আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

হাসন রাজা: এক চির বৈরাগ্যের কবি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-০৫ ২২:৪৭:৩৪




‌:: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ::

লালন ফকিরের ঠিক আশি বছর পর হাসন রাজার জন্ম। মরমী কবি হাসন রাজা না বাউল না বৈষয়িক। নিষ্কাম-নিরাসক্তের সহজ সংজ্ঞাতেও ধরা যায় না তাঁকে। যদিও বিপুল ঐশ্বর্য্যের মধ্যে থেকেও প্রত্যাখান করেছেন ধনগৌরব। বেছে নিয়েছেন ছন্নছাড়া জীবন। বর্ণাঢ্য জীবনের বাঁক বদলের প্রতিটি মুহূর্তে যুগান্তর-জোয়ারে প্লাবিত জীবনের স্রোতধারা হাসন রাজাকে নতুন করে বোধে উত্তীর্ণ করেছে। তিনি হয়ে ওঠেন গীতিকবি, সুরকার ও মহাজন-গায়েন। উচ্ছৃঙ্খল জীবনের অবসাদ এবং নশ্বর জীবনের নিরর্থকতাবোধ তাঁর চেতনায় যে ভাবান্তর ঘটায় সেটিই বিশুদ্ধ রূপে আমাদের কাছে হাজির করে সাধক-কবি হাসন রাজাকে।

সুরের জাদুতে মোহগ্রস্ত শ্রোতা উচ্ছ্বল-আবেগে একাত্মতা বোধ করে তাঁর গানের বার্তার সাথে। শ্রোতা তার আপন অস্তিত্বের গুরু-গাম্ভীর্যকে ঝেড়ে ফেলে আধ্যাত্মিক ভাবে উত্তীর্ণ হয়। অনুভব করে ক্ষণস্থায়ী জীবনের আরাধ্য উপভোগের মাহাত্ম্যকে। মৃত্যুর আগে যতোটা সময় আছে তার হাতে সেটুকু যেন হতে পারে বৈচিত্র-উপভোগে সমৃদ্ধ। খালি হাতে ধাবমান মৃত্যুর দরজায় দাড়িয়ে অযথা আফসোসে ভারাক্রান্ত যেন না হয় লোবানের স্নিগ্ধ সুবাস।

"নেশা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে
হাছন রাজা পেয়ারীর প্রেমে মজিলো রে
নেশা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে"

প্রেমের নেশার সাথে মরণের অমোঘ সত্যানুভূতির খুব একটা তফাৎ নেই। কেননা অনিবার্য মৃত্যু মানুষকে প্রেমের অমৃত সুধা-রসে সিক্ত হতে প্ররোচনা দেয়।

"একদিন তোর হইব রে মরন রে হাসন রাজা"

সংসার সাগরে শৃঙ্খলিত জীবন, ভাব-সুধা পানের মাধ্যমে পরম তৃপ্তি আহরণে, কেবলই বাধা হয়ে দাড়ায়। নশ্বর জীবনের চাকচিক্য মনে শান্তি দিতে পারে না, পরমাত্মার ভাবে বিভোর তুচ্ছ জীব বারবার আহত হয়ে চলে। তাই মরমীর কন্ঠে ধ্বনিত হয় সুগভীর খেদ,

"স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল/
কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল"

"ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন"

রাজা হবার সুবাদে বহু নারীর সম্ভোগে দৃশ্যত ভরপুর অথচ সুগভীর বোধে শূণ্যতার অনুভব। সমাজ কলঙ্কে উদ্বিগ্ন হাসন স্বগতোক্তির বয়ানে বলছেন,

"সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া"

জরা-দুঃখে অতিশয় ক্লিষ্ট জীবনের যাতনা ভুলতে পরমের মহাভাবে লীন হতে গিয়ে নানাভাবে খুঁজে ফিরেন আরাধ্য মহাজীবনকে। আর তা গানে ও সুরে কেমন মোহনীয় রূপে পৌছে গেছে যুগ যুগ ধরে কান পেতে থাকা শ্রোতার অন্তরে,

"বাউলা কে বানাইলো রে/
হাসন রাজারে/
বাউলা কে বানাইলো রে"

"মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে/
কান্দে হাসন রাজার মন-ময়না রে"

"আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে/ হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে"

পাশাপাশি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় –

"আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি/
আমি কি তোর যমকে ভয় করি/
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী"

আপন অন্তরের ভেতর পরম ধন খুঁজে পেতে জাত-বাউলের মত ডুব দিতে চাইছেন সেখানে,

"আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে/
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে"

বৈষয়িক জীবনে সংসারী মানুষের কান-কথায় অতিষ্ঠ কবি যন্ত্রণার কথা বলতে সুরের ও ছন্দের আশ্রয় নিচ্ছেন। বিষয়-আশয়ের লোভে আসক্ত মানুষের চোখে নিত্য আনন্দের মূল্য নেই, পরমার্থেরও কোনো গুরত্ব নেই। কার কত ধন রয়েছে, কে কতটা সমৃদ্ধ ও সম্পদে বলীয়ান, এইসব তুচ্ছ হিসেবের দঙ্গলে পড়ে সাধকের যন্ত্রণার শেষ থাকে না। তাই আর্ত-আহাজারির মত বলে উঠছেন,

"লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার/
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার/
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার"

হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি(লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে।
মৃত্যুবরণ করেন ৭ই ডিসেম্বর ১৯২২ সালে। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তার এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পূর্বে নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঠিক পাঁচ বছর আগে বাউল-সাধক শাহ আব্দুল করিমের জন্ম সুনামগঞ্জের দিরাই এ।

তিন লক্ষ বিঘার জমিদারির মালিক হাসন রাজার স্ত্রীর নাম আজেজা বানু। যশোর থেকে সিলেটে এসে তাঁর দুই পুরুষ আগের পূর্বসূরী হিন্দু থেকে মুসলমান হোন। তাঁদের জমিদারির সীমানার অন্তর্ভুক্ত ছিলো আম্বরখানা, টিলাগড়, রামপাশা, লক্ষণশ্রী প্রভৃতি জায়গাগুলো। বড় ভাই ও বাবার অকাল প্রয়াণে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে জমিদারির দায়িত্ব সামলাতে হয়। বৈরাগ্য রোগে আক্রান্ত মরমী ভাবে বিভোর জমিদার হাসন, সাধন-রাজা হয়ে পরিচিত হোন 'হাসন রাজা' নামে। আটষট্টি বছর বেঁচে থাকা ক্ষণজন্মা এই মানুষটি যৌবণে বিপুল ভোগ-বিলাসে মত্ত থেকেও অনুভূতিতে বহন করেছেন তীব্র দংশন এবং প্রগাঢ় অতৃপ্তি। তাঁর কিছু গান, সমাদৃত ও লোকপ্রিয় শুধু নয়, সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদাও লাভ করেছে।

দিলারাম নামে তাঁর এক পরিচারিকা, বিনোদিনী নামেও পরিচিত, অন্তরালে সাধনসঙ্গিনী, মাঝে মাঝে তাঁর গানে উপস্থাপিত হয়েছেন,

"ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর/
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।"

কিংবা

"তোমরা শুন্‌ছনি গো সই/
হাছন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই"

হাসন রাজাকে বাউল বলতে পণ্ডিতগণের আপত্তি থাকলেও সাধক তিনি নিঃসন্দেহে। আধ্যত্মিকতার চূড়া স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তিনি। বিশেষত তুচ্ছ জীব ও মহাজাগতিক পরমের সম্পর্ক নির্ণয় করে জীব-পরমের ব্যবধান ডিঙ্গিয়ে আরাধ্যের কাছে পৌছে যাবার কামনা আমৃত্যু ধারন করেছেন মনে। গানে ও সুরে কন্ঠে তুলেছেন অন্তরের কথা। যন্ত্রের সাথে সুর দিয়ে পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করেছেন আপন মনোবাসনা। যেন সহজিয়া-বৈষ্ণব ও সুফীবাদের মিলিত স্রোত এসে উছলে পড়েছে তাঁর ভাব ও উচ্ছ্বাসের উপর।

অনুমান করা হয় তিনি হাজারেরও বেশী গান রচনা করেছেন। যার মধ্যে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ২০৬টি গানের সংকলন প্রকাশিত হয় “হাসন উদাস” নামে। যেখানে ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন চূড়ান্ত এক ইশতাহার,

"অপ্রেমিকে শুনবে না গান দিলাম এ ফরমান"

এ যেন চির-সাধকের চিরন্তন মনের কথা। উষ্মাও নয় কি? শিল্প বিবর্জিত স্থূল মানুষ ভাবের কি বোঝে? তারা তো শুধু উৎপাতের উদপাদন করে। পরিশুদ্ধ মন নেই যার, সংসারে তার উপস্থিতি বিরাট এক জঞ্জালের বোঁঝা। মরমী কবি আমাদের কাছে সেই অনুভবের ঝাঁঝালো উচ্চারণটি তুলে ধরেছেন কি আশ্চর্য ভঙ্গিমায়।

এছাড়াও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কিছু গান প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাসন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তাঁর গানের কিছু পান্ডুলিপি আছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

'স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার' বিষয়ের উপর হাসন রাজার আরেকটি গ্রন্থ হচ্ছে "সৌখিন বাহার"।

এ পর্যন্ত পাওয়া হাসন রাজার সর্বমোট গানের সংখ্যা ৫৫৩টি।

"হাসন বাহার" নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

মরমী কবি-সাধক হাসন রাজাকে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচ্ছ্বাস ছিলো চোখে পড়ার মত। এক সভায় তিনি হাসন রাজা সম্পর্কে বলছেন,

"পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।"


শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন