Sylhet View 24 PRINT

শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র জীবন ও কর্ম

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-১৩ ২২:৩১:৪৫

যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা মানব জাতির পথ প্রদর্শক হিসাবে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূলদের ধারাবাহিক দাওয়াত এ জমিনে রক্ষা করেছেন আওলিয়ায়ে কেরামগণ। তাঁরা পথভোলা মানুষকে দিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। বিশ্বনন্দিত ওলি আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট, মুজাদ্দিদে জামান, হাদীয়ে বাংলা, রাহবারে দ্বীন, আয়নায়ে জামালে আহমদী, জুবদাতুল আ’রিফিন, কুদওয়াতুছ ছালেহীন, শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সে সকল আওলিয়া কেরামদের উত্তরসূরী অন্যতম বুজুর্গ ছিলেন। আল্লাহর দ্বীন এ জমীনে প্রতিষ্ঠা করতে জীবনের সর্ব শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাহেলিল্লাহ। এ মহামনিষীর জীবনের নানামূখী অবদান রয়েছে। তাঁর প্রতিটি দিকই বিশাল কৃতিত্বপূর্ণ। যা বর্ণনা করা আমার মত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম নিম্নে পেশ করা হলো-

নাম ও বংশ পরিচয়:
নাম- মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী (ফুলতলী ছাহেব নামে সর্বমহলে পরিচিত)।

পিতা- হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ (র.) ছিলেন একজন সনামধন্য বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ফকীহ।

মাতা-মোছাম্মাত মাছুরা বিবি চৌধুরী ছিলেন জকিগঞ্জের বাদেদেওরাইল পরগনার এক নাম্বার বাহাদুর খাঁ তালুকের সনামধন্য ব্যক্তি মরহুম আহছান রাজা চৌধুরীর কন্যা। তিনি অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯১৩ ঈসায়ী মোতাবেক ১৩২৯ বাংলা সনের ফাল্গুন মাসের বৃহস্পতিবার সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানাধীন ফুলতলী গ্রামের প্রখ্যাত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত শাহজালাল মুজাররদে ইয়ামনী (র.) এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার একজন শাহ কামাল (র.) এর বংশধর। সকল মহামনীষিদের বাল্যবয়সে যেসব গুন পাওয়া যায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.)এর বেলায়ও তা-ই ছিল। খেলাধুলা, গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা ও ঘোরাফেরা ছিল তাঁর স্বভাববিরোধী।

শিক্ষাজীবন:
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র প্রাথমিক শিক্ষা বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে শুরু হয়। চাচাত ভাই হযরত মাওলানা মোহাম্মদ ফাতির আলী (র.) ছাহেবের তত্তাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। তখন ফুলতলী ছাহেবের ওয়ালিদ মুহতারাম জকিগঞ্জের গঙ্গাজল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এরপর ভারতের আসাম প্রদেশের হাইলাকান্দি জেলার হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদ্রাসার সুপার মাওলানা মো. আব্দুর রশিদ সাহেবের অনুরোধে ১৩৩৬ বাংলা সনে সেখানে তাঁর পিতা ভর্তি করিয়ে দেন। পীরে কামিল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। আল্লামা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) এর পরামর্শক্রমে ১৯৩১ সালে বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন। আর সেখানেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বরাবরের মত সুনামের সাথে শেষ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করে তদীয় ওস্তাদ ও মুর্শিদ বদরপুরী (র.) এর নির্দেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনার্থে ভারতের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মাদরাসায়ে আলিয়া রামপুর”-এ ভর্তি হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা শেষ করে ইলমে হাদীসের শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাতলাউল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ঐ মাদ্রাসায় অধ্যয়নের পর হাদীসের চুড়ান্ত পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে ১৩৫৫ হিজরী সনে ইলমে হাদীসের সনদ লাভ করেন। তাঁর হাদীস শরীফের ওস্তাদ ছিলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত খলিলুল্লাহ রামপুরী (র.) ও হযরত মাওলানা ওয়াজিহ উদ্দিন রামপুরী (র.)। এছাড়াও তিনি ইলমে তাফসীর ও ফিকাহ শাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।

ইলমে ক্বিরাত শিক্ষা:
তিনি ইলমে ক্বিরাতের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাহেব কিবলাহর পীর ও মুর্শিদ শাহ ইয়াকব বদরপুরী (র.) ইলমে কিরাতের অন্যতম ওস্তাদ। মুর্শিদের পরামর্শক্রমে ইলমে কিরাতের উপর মাহির হওয়ার জন্য প্রথমে বিশ্ব বিখ্যাত ক্বারী হযরত ইরকুস মিশরী (র.) এর অন্যতম শাগরিদ হযরত মাওলানা হাফেজ আব্দুরউফ করমপুুরী (র.) ও পরবর্তীতে বিশ্ব ক্বারী, মক্কাশরীফের ইমামগণের পরীক্ষক হযরত আহমদ হেজাজী (র.) এর কাছ থেকে ১৩৫১ বাংলায় প্রথমবার এবং এরপর যথারীতি দ্বিতীয় বার ১৯৪৬ ইংরেজী সনে গিয়ে সমস্ত কোরআন শরীফ শুনিয়ে ইলমে ক্বিরাতের সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করেন। ৩ উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র তিনিই হযরত আহমদ হেজাজী (র.) এর ছাত্র ছিলেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কিরাতের সনদ তিনি সিলসিলায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছেন।

কর্মজীবন:
আল্লামা ফুলতলী (র.) ছিলেন বৈচিত্রময় কর্মজীবনের অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে বহু প্রতিষ্ঠানের আদর্শ শিক্ষক, অত্যাধিক মহাপুরুষ, গণমুখী, রাজনীতিবিদ, একজন সু-সাহিত্যিক, সমাজ সেবক, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সর্বোপরি একজন শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও জাতির অভিভাবক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ধর্মীয় সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে তিনি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। আল্লামা ফুলতলী (র.) এর এ বৈচিত্রময় কর্মজীবন আলোচনার পাশাপাশি তাঁর সামগ্রিক জীবন দর্শন এবং তা থেকে অনুসরণীয় দিকগুলো সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। তাঁর কর্মজীবনকে নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপন করা যায়।

১। শিক্ষকতা জীবন
২। ইলমে কিরাআতের খেদমত ও প্রসার
৩। আধ্যাত্মচেতন ও ধর্মীয় জীবন
৪। সমাজ সেবা ও সামাজিক কৃতিত্ব
৫। রাজনৈতিক জীবন
৬। সাহিত্যকর্ম
৭। বাগ্মীতা ও জাতীয় অভিভাবকত্ব

শিক্ষকতা জীবন:
শায়খুল হাদীস, শামছুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র কর্মজীবনের সূচনা হয় শিক্ষকতার মহান পেশা দিয়ে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করেন। সেখানে দক্ষতার সাথে তিরমিযি শরীফ, নাসাঈ শরীফ, বায়দ্বাবী শরীফ ও ইতক্বান সহ হাদীস ও তাফসীরের বিভিন্ন কিতাবাদী অধ্যাপনা করেন। ১৯৫০ ইংরেজী সন থেকে ১৯৫৪ ইংরেজী সন পর্যন্ত ফুলতলী মাদরাসায় শিক্ষকতা দানে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫৪ ইংরেজী সনে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিছ হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপালের দায়িত্ব সুদীর্ঘ ছয় বৎসর পর্যন্ত পালন করেন। বিশ্বনাথ থানার ঐতিহ্যবাহী সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসা ও জকিগঞ্জের ইছামতি কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে বোখারী শরীফের তালিম দিতেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নিজ বাড়ির মাদরাসা বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসায় সপ্তাহে দু’দিন শনিবার ও রবিবার বোখারী শরীফের দরস দিতেন।

ক্বিরাত শিক্ষার খেদমত:
শায়েখুল কুররা আল্লামা ফুলতলী পীর ছাহেব কিবলাহ (র.) মক্কা শরীফ থেকে দেশে ফিরে এসে প্রতিদিন কিছু সময় বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দান করতেন ভারতের বদরপুর ৩৬০ আউলিয়ার সাথী হযরত আদম খাকী (র.) এর মাজারের পার্শ্বে। মদিনা ওয়ালার ইশারা পেয়ে শুরু করেন বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষার নিয়মিত খেদমত। ১৯৪০ সালে আল্রামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে ক্বিরাতের প্রশিক্ষণ শুরু করেন এবং ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট’ নামে একটি বোর্ড গঠন করেন। শুরু থেকে তিনি এই বোর্ডে চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তাঁর ভু-সম্পত্তির এক বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩একর) জমি ‘দারুল কিরাত ফুলতলী ট্রাষ্ট’র নামে ওয়াকফ করে দেন।

আধ্যাত্মিক জীবন:
পীরে তরিকত, রাহনুমায়ে শরিয়াত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ১৮ বৎসর বয়সে কাদিরিয়া চিশতিয়া, নকশবন্দী, মুজাদ্দদীয়া ও মোহাম্মদীয়া তরীকার ছবক গ্রহণ করে মাগফেরাতের উচ্চ মাকামে উত্তীর্ণ হন। তাঁর পীর ও মুর্শিদ ছিলেন আল্লামা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রাহ.)। ১০ খাদিমুল উম্মাহ, মোজাহিদে মিল্লাত, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) দ্বীন ইসলামের খেদমত ও সমাজ সেবায় স্থাপন করেছেন এক অনুপম দৃষ্ঠান্ত। তিনি একজন অতি সুদক্ষ সংগঠক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকারী। একজন ইসলামী দরদী সাংগঠনিক চৌকষ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। জাতীয়ভাবে ইসলামি ইস্যুতে বিশেষতঃ ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্যোগ মুহুর্তে উদার চিত্তে ঐক্যের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।১১ আধ্যাত্মিকতার চুড়ান্ত শিখরে আরোহন করে সত্যিকার অর্থেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিংশ শতকের মুসলিম বিশ্বের একজন ‘গ্রেট সুপারম্যান’ তথা ইনসানে কামিল।

সংগঠন প্রতিষ্ঠা:
দিনে অতন্দ্র প্রহরী ওলীয়ে কামিল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব দেশ বিদেশে অসংখ্য মাদরাসা মসজিদ ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পরামর্শক্রমে গড়ে উঠেছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সেবা মূলক সংগঠণ। সংগঠনগুলো হচ্ছে- গণমানুষের সংগঠন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ, আদর্শবাদী ইসলামী ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া, লতিফিয়া ক্বারী সোসাইটি, দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট, আনজুমানে মাদারিসে আরাবিয়াহ (আঞ্চলিক মাদরাসা সংগঠন), জালালিয়া আল কোরআন গবেষণা পরিষদ বালাগঞ্জ, শাহজালাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, এছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষকদের বৃহৎ সংগঠন ‘বাংলাদেশ জামিয়াতুল মুদারেছীন এর সম্মানীত উপদেষ্ঠাও ছিলেন তিনি। সমাজ কল্যাণ সংস্থা ‘মুসলিম হ্যান্ডস বাংলাদেশ এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক’। ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে ফ্রি ডিসপেন্সারী (চিকিৎসা কেন্দ্র) স্থাপন করেছেন। এতিমদের জন্য এতিমখানা খোলা হয়েছে এবং অসহায় মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন লঙ্গরখানা। গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহ নির্মানের প্রকল্প চালু করেন। অসহায় মানুষের মাঝে সেলাই মেশিন, টিউবওয়েল ও নারিকেল গাছ বিতরণ করতেন। অদ্যবধি তা চালু রয়েছে। এছাড়া অনেক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্টপোষক।

সাহিত্যকর্ম বা রচনাবলী:

সুন্নিয়তের অতন্দ্র পহরী আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ইসলামের সামগ্রীক বিষয়ে বিশেষ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদ্বা নির্ভর বিষয়াবলীর উপর উচ্চতর জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য ফুলতলী ছাহেব স্থাপন করেছেন একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। পরবর্তীতে এর নাম করণ করা হয় ‘দারুল মুতায়ালা’। উক্ত গ্রন্থাগারে রয়েছে আরবী, ফারসী, উর্দুসহ বাংলা ভাষার দূর্লভ স্থাপত্য কিতাবাদির বিপুল সমাহার। এ সব কিতাব তিনি দেশ-বিদেশে সফরকালে সংগ্রহ করেন। ফুলতলী ছাহেবের কর্মময় জীবনের শত ব্যস্ততা থাকা সত্তে¡ও মুসলিম জাতির স্বার্থে কলমী শক্তি চালিয়ে যান। তাফসীর, আকাঈদ, তাজবীদ ও আমল বিষয়ের উপর রচনা করেছেন নির্ভযোগ্য কিতাব। তাঁর কিতাবগুলো বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন মাদরাসার পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। তাঁর রচিত কয়েকটি কিতাবের নাম- ‘আত তানবীর আলাত তাফসীর, মুনতাখাবুস সিয়র, আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া, আনোয়ারুস সালিকীন, নালায়ে কলন্দর, শাজরায়ে তায়্যিবাহ, নেক আমল, আল কাউলুছ ছাদিদ’ ইত্যাদি।

কারাগারে কুরআন শরীফের তা’লিম:
ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ যুগ শ্রেষ্ঠ মনীষিগণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সময়কালীন সরকারের রোষানলে পড়ে কারা বরণ করেন। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি ১৯৭১ ইংরেজী সনের ১৯ শে ডিসেম্বর থেকে দীর্ঘ ২৪ মাস ৬দিন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। কারাগারেও তিনি থেমে থাকেননি। চালিয়ে গেছেন দ্বীনের তা’লিম, রচনা করেন মূল্যবান ইসলামী গ্রন্থ। জেল সুপার অলি আহমদের বিশেষ সহযোগিতায় সেখানে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। অনেক মুসলমান কারাগারে ফুলতলী ছাহেব এর কাছে কোরআনের কারী হন।১৪ মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ বাতিলের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। বাতিল যখন জেগে উঠতে চেয়েছে তখন তিনি দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে এ জমিনে ফুলতলী ছাহেবের পবিত্র রক্ত ঝরেছে। ১৯৮০ সালের ৫ ই মার্চ রাত পৌনে ১০ টার সময় সিলেটের জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুর গ্রামের দক্ষিণের হাওরের একদল রক্ষপিপাসু হযরত ফুলতলী ছাহেবের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। এদের হিংস্র থাবায় ক্ষত বিক্ষত ছাহেব কিবলাহ’র মাথায় ঊনিশটি সেলাই দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং প্রশাসন এদের শাস্তি দিতে সিদ্ধান্ত নিলে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তার ভক্ত মুরিদানকে প্রতিশোদ ও প্রশাসনকে শাস্তি দিতে নিষেধ করেন। সে দিন তিনি এদের ক্ষমা ঘোষনা করে মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

ঐতিহাসিক লংমার্চ:
আল্লামা ফুলতলী (র.) তাঁর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় দেশের মাদরাসা সমূহে ফাজিল ও কামিলকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত করণের প্রতিবাদে এবং স্বতন্ত্র আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০০৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক নজিরবিহীন লং মার্চের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত লংমার্চে সর্বোস্তরের জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন ও গণজোয়ার দেখে সরকার ফাজিল ও কামিল শ্রেণীকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করতে বাধ্য হয়। এমনিভাবে ধর্মীয় ও জাতীয় যে কোন সংকট মূহুর্তেই আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সিংহ পুরুষের ভূমিকা পালন করতেন। কঠিন সময়ে তিনি ছিলেন দল মত নির্বিশেষে সকলের শান্তনা ও সমাধানের ভরসা স্থল। আজ জাতি তাঁর শূণ্যতা অনুভব করছে ইয়াতিমের মত।

শামছুল উলামা উপাধি:
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর বিশাল কর্মময় জীবন ছিল সফল্যে মন্ডিত। দেশ ও জাতির খেদমতে যে বিরল ভূমিকা রেখেছেন তার উপর ব্যপক গবেষণা করে বৃটেনস্থ বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট এওয়ার্ড, (বিএনএসএ) ১৯৯৯ইং সনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ্য ব্যক্তিত্ব মনোনীত করে শামছুল উলামা (আলেমদের সূর্য) উপাধিতে ভূষিত করে। এ সংস্থাটি তাঁকে হীরার খচিত একটি ক্রেস্ট প্রদান করে।

হজ্জ্ব পালন ও জিয়ারতে মদীনা:
১৩৫১ বাংলা সনে কলিকাতা থেকে এবং পরে আরো ২বার চট্টগ্রাম থেকে জাহাজযোগে হজ্জ্বব্রত পালন করেন। এর পর আরো বহুবার পবিত্র হজ্জ্ব উমরাহসহ নবীজীর রওজা মোবারক জিয়ারত করেন।

পারিবারিক জীবন:
১৩৪৫ বাংলা তাঁর পীর ও মর্শীদ হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) এর তৃতীয় কন্যা মোছাঃ খাদিজা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এ স্ত্রীর তরফে চার পুত্র ও তিন কন্যা। তারা হলেন যথাক্রমে- হযরত মাওলানা মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী (বর্তমান পীর ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী), হযরত মাওলানা মোহাম্মদ নজমুদ্দিন চৌধুরী (সাবেক অধ্যক্ষ বাদে দেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা), মোছাম্মাৎ করিমুন্নেছা চৌধুরী, হযরত মাওলানা শিহাব উদ্দীন চৌধুরী, মোছাম্মাৎ মাহতাবুন নেছা চৌধুরী ও  হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী ।

হযরত ছাহেব কিবলাহর প্রথম বিবি আল্লাহর ইবাদতে গভীর মশগুল হলে এক পর্যায়ে সংসারের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। স্বীয় মুর্শিদ ও শ্বশুর বদরপুরী ছাহেবের নির্দেশে ফুলতলী ছাহেব নিজ গ্রামের মরহুম আব্দুর রশিদ খাঁন সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন। দ্বিতীয় বিবির তরফে তিন ছাহেবজাদা। তাঁরা হলেন, হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কমরুদ্দীন চৌধুরী (অধ্যক্ষ, শাহজালাল দারুস সুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা সুবহানীঘাট), হাফিজ মাওলানা মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও  হযরত মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী (সভাপতি, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ)।

হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র সাত পুত্রের সকলেই মুহাদ্দিস, হাফিজ ও মুফতীসহ উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এটাাই ফুলতলী ছাহেবের জীবনের অন্যতম একটি কাজ। তিনি ছিলেন সুন্নাতে রাসূলের পূর্ণাঙ্গ পাবন্দ। তাঁর ব্যবহার, দয়া-মায়া, ত্যাগ ও ভালবাসায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রিয় ভাজন হয়ে উঠেন।

ইন্তেকাল:
রাহবারে দ্বীন, মুর্শিদে বরহক্ব আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী পীর ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) ইসলামে নানা মাত্রিক খেদমতের এক কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব লক্ষ- লক্ষ ভক্ত-মুরিদানদের শোক সাগরে ভাসিয়ে ২০০৮সালের ১৬ জানুয়ারী বুধবার রাত প্রথম প্রহরে (২টার সময়) দিদারে এলাহিতে চলে যান। ছাহেব কিবলাহর জানাযায় এত মানুষের সমাগম হয়েছিল যা ভারত উপ-মহাদেশে অতীতে হয়নি। লক্ষ-লক্ষ মানুষের সাথে জানাযাস্থল ‘বালাই হাওর’ও যেন সেদিন কেঁদেছিল। পরদিন দৈনিক পত্রিকাগুলো এই জানাযাস্থলকে ছাহেব কিবলাহর অন্যতম কারামত বলে উল্লেখ করা হয়। আল্লামা ফুলতলী পীর ছাহেব কিবলাহ (র.) এর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। আল্লাহ যেন তাঁর এ ওলীকে আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেন! আমিন।

(আগামী ১৫ই জানুয়ারী বুধবার বালাই হাওরে ১২তম ঈসালে সাওয়াব মাহফিল অনুষ্টিত হবে এতে সকল মুসলিম ভাই আমন্ত্রিত।)

লেখক : সৈয়দ সাদিকুজ্জামান সাদি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, হযরত শাহ জালাল (র.) মিশন বাংলাদেশ।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.