চাঞ্চল্য জাগে ঠোঁটে ও প্রাণে। আমাদের ঘরে ঘরে অবসর সময়কে ভরিয়ে দিতে, অতিথির মন রক্ষা করতে বাগান থেকে ছুটে আসে চা-গাছের পাতারা। চা-পাতা ছুটে আসে গাড়িতে করে, প্যাকেটে ভরে, ঠোঙায় বন্দী হয়ে। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে চা-পাতার প্যাকেট আমাদের ঘরে এসে পৌছুচ্ছে বিরামহীনভাবে। বাজার ব্যবস্থাপনার নিয়মে পণ্যের ঢঙে চা-শ্রমিকের শ্রম চা-পাতির প্যাকেটে বন্দী হয়ে দীপাবলীর গল্প হয়ে ছুটে আসে প্রতি ঘরে, প্রতিটি মানুষের চুমুক দেয়া ঠোঁটের কাছে। আমরা ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেতে উঠি গল্পে, আড্ডায়, গানে ও গাঁথায়। ঝড় তুলি চায়ের কাপে।

চা-গাছের পাতার কষ গরম পানিতে মিশিয়ে খাই। আমরা বলি, চা খাই। তবে এই কষ সরাসরি নয়, খাওয়া হয় পাতার কিছু রুপান্তর ঘটিয়ে। সবুজ পাতা পরিণত হয় কালো দানায়। অজস্র কালো দানা ভিজে চুপসে হয়ে রস ছাড়ে গরম জলে। গরম জল তখন রসের স্বাদে কষের স্বাদে চিনির ছোঁয়ায় মিষ্টি হয়ে আমাদের ঠোঁটে-জিহ্বায় অমৃতের তৃপ্তি আনে। আজ যে কালো দানার পাতি থেকে চা বানিয়ে খাই, শুরুর দিকে চা ঠিক এমন করে খাওয়া হতো না। প্রাচীন চীনে প্রথম চা-গাছের পাতাকে ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের সবচেয়ে প্রাচীন চীনা পদ্ধতি ছিলো, তাজা চা-পাতাকে ভাপে দেয়া এবং তাকে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা। এই পদ্ধতিতে হান সম্রাজ্যের শেষের দিকে চা তৈরি হতো এবং এই পদ্ধতিতে তৈরি শুকনা চা-পাতাকে আজকের দিনে 'সবুজ চা' বা 'গ্রিন টি' বলা হয়।

পাতার কষ খাওয়ার অভ্যাস ভারতীয়দের সুপ্রাচীন আমল থেকে। পান-পাতার কষ, বাবলা-পাতার কষ, পিপল-পাতার কষ ইত্যাদি খাওয়া হতো ভেষজ গুনের কারনে। আর তেতুল পাতা, আমড়া পাতা ইত্যাদি মজাদার পাতা মানুষ শখের বশে খায়। পাতার কষ খাওয়ার মধ্যে চায়ের পাতার কষ খাওয়া একেবারেই অনন্য। চা-পাতা থেকে রস আলাদা করে খাওয়া হয়। গরম জলের সাথে মিশিয়ে চুমুক দিয়ে। তলে পড়ে থাকে পাতার ছাবনা। মানে ব্যবহৃত চাপাতি।

বলা হয়, বৃটিশরা এদেশের মানুষকে চা খাওয়া শিখিয়েছে। কথা সত্য। তবে এমনতর পাতার কষ থেকে তৃপ্তি নেয়ার অভ্যাস এদেশের মানুষের পান পাতার মাধ্যমে আগে থেকেই ছিলো। পান-পাতা খাওয়া হয় চিবিয়ে সুপারি ও চুন মিশিয়ে। সুপারি-চুন মেশানো হয় স্বাদ বাড়াতে ও ধক কমাতে। বাঙালির বড় প্রিয় বন্ধু এই পান!

পান খাওয়ার প্রচলন কবে থেকে হয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। বোধ করি কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা চালু হবার পরপরই এর প্রচলন হয়েছিলো।
মহাভারতে পানের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পানের জন্য দুনিয়া তোলপাড় করেন পঞ্চপাণ্ডব। হস্তীনাপুর ছাড়িয়ে নানা দিকে খোঁজ পড়ে যায়। কিন্তু কোথাও পান নেই! খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানীরা পৌঁছান পাতালপুরীতে। সাপের রানির ঘরে। তখন বাসুকী তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে উপহার দেন হাতের কনিষ্ঠ আঙুল। সেই আঙুল মাটিতে পুঁতলে জন্মায় পানের বল্লরী। সে গাছের ফুল নেই, ফল নেই। কেবল কচি সবুজ পাতা। সংস্কৃতে তাই পানের আর এক নাম 'নাগবল্লরী'।

পুরাণে রয়েছে পান নিয়ে আরো একটি গল্প। মহাভারতে উল্লিখিত সমুদ্রমন্থনে উঠেছিলো হলাহল। সেই বিষের ভাণ্ড নিয়ে মহাবিপদে পড়েন দেবকুল! অবশেষে সেই বিষ গলায় ধারণ করে দেবাদিদেব হলেন নীলকন্ঠ। বিষের জ্বালায় কিছুক্ষণের জন্য তিনি মূর্ছা যান। তখন তাঁর কপালের ঘাম আর শরীরের ময়লা জমানো হলো তামার পাত্রে। সেই মিশ্রণ থেকে জন্মায় এক সুদর্শন পুরুষ। নারায়ণ তাঁর নাম রাখেন তাম্বূল পুত্র। জন্মানোর পর সে যায় নাগলোকে। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয় নাগকন্যা। বিয়ে হয় দুজনের। জন্মায়, পানরূপী নাগবল্লরী।
অনেকে আবার মনে করেন, অর্জুন স্বর্গ থেকে চুরি করে এনেছিলো পানের চারা। পুঁতেছিলো রাজবাড়ির বাগানে। সেখান থেকেই মর্তে পানের প্রচলন।

১২৯৫ সালে মার্কোপোলো গুজরাটে আসেন। সেখানকার বাসিন্দাদের দাঁতের হাল দেখে অবাক হয়ে যান! লিখেছিলেন, এটা একধরণের পাতা চিবানোর ফল। সেই পাতা চিবোলে চেহারা খোলতাই হয়। ১৫৪৮ সালে এদেশে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা। পান নিয়ে তিনি বলেন, ' চিবুলে মুখ লাল হয়, দাঁত কালো। তা ছাড়া পান তৃষ্ণা হরে, মাথা ঠান্ডা রাখে।'

বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবে পানের ব্যবহার চলে আসছে বহকাল ধরে। অনুষ্ঠানাদিতে পান পরিবেশন দ্বারা প্রস্থানের সময় ইঙ্গিত করা হয়। এক সময় উৎসব, পূজা ও পুণ্যাহে পান ছিলো অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজিয়ে পরিবেশন করা লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেতো।

পান এককালে ছিলো খুব দামি। কিন্তু বহু দেশের লোক এই পাতার ব্যবহার পর্যন্ত জানত না। মনসামঙ্গলে রয়েছে এমনই একটি গল্প। চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করতে গিয়ে উপস্থিত হন আজব এক দেশে। সপ্তডিঙ্গা নোঙর হয়। সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কোতোয়াল। সওদাগর তখন পান খেতে ব্যস্ত। সোনার বাটা থেকে পান-সুপারি-চুন দিলেন অতিথিকে। কোতোয়াল চুনকে দই ভেবে চেটে খেলেন, পান দিলেন ফেলে। চাঁদ বুঝলেন, এদেশের লোক পানের ব্যবহার জানে না। ব্যবসায়ীক বুদ্ধি উসকে উঠল। সেখান থেকে বিনা পয়সায় ডিঙ্গা বোঝাই পান নিয়ে অন্য দেশে বিক্রি করে দেশে ফিরলেন হিরে-মাণিক নিয়ে।

চা-পাতার ব্যবহার মানুষ কবে থেকে শুরু করেছিলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে চিনদেশের একটি গল্প বলা হয়ে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের কথা, চীনা সম্রাট শেন নাং তাঁর ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়ে জঙ্গলে গেছেন আনন্দ ভ্রমণে। ভৃত্যরা সম্রাটের জন্য খাদ্য প্রস্তুতে ব্যস্ত। হঠাৎ অজান্তে এক নাম না জানা অচেনা পাতা ফুটন্ত পানির মধ্যে পড়ে গেলো। সম্রাটকে যখন সেই পানীয় পরিবেশন করা হলো, সম্রাট তার স্বাদ পেয়ে তো মহা খুশী। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন অধিকতর তদন্ত করার জন্য যে, এই পাতা কী? কোথায় মিলবে এবং আর কিভাবে এর ব্যবহার করা যাবে? জন্ম হলো এক নতুন পানীয়র। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চা ঔষধী গুণাবলীর স্বীকৃতি পেলো যা পরবর্তীতে চীনা পন্ডিত কর্তৃক অমরত্বের স্পর্শমনি হিসাবে বর্ণিত হয়েছিলো।

উইকিপিডিয়ার সূত্রমতে,
১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। পরবর্তিতে একে একে আরো অনেক চা-বাগান গড়ে ওঠে। বর্তমানে সিলেটের চেয়ে মৌলভিবাজারে চা-বাগানের সংখ্যা বেশি। এক একটা চা-বাগানে প্রচুর শ্রমিক কাজ করে। বৃটিশ আমলে চা-শ্রমিকদের উপর নীলচাষীদের মতোই অত্যাচার চলতো। আসামের ডুয়ার্সের চা-বাগানে এমন ঘটনার কথা বহু শোনা গিয়েছে।

প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি বা উচ্চ ঢালু জমি চা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পানি নিষ্কাশনের বন্দোবস্ত থাকলে উচ্চ সমতল ভূমিতেও চা চাষ করা সম্ভব। হিউমাস সারযুক্ত এবং লৌহমিশ্রিত দো-আঁশ মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। এজন্য মৌসুমী ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চা চাষের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। চা-গাছের চারা দুই থেকে তিন বছর পরিচর্যার পর পাতা সংগ্রহের উপযোগী হয়। একটি চা-গাছ গড়পড়তা ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত উৎপাদনের উপযোগী থাকে। বাংলাদেশের সিলেট এবং ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় প্রায় একই অক্ষরেখায় অবস্থিত। তাই সিলেটের মতো ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়েও চা চাষের উপযোগীতা রয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলা ভূমি দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু। নিচের দিকের ভূখন্ডে পানি সরে ধীরে ধীরে। ফলে মাটি ভিজে থাকে। তাই বাংলাদেশের মাঝখান থেকে সাগর পর্যন্ত চা চাষের উপযোগী নয়। উত্তর দিকের অংশ সর্বাপেক্ষা উপরে অবস্থান করায় পানি নিষ্কাশনের সুযোগ বেশি। আবার পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারনে পানি সরবরাহেও কমতি পড়ে না। উত্তরবঙ্গ তুলনামূলক কম বৃষ্টিপ্রবণ বলে চা-বাগানে কৃত্রিম উপায়ে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হয়।

পৃথিবীতে আসাম এবং চীনজাতীয়-- এ দুই প্রকারের চা-গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আসামজাতীয় চা-গাছ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অধিক চাষ করা হয়। এ ধরণের গাছ বেশ বড় এবং বহু পাতাযুক্ত হয়। তাই এটি বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করার জন্যে বিশেষ উপযোগী। অন্যদিকে চীনজাতীয় গাছ আকারে বেশ ছোট হয়। এতে পাতার সংখ্যাও অনেক কম থাকে। এ গাছ না ছাঁটলেও পাতা তোলার মতো উচ্চতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।

চীনজাতীয় গাছের পাতা স্বাদ ও গন্ধের জন্য সুখ্যাত। কিন্তু আসামজাতীয় গাছের পাতা রঙের জন্য বিখ্যাত। এই দুই ধরণের চা-পাতার উন্নত সংমিশ্রণের উপরই এর গুণাগুন নির্ভর করে। স্বভাবতঃই চা মিশ্রণ একটি নিপুণ ও কঠিন কাজ। বাংলাদেশে এই মিশ্রনের কাজটি খুব একটা করা হয় না বললেই চলে। তবে গ্রেডিং করা হয়। গ্রেডিং হলো চা প্রক্রিয়াজাত করণের সর্ব শেষ ধাপ। এই ধাপে চা কে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়ে থাকে। বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের চা রপ্তানী করা হয় এবং তৃতীয়-চতুর্থ গ্রেডের চা দেশীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। এটি জনশ্রুতি কেবল। প্রতিযোগিতার বাজারে ভিন্ন ব্যবস্থাপনাও থাকা সম্ভব। চা-কোম্পানির গ্রেডিং পদ্ধতিটি নিম্নরূপঃ
সম্পূর্ণ পাতার চা (Whole leaf tea),
আংশিক ছেঁড়া পাতার চা (Broken-leaf tea),
অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ ছেঁড়া পাতার চা (Fannings) এবং
গুড়া বা Dust; এগুলো থেকেই টি-ব্যাগের উৎপত্তি।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রেডের মিশ্রণে সবচেয়ে বেশি ব্রান্ডের চা উৎপাদন করে ইস্পাহানী গ্রুপ। তাদের ব্রান্ড ১৬টি এবং প্রতিটির রং, স্বাদ, গন্ধ একটি চেয়ে অন্যটি ভিন্ন। এই কোম্পানীর সবচেয়ে দামী ব্রান্ড ”ব্রেল্ডার চয়েস”। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানীগুলোর চায়েরও বিভিন্ন ব্রান্ড রয়েছে।

চায়ের দেশ সিলেট। মজার বিষয় হলো, পান এবং চা দুটোর জন্যই সিলেট বিখ্যাত। পান-রসিক মাত্রেই জানেন, এক কাপ লাল-চায়ের পর এক খিলি পান মুখে পুরার মজা অতুলনীয়। পান-রসিকদের প্রায়ই দেখা যায় চায়ের পর পান খেতে। লাল-চা, দুধ-চা, মালাই-চা যাই হোক না কেন, চায়ের সাথে পান তারা খাবেই। এটি কাকতালীয় কিনা জানি না, তবে পানের কষ থেকে যে আসক্তির সূত্রপাত সেটাই পরবর্তিতে চায়ের আসক্তি তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে, এটা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। চায়ের হরেক রকম পরিবেশন থাকলেও গরম পানির সাথে কাঁচা পাতির মিশ্রন তথা লাল-চা'ই হলো চায়ের অকৃত্রিম রূপ। চায়ের কষ কষ স্বাদ মাদকতাময়। চা পানে অভ্যস্ত মানুষ আসক্তের মতো আচরণ করে। এর থেকেই 'চায়ের নেশা' কথাটির উৎপত্তি। জগতে পেট ভরার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে যা কিছু খাওয়া বা পান করা হয় তার সবই হয় ওষুধ নয় নেশা। নেশার বহু ক্ষতিকর উপাদান থাকলেও চা কিন্তু উপকারী। পরিমান মতো চা পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এক্ষেত্রে পানও উপকারী। তবে পানের সাথে জর্দার মিশ্রন পানকে ভয়ংকর করে তুলেছে। অতিরিক্ত চুন-সুপারিও ক্ষতিকর। কাঁচা-পান যে ভিটামিন সি'র ভালো একটি আঁধার; সে কে না জানে? তদুপরি পান খেতে যতোটা নিরুৎসাহিত করা হয়, চায়ের ক্ষেত্রে তার উল্টো। বাঙালির প্রাত্যাহিক জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে চা। চা ছাড়া আজকের আধুনিক জীবন কল্পনাও করা যায় না।

একটি কৌতূক আছে এমন যে, একজন পর্যটক সিলেটের এক রসিক লোককে জিজ্ঞেস করছে, ভাই সিলেটে চায়ের প্রথম আগমণ হলো কেমন করে? সিলেটি লোক দৃঢ়তার সহিত উত্তর করলো, এটা একটা ষড়যন্ত্র। পর্যটক বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললো, সেটা কেমন?
সিলেটির উত্তরঃ বৃটিশরা চিন্তা করলো, সিলেটিদের মধ্যে ভেজাল লাগাই দিতে হবে। হক্কোল সিলেটিরে চা খাওয়া শিখাইলো। তারপর সিলেটিরা খাইতে বসতে যাইতে আইতে সব সময় চা খাওয়া শুরু করলো। এখন চা না হলে জামাই রাগ করি চলি যায়, আত্মীয়তা ভাঙি যায়, মেহমানদারিই হয় না। কি একটা ভেজাল লাগি গেলো।

ভেজাল শুধু সিলেটে লাগে নি, সারা বাংলায় লেগেছে। রসিক মানুষের দাবি, এ হচ্ছে বৃটিশদের চিকন বুদ্ধির কাজ। সারা ভারতে চা খাওয়ার প্রচলন ঘটিয়ে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বুঁদ বানিয়ে দিয়েছে। আমরা জানি, চা সারা পৃথিবীতেই মুটামুটি প্রচলিত একটি পানীয়। পান-সুপারী বাংলার আদি ও অকৃত্রিম সাংস্কৃতিক উপকরণ। চায়ের আগমণ অনেক পরে হলেও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আত্মীকৃত হয়ে গেছে। চায়ের সাথে 'টা' বলে হালকা নাস্তা বুঝানো হয়। বিস্কুট, মুড়ি, রুটি-কলা, কেক, চানাচুর ইত্যাদি হলো টায়ের উপকরণ। চা আমাদের আতিথেয়তাকে পরিশীলিত করেছে, সহজও করেছে। এই সহজ করার বিড়ম্বনাও রয়েছে। একটি গল্প প্রচলিত এমন যে, গ্রাম থেকে এক লোক ঢাকায় তার বাল্যকালের এক বন্ধুর বাসায় কদিন বেড়াবে মনে করে এসেছে। এসে বন্ধুকে বাসায় না পেয়ে অপেক্ষা করছে। তো বন্ধুটি তার দিনশেষে বাসায় ফিরে এসে দেখে, গ্রাম থেকে মেহমান এসেছে। দেখেই বলে উঠলো, এসেছিস ভালো করেছিস, চা না খেয়ে কিন্তু যাবি না। মানুষ এতটা অসামাজিক হয়ে গেছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। তবে এটা তো সত্য যে, নগর সভ্যতা মানুষকে যন্ত্র বানিয়েছে, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক বানিয়েছে। চায়ের উপর দোষ চাপিয়ে আর কি লাভ?

কষ মুখে ধুমপানের বাড়তি তৃপ্তি আছে বলে ধুমপায়ীদের অভিমত। তাই ধুমপায়ীদের দেখা যায়, পানের পরে, চায়ের পরে আয়েশী ভঙ্গিতে তামাক জ্বালাতে। আমলকীর মতো কষাশ্রিত ফলেরও রয়েছে এমন উপযোগ। এটি বাবলা পাতা চিবানোর পরেও হতে পারে। কষাশ্রিত খাবারের পর ধুমপানের বাড়তি স্বাদের যোগসূত্রটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি মাদকের সাথে আরেকটি মাদকের আন্তঃসম্পর্ক খুব গভীর। বাঙালির বিয়ের অনুষ্ঠানে পান একটি অপরিহার্য উপকরণ। বরপক্ষ পর্যাপ্ত পান নিয়ে না এলে বিরাট কলংকের ব্যাপার হয়। এদেশে পানের প্রচলন ঘটিয়ে মানুষের মাঝে ভেজাল লাগানোর চিন্তা কারা করেছিলো, তেমন গল্প শোনা যায় নি কোনোকালে। বোঝা যাচ্ছে, পানের সাথে চা যোগ হওয়াতে কট্টর জাতিয়তাবাদীদের মাথা খারাপ হবার জোগাড়। নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদান আদরের, কিন্তু ভিনদেশীর উপকরণ কিছুটা হলেও অস্বস্তির কারন হয়। যদিও চা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সুন্দর মানিয়ে গেছে। হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্য-দিনের সঙ্গী।

‘এক কাপ চা, কত গল্প বলে সকাল, বিকেল, সন্ধে বেলা...’।  এই গানের মতো চায়ের গল্পের সত্যিই কোনো শেষ নেই। কবির সুমনের গানের সুরে চায়ের রোমান্টিকতা ফুটে উঠেছে সবার থেকে বেশি,

'--- ---- ----
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই,
ডাইনে ও বায়ে আমি তোমাকে চাই,
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই,
না বলা কথায় আমি তোমাকে চাই..'

লেখক: সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন