আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গুরুবাউল করিমের আদর্শ লালন করাই আবদুর রহমানের কাজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-০৫ ২১:১৫:৫৭

আবদুর রহমান একজন প্রথিতযশা বাউলশিল্পী। প্রয়াত বাউলসাধক শাহ্‌ আবদুল করিমের অন্যতম শিষ্য বাউল আবদুর রহমান একাধারে শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। শাহ আবদুল করিমের গানের অন্যতম প্রধান গায়ক হিসেবে আবদুর রহমানের বেশ সুনাম রয়েছে। শাহ আবদুল করিমের গানের কথা ও সুর অক্ষুন্ন রেখে যে কয়েকজন শিল্পী গান করেন, তাদের মধ্যে বাউল আবদুর রহমান অন্যতম। ১৯৫৫ সালের ১০ মে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই গুনী বাউলশিল্পী। সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে লোকগানে বিশেষ অবদান রাখায় পেয়েছেন ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা-২০১৯।’ এছাড়াও প্রথম আলো বন্ধুসভা সম্মাননা পুরস্কার-২০১৯, শাহ্‌ আবদুল করিম লোক উৎসব সম্মাননা স্মারক, লালন শাহ্‌ লোকজ উৎসব শুভেচ্ছা স্মারকসহ পেয়ছেন অসংখ্য পুরষ্কার। আমাদের বানিয়াচং প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন কথা বলেছেন বাউলশিল্পী আবদুর রহমানের সাথে। 

জসিম উদ্দিনঃ কেমন আছেন?
আবদুর রহমানঃ খুব ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
জসিম উদ্দিনঃ জ্বি, আমিও ভালো আছি। ধন্যবাদ আপনাকে। সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক পেয়েছেন সম্মাননা পুরস্কার। কেমন লাগছে?
আবদুর রহমানঃ পুরস্কার পেলে যে কেউ খুশি হন। আমিও খুব খুশি।এটা একধরণের স্বীকৃতি।  ইদানীং হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবির মুরাদ মহোদয়ের কাছ থেকে আমি পুরস্কার পেয়েছি। এ পর্যন্ত ২০-২৫ টি পুরস্কার আমি পেয়েছি। এই যে দেশের গুণীজন আমাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। গান পরিবেশন করতে বলেন এটা আমার জন্য বিশাল পাওয়া। আমি খুবই উপভোগ করি এবং আনন্দিত হই।

জসিম উদ্দিনঃ প্রয়াত বাউলসাধক শাহ্‌ আবদুল করিমের অন্যতম শিষ্য আপনি। তো কবে থেকে আপনি তাঁর সংস্পর্শে আসেন?
আবদুর রহমানঃ ৬০ এর দশকে গুরু আবদুল করিমের সাথে আমার দেখা হয়। আমার বয়স তখন ১০/১২ বছর হবে। তিনি আমাদের গ্রামে এসে প্রায়ই গান পরিবেশন করতেন। তখন তিনি একতারা বাজাতেন। গানের বিভিন্ন আসরে অন্যান্যদের মত আমিও দাঁড়িয়ে উনার গান উপভোগ করতাম। এভাবে কিছুদিন উনার গান শুনতে শুনতে গানের প্রতি আমার একধরণের ঝোঁক চলে আসে। গুরুর গানের কথাগুলো আমাকে খুব নাড়া দেয়। মাঠে বন্ধুদের সাথে যখন খেলাধুলা করতাম তখন কোনো একদিন হঠাৎ দেখতাম আমার গুরু দীর্ঘদেহী আবদুল করিম বেহালা এবং কিছু শিষ্য নিয়ে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেতেন। আমি তখন খেলা বন্ধ করে গুরুর পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করে দিতাম। ১৯৬৮ সালে একটি অনুষ্ঠানে তিনি অনেক গান পরিবেশন করেন। সবাই উপলব্দি করলেন যে গুরুর ভিতরে একধরনের আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। তাঁর গানের কথায় অনেক মানুষ তখন মুগ্ধ হয়ে যেত। ওই অনুষ্ঠানে উনার গান শুনে অনেক মানুষ তাঁর কাছে বয়াত (মুরিদ) হয়ে গেল। তখন থেকে গুরু ৩/৪ মাস পরপর আমাদের গ্রামে আসতেন। আমার দশ বছর বয়সে একদিন উনার গান শুনে তাঁর প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। তখন থেকেই শাহ্‌ আবদুল করিমের গান আমার মনের ভিতর দানা বাঁধে। আমি উপলব্দি করলাম যে আমিও একদিন গুরুর মত গান গাইতে চাই। আমাদের গ্রামে আরেক ফকির ছিলেন তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। দেখতাম তিনি কিভাবে গান পরিবেশন করেন। কিভাবে একতারা বাজান। পরে একতারা নিয়ে আমিও গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম। এভাবেই শুরু।
জসিম উদ্দিনঃ আপনি কত সালে বাউল সম্রাট শাহ্‌ আবদুল করিমের কাছে মুরিদ হন?
আবদুর রহমানঃ ১৯৭৭ সালের দিকে আমি গুরুর কাছে বাউলমন্ত্রে দীক্ষিত হই। এরপর থেকে গুরুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথেই ছিলাম।

জসিম উদ্দিনঃ বাউল জগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিবারের বা গ্রামের অন্যকারও কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না?
আবদুর রহমানঃ মুরিদ হয়ে আমি প্রথম যেদিন গুরুর কাছে চলে যাবো সেদিন মা আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে গানের জগতে চলে গেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আমি চলে গেলাম। তবে আমার জীবনে একটা দুঃখ আছে। তা হল আমি আমার মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি (কান্না)। তিনি মারা গেছেন ১৯৮৫ সালে। যেখানেই গানের আসর হত খবর পেলেই নাওয়াখাওয়া ছেড়ে ছুটে যেতাম। স্কুলের কথা বলে চলে যেতাম গানের আসরে। মা পাগল হয়ে সারা গ্রাম খুঁজতেন। যাই হোক, জীবনে সবচেয়ে বড় সুখ হল আমার জীবনটা আমি কাটিয়ে দিয়েছি একজন জ্ঞানী মানুষের সাহচর্যে। 

জসিম উদ্দিনঃ কত বছর আপনি করিমের সংস্পর্শে ছিলেন?
আবদুর রহমানঃ আমি ৩৬ বছর গুরুর সাথে ছিলাম।
জসিম উদ্দিনঃ বাউল আবদুল করিমের গানের সংখ্যা কত বলতে পারেন?
আবদুর রহমানঃ বাউল সম্রাট শাহ্‌ আবুদল করিমের গানের সংখ্যা ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ হবে।

জসিম উদ্দিনঃ আপনি তো একাধারে শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। ২০০৯ সালে ‘ভাটির সুর’ নামে আপনার একটি গানের সংকলনও বেড়িয়েছে। বইটিতে কয়টি গান আছে আপনার?
আবদুর রহমানঃ হ্যাঁ, ‘ভাটির সুর’ এ আমার ১০২টি গান সংকলন করা হয়েছে। বইটি বের হয়েছিল লোক গবেষক মুস্তফা সেলিম ভাইয়ের উৎস প্রকাশন থেকে।
জসিম উদ্দিনঃ আপনার রচিত মোট গানের সংখ্যা কত?
আবদুর রহমানঃ আমার গানের সংখ্যা প্রায় তিনশ সাড়ে তিনশ হবে। 

জসিম উদ্দিনঃ ‘ভাটির সুর’ বইটির ভূমিকা লিখেছেন লোক গবেষক সুমনকুমার দাশ। তিনি লিখেছেন, আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদী, গ্রামের রূপ-প্রকৃতি, হাওর-বাওর আপনার জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছে।
আব্দুর রহমানঃ হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। গবেষক সুমনকুমার দাশ যথার্থই বলেছেন। এক প্রত্যন্ত অঞ্চল কুশিয়ারার পাড়ে আমার বেড়ে ওঠা। কুশিয়ারা নদী, জলসুখা গ্রামের রুপ-প্রকৃতি আমার জীবনে বেশ প্রভাব ফেলেছে। আমার জন্মস্থানকে খুব ভালোবাসি আমি। আবার আমার গ্রাম জলসুখা একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। ‘ভাটির সুর’ এ ‘আত্ম-পরিচিতি’ মূলক একটি গানে আমি বলেছি-
“কুশিয়ারার শাখা নদী পাশে বহে নিরবধি
স্কুল মসজিদ মাদ্রাসাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
শাহজালালের সঙ্গী হইয়া শাহ্‌ বরকত আউলিয়া
জলসুখায় আসিয়া নিয়াছিলেন স্থান।’’

জসিম উদ্দিনঃ শাহ্‌ বরকত আউলিয়া কে?
আবদুর রহমানঃ শাহ্‌ বরকত আউলিয়া হযরত শাহজালালের সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার একজন। তিনি আমার গ্রাম জলসুখায় এসেছিলেন। 

জসিম উদ্দিনঃ শাহ্‌ আবদুল করিমের কোনো গানে কি আপনি সুর করেছেন?
আবদুর রহমানঃ হ্যাঁ, আমার উস্তাদের অসংখ্য গানে আমি সুর করেছি।

জসিম উদ্দিনঃ করিমের দুয়েকটা গানের কথা কি বলবেন যেগুলো আপনার সুর করা?
আবদূর রহমানঃ ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া, আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’, আমি কূল হারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইয় না গো সজনী,’ কই যাওরে ভাটিয়াল নাইয়া ললিত সূরে গাইয়া গান, গান শুনিয়া চমকে উঠে প্রাণ।’ আরও অসংখ্য গানে আমি সুর দিয়েছি।

জসিম উদ্দিনঃ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট’ সহ দেশের বড় বড় শহরে বিভিন্ন লোকজ উৎসবে আপনি প্রসংশা কুড়িয়েছেন অনেক। আমি জানতে চাই আপনি কি দেশের বাহিরে কখনো গান গেয়েছেন?আবদুর রহমানঃ হ্যাঁ, ২০১৪ সালে ভারতের কলকাতার একটি লোক উৎসবে আমি গান পরিবেশন করেছি।
জসিম উদ্দিনঃ আবারও আসি আপনার গুরু বাউলসাধক শাহ্‌ আবদুল করিম প্রসঙ্গে। করিমের জীবদ্দশায় শুনেছি বা এখনো আমরা শুনি তাঁর অসংখ্য গান রিমিক্স এবং প্রায়ই বিকৃত করে পাশ্চাত্য যন্ত্র দিয়ে গাওয়া হয়। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?আব্দুর রহমানঃ খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আমার উস্তাদ করিমের গান প্রায়ই সঠিকভাবে গাওয়া হয় না। যেমন, উস্তাদের একটি গান আছে এরকম-
‘মাটির পিঞ্জিরার সোনার ময়নারে
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।’ কিন্তু অনেককেই এই গানটিকে এইভাবে গাইতে শুনেছি-
‘আমার মাটিরও পিঞ্জিরার সোনার ময়নারে
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।’  এখানে ‘আমার’ শব্দটি এবং ‘ও’ অক্ষরটি অতিরিক্ত দেয়া হয়েছে। গুরু কিন্তু সোজা গেয়েছেন, ‘মাটির পিঞ্জিরার সোনার ময়নারে।’ 
আমি বলতে চাই, দেশের এমন একজন গুণী শিল্পীর গান যদি এইভাবে গাওয়া হয় তাহলে তো দেশের লোকসংস্কৃতিকে সঠিকভাবে চর্চা করা হল না। এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিকভাবে লোকসংস্কৃতির লালন করতে হবে।
জসিম উদ্দিনঃ আমার শেষ প্রশ্ন, বর্তমানে কি করছেন বা কি ভাবছেন? কোনো ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে কি?
আবদুর রহমানঃ গানের প্রোগ্রাম থাকে সারা বছরই। ইদানীং সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনের আমার প্রিয় কিছু ব্যক্তি আমার আরেকটি বই বের করতে যাচ্ছেন। আশা করি ২০২০ সালের বইমেলার আগেই বইটি বাজারে আসবে। আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা বলতে আমার সব কল্পনা, ধ্যান-জ্ঞান আমার গুরু করিমকে নিয়ে। তিনিই আমার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত। তাঁর গানের চর্চা করে যাবো। উস্তাদ করিমের আদর্শ লালন করাই আমার কাজ। যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন তাঁর আদর্শ লালন করে যাবো।

জসিম উদ্দিনঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বাউল রহমানঃ আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।     
 
সিলেটভিউ২৪ডটকম/৫ নভেম্বর ২০১৯/পিডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন