আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

খান জাহানের আরো আগল ডাইয়্যামির কাহিনি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-২৭ ২২:০৭:৪৬




|| লিনু ফারজানা ||
একবার বাসা থেকে কিছু টাকা খোয়া গেল। সন্দেহের তীর কাজের লোকদের দিকে থাকলেও সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা কেমন দেখায়। টাকার অংকটাও নেহায়েত কম নয়। তাছাড়া এতবড় অন্যায় মুখবুজে সহ্য করলে ভবিষ্যতে আরো বড় কিছু হতে পারে। তাই অনেক চিন্তাভাবনা করে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললাম, এইখানে কিছু টাকা রাখা ছিলো, খুঁজে দেখিও তো কোন চিপায়চাপায় পড়েছে কিনা। আমি নিজেও ভুল করে অন্য জায়গায় রাখতে পারি।

অন্ধকারে গৃহকোনে হারানো সুই যদি মধ্য দুপুরের আলোয় রাস্তায় খুঁজা হয় তাহলে সুইটা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমার টাকা উদ্ধারের সর্বাত্মক কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।

এহেন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে শুক্কুর মিয়া এক অভিনব প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। সিলেট শহরের অদূরে পরিচিত এক পিরানি আছেন, যিনি আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে সব হারানো জিনিস খুঁজে বের করে দেন।

আমি প্রবল উৎসাহে পিরানির সাথে সাক্ষাতে সম্মত হই। এই রকম একটা লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। পুরা দেশ চোর ডাকাতে সয়লাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোল্ট ভেঙে শত শত কোটি টাকা চুরি হয়ে গেলো। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ভেতর রক্ষিত সোনা পিতল হলো। চোরের দল দেদারসে দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে বিলাস করে, ফুটানি মারে। পিরানির তন্তর মন্তরে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আমি আশার ক্ষীণ আলো দেখলাম। চুরি যাওয়া টাকা পয়সা ও পিতল হয়ে যাওয়া সোনার একটা হিল্লে হবে এইবার।

এইসব হঠকারী কাজে পুত্রকন্যাদের বাপের সম্মতি মিলে না। যথারীতি গৃহকর্তার বাধার মুখে পিরানির সাথে আমার সাক্ষাৎ পর্ব অনিচ্ছায় স্থগিত করতে হয়। কিন্তু পিরানির মাধ্যমে টাকা উদ্ধারে আমি রীতিমতো মরিয়া। এমন সুবর্ণ সুযোগ আমি হেলায় হারাতে চাই না। গৃহকর্তার অগোচরে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে ছাড়া গৃহকর্মীদের ছোট একটা প্রতিনিধি দল পিরানির কাছে যাবেন। শুক্কুর মিয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পিরানির তদ্বির নিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কোন এক শুভ দিন দেখে বিপুল উৎসাহে তুলা রাশির এক পাঁচ বছরের বালক নিয়ে প্রতিনিধি দল পিরানির ডেরায় হাজির।

"এলাহি কান্ড।"
পিরানির দর্শন পাওয়া এতো সহজ নয়। মহিলার আধ্যাত্মিক শক্তির জয় জয়কার নিজের এলাকার ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, স্বামীর পর নারীতে আসক্তি, স্বামী স্ত্রী অমিল, বান টুনা যাদু, জিনের আছর, পাওনা টাকা আদায় সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের ভীড় পিরানির গৃহে।

ঝামেলা এড়াতে পিরানির লোকজন সাক্ষাত প্রার্থীদের ১৩০ টাকার বিনিময়ে টিকিট দিচ্ছেন। সিরিয়াল অনুযায়ী সময়মতো সবাই পিরানির সাক্ষাৎ পাবেন। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে যেহেতু টিকিট বিতরণ করা হচ্ছে সেহেতু অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতির কোন সুযোগ নেই।

লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাদের প্রতিনিধি দলের সুযোগ আসে। কিন্তু বেগানা পুরুষ ও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের সামনে তদবির করতে পিরানি অপারগতা প্রকাশ করেন। পিরাকি ধরে রাখতে এই নিষেধাজ্ঞা ও পর্দার অন্তরালে অবস্থান। পিরানির অনুমতি সাপেক্ষে ছোট ছেলেটি কেবল অন্ধকার অন্দরে প্রবেশ করতে পারলো।

অন্দরের এক কোনে আগর বাতি ও ক্ষীণ আলোর মোম বাতি জ্বলছে। চারপাশে কেমন থমথমে রহস্যময় পরিবেশ। পাশে রাখা মগভর্তি স্বচ্ছ পানিতে ফুঁ দিয়ে চোরকে হাজির করা হলো। চোর ব্যাটা সশরীরে হাজির হয়নি। কেবল অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। আগত সবার সুবিধার্থে পর্দার ভিতর থেকে চোরের একটা কাল্পনিক বর্ননা দিলেন পিরানি। তুলা রাশির ছেলেটাকে বলেন, দেখ ব্যাটা, চাইয়া দেখ, চোরের চেহারা দেখা যায় মগের ভেতর।
-আমি তো কিচ্ছু দেখি না, তুলারাশি ভয়ে ভয়ে বলে।
-কানার ঘরের কানা কোহানকার। আমি দেখি তুই দেখছ না?
পিরানির ধমক খেয়ে তুলারাশি বলে-হো, দেখতেছি এক বেডি টাকা চুরি কইরা দৌড় লাগাইছে। পিরানি চোর সম্পর্কে যা বলে, ছেলেটা তাতেই সাঁয় দেয়।
-বেডির পিন্দনে লাল পিরান?
-হো, লাল পিরান।
-বেডির চুল লাম্বা?
-হো, চুল ম্যালা লাম্বা।

বাসায় আসার পরে তুলা রাশির সামনে আছিয়া, সাফিয়া যারেই আনা হয় সে বলে, তাইনেরে দেখেছি মগের পানিত। টাকা লইয়া যাইতাছুইন গিয়া।

আমার গৃহকর্মীরা অগ্নিশর্মা। তাদের আক্রোশের তীর তুলা রাশির দিকে তাক করা। বাজারি কিল একটাও মাটিতে পড়বে না। অবস্থা বেগতিক দেখে তুলা রাশির মা এসে পুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

তর্কে, পাল্টা তর্কে টাকা উদ্ধারের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। ঘরের সবাই আমার ফালতু কর্মে বিরক্ত। শুক্কুর মিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এইবার এগিয়ে এলেন অতিশয় করিৎকর্মা খান জাহান আলি মিয়া। তার সন্ধানে এক গরম রুটিপীরের খবর আছে। পীরের তাবিজ লিখা রুটি সত্যিকারের চোরের গলায় আটকে যাবে ও গলা দিয়ে রক্তক্ষরণ হবে যতক্ষণ না চুরির কথা সে স্বীকার করবে।

খান জাহানের ভাষ্যমতে জং ধরা লোহা, মনের গছা বা লেটলেটা কাঠালের মত জিনিস গলা দিয়ে নামলেও রুটি বাবাজির রুটি চোরব্যাটা গলধঃকরণ করতে টের পাবে কত ধানে কত চাল। টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ জেনেও রুটি বাবাজির কেরামতি দেখার জন্য আমি একপায়ে রাজি হয়ে গেলাম। বিনোদনের অপার সম্ভাবনাকে হ্যালায় দূরে ঠেলে দেয়া যায় না।

খান জাহান আলি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, হারানো টাকা ফিরে পেতে অল্পকিছু খরচ করতে হবে। খরচাপাতি কোন সমস্যা না। উদ্ধার হওয়া টাকার পুরোটাই তাদেরকে দিয়ে দিতে আমি এক পায়ে রাজি। রুটি বাবাজির পেমেন্ট ও আনুষাঙ্গিক খরচ দিয়েও টাকা থাকবে।

ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে টাকা উদ্ধারের এই নিশ্চিত সম্ভাবনার পুরো বিষয়টা আমি অভিভাবক মহলে চেপে গেলাম। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তাবিজ লিখা কয়েকটা রুটি এনে আমার সামনে রাখা হলো। রুটির উপর লিখা মিশরীয় লিপির মর্মদ্বার করা আমার মতো অভাজনের পক্ষে সম্ভব নয়। এই নিয়ে আমার কোন চেষ্টা বা আগ্রহ নেই। শুভক্ষণ দেখে রুটি ভক্ষন হবে। আমি ভাবছি চোরের যম এই ময়লা অস্বাস্থ্যকর রুটিগুলো কে খাবে?

আমাকে অবাক করে রুটি খেতে গৃহকর্মের সহযোগীরা সবাই প্রস্তুত। সর্বকনিষ্ঠ সহযোগী কিশোরী রুজিনাকে আমি এই রুটি পড়া খেতে নিষেধ করলাম। নিরপরাধ ছোট মেয়েটাকে এইসব জটিলতায় জড়ানোর দরকার নেই। আমার নিষেধাজ্ঞার ৭২ ধারা ভেঙে রোজিনা সবার আগে তৈরি।

উপস্থিত রুজিনার মা বলে উঠলো, ছাওয়ালে হাউছ করছে, খাইলাউক মামি।
রুজিনাও গলা উঁচিয়ে ঠাসঠুস জানিয়ে দিলো, নানি আমি রুটি পড়া খায়াম।

এতো উৎসাহ, আগ্রহ ও আনন্দ দেখে আমি আবার নিষেধ করতে ভরসা পেলাম না। বললাম খাও, বেশি করে খাও। গলা দিয়ে রক্ত আসলে আমি কিচ্ছু জানিনা।
তার উল্টা জবাব আমি তো চোর না, আমার গলায় রুটি আটকাইবো না।

সকল আয়োজন সম্পন্ন। ঠিক সন্ধ্যার পর রুটি খাওয়ার ক্ষণ নির্ধারন হলো। সবাই মিলে যথাযোগ্য মর্যাদা ও উদ্দীপনায় এইবার রুটি খাবে। ধরা পড়বে সরষের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভুত, পাকা চোর।

দর্শক, বিচারক আমি একা নই। রুজিনার মা আছে আমার সাথে। চারপাশে টানটান উত্তেজনা। পুত্র ছাড়া পরিবারের বাকি সদস্যদের আমার এসব আজাইরা অকাজে সমর্থন নেই। তাই সবার অনুপস্থিতিতে শুরু হল রুটি ভক্ষনের বহু আকাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান।

পড়বিতো পড় মালির ঘাড়ে। অসময়ে পুত্র কন্যাদের বাপের আগমন রুটি ভক্ষণে বিঘ্ন ঘটায়। অতি কৌশলে বেচারাকে রুমে বসিয়ে টিভি ছেড়ে দিলাম সাউন্ড বাড়িয়ে। সবার আগে খান জাহান আলি একেবারে ওজু করে মাথায় টুপি পরে প্রস্তুত। বিমুগ্ধ দর্শক আমি মন ভরে উপভোগ করছি রুটি ভক্ষনের লাইভ অনুষ্ঠান।

ইতিমধ্যে ক্যাজাকেজি করে দুজন গিলে ফেলেছেন, তৃতীয় জন গিলার পথে, চতুর্থ জন আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন, পঞ্চম জন খান জাহান আলি মিয়া কিছু করতে পারছেন না। যতবারই গলধঃকরন করতে চেষ্টা করেন ততবারই ফুড পাইপের প্রবেশপথে আটকে যায়। জোর করতে গেলেই ওয়াক করে উটকা আসে। যাদের ভক্ষণ শেষ তারা স্বস্তিতে আছেন। নিরাপদে দাঁড়িয়ে খান জাহানের ভক্ষণ দৃশ্য অবলোকন করছে।

এরমধ্যে রুজিনা বলে উঠে, খান জাহান মামা চোর। আমরা সবাই তো গিইল্যা ফালাইছি, হে তো গিলতে পারতেছেনা। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। রুজিনার কথার সাথে বাকিদেরও মৌন সম্মতি রয়েছে।

লজ্জায়, অপমানে রেগেমেগে খান জাহান রুজিনারে দিল এক ধমক, তুই বেটি চুপ। আমি চুরি করলে কি রুটি পড়া আনতাম?

দর্শক, বিচারক হিসেবে আমিও রীতিমতো বিব্রত। মুখ বাড়িয়ে বললাম, তর্কাতর্কি বাদ দিয়ে রুটি বাবাজিরে ধর উল্টা টুটকা করতে হবে। গলা দিয়ে ব্লিডিং হলে তো উপায় নাই।

খান জাহান কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো- মামানি আমি চুরি করি নাই, আল্লাহর কসম, শাহজালাল, শাহপরাণের দোহাই। আমি চুরি করলে আমার পোলা-মাইয়্যার মাথা খামু।
তার বিরক্তিকর অতিশয়োক্তি এই মুহুর্তে ভীষণ পীড়াদায়ক। দিলাম এক ধমক, এতো কথার দরকার নেই ব্যাটা বেয়াক্কেল। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।

কিছুটা কৌশলে টাকাটা হয়তো উদ্ধার করা যেত, কিন্তু খান জাহানের বোকামি আর আগলডাইয়ামির কারনে টাকাও উদ্ধার হলোনা, উপরন্তু তার নিজের উপরে চুরির অপবাদ পড়লো। সত্যিকারের চোর বহাল তবিয়তে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলো।

(বিঃদ্রঃ রুটি পড়া, চাল পড়া দিয়ে কখনো চোর ধরা পড়েনা। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হল সত্যিকারের চোর জোর করেই গিলে ফেলে। গরিব, সহজ সরল মানুষকে ঠকিয়ে রুটি বাবারা মাঝখান থেকে টুপাইস কামায়।)

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন