আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

আমরা যারা সিলেটী: আসুন দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৬-১৩ ১৪:৫৮:০৯

আবদুল আহাদ :: খুব ছোট ছিলাম। হয়তো ক্লাস ত্রি বা ফোরে পড়ি। হঠাৎ এলাকা জুুড়ে একটা বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা। ‘---- ক্বারী সাব এক আবাদি বেটি বিয়া করছইন।’ বেটি বেঙ্গলী মাতে’ (শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা বেঙ্গলী মাত)। আবাদিরা কেমন হয় তা দেখতে তার বাড়িতে প্রতিদিন মানুষের ভিড়। আমিও গিয়েছি মা’র সাথে। গিয়ে প্রথমবারের মতো কোন আবাদি মানুষের দেখা পেলাম। তবে, মহিলা আমাকে অনেক আদর করেন। এরপর মাঝে মাঝে খবর দিতেন তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তাদের একটা ঢাকাইয়া বড়ই গাছ ছিল। তিনি আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে সু-স্বাদু এই বড়ই খাওয়াতেন। ছোটবেলায় বেশ সুন্দর ছিলাম তো তাই হয়তো এমন আদর।

এখন আসি মূল কথায়। সিলেটীরা অন্য অঞ্চলের মানুষকে আবাদী বলে ডাকে। এই ডাকা স্বাভাবিক ডাকা নয়, টিজ করা। কেউ অন্য অঞ্চলের কোন মেয়েকে বিয়ে করলে সবাই টিজ করে আবাদী বলে। যেমন ধরুণ, করিম খুলনার একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। এখন সবাই বলাবলি করছে ‘করিম আর পুরিন পাইলোনা, আবাদী পুরি বিয়া করছে।’ এই টিজ পরিবার থেকে বন্ধু-বান্ধব এমনকি সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম (ছদ্মনাম)-এর সাথে সহপাঠি মৌ (ছদ্মনাম)-এর দীর্ঘ দিনে সম্পর্ক। ফাহিমের বাড়ি সিলেট আর মৌ নন সিলেটী। পড়ালেখা শেষে দু’জন চাকরি করে। ফাহিমকে পরিবার থেকে বলা হচ্ছে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে। ফাহিম জানায় মৌয়ের কথা। মৌয়ের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ফাহিমের বাবা-মা দেখে আসেন। পছন্দও হয়। কিন্তু যখন জানলেন তার বাড়ি সিলেট নয়, তখন বেকে বসলেন। সাফ কথা ‘আবাদী পুরি আমরার ঘরও আনা যাইতনায়।’ বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে ফাহিমের বিয়ে বন্ধ। ছেলে আবাদী হওয়া এভাবে বিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে সিলেটী মেয়ে রহিমার। যদিও ছেলেটী ছিল বুয়েটে পড়া ইঞ্জিনিয়ার।

সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে যুগও। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পারিনি। আমাদের কাছে যোগ্যতা-অযোত্যতার চেয়ে আঞ্চলিকতাই বড়। এই আঞ্চলিকতার কারণে শিক্ষা কিংবা চাকরিতে সিলেটীরা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিওনের পদে সার্কুলার হলে খুলনা, বরিশাল, রংপুর, রাঙামাটি থেকেও আবেদন পড়ে। যোগ্যতার ভিত্তিতে তারা চাকরিতে যোগদানও করেন। কিন্তু আমরা? পিওনের পদ তো দূরে থাক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে সার্কুলার দিলে সিলেটের একটিও আবেদন পড়েনা। তার মানে আমরা অযোগ্য যে তা কিন্তু নয়। মূল কারণ আঞ্চলিতা। আঞ্চলিকতার টানে সিলেটের বাইরে এই অঞ্চলের কোউ যেতে চাননা। সেটা যত বড় পদই হউক।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতেও আমরা তা দেখী। সিলেটের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দেশের সব জেলা থেকে শতশত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসেন। ভর্তিও হয় তারা। কিন্তু আমরাদের শিক্ষার্থীরা? সর্বোচ্চ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা আরো দু’চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। এর বাইরে দেশে যে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেনা সিলেটের শিক্ষার্থীরা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভর্তি হননা অনেকে। এমন বুড়ি বুড়ি উদাহরণ আছে। আদুরে ছেলেমেয়েকে সিলেটের বাইরে পড়তে দিবেনা তাই বাবা মা তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শহরের কলেজে ভর্তি করান। এমনও হয়েছে মেয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে কিন্ত বাবা মা তাতে এনে ভর্তি করেছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রাগীব রাবেয়া মেডিকেলে।

লন্ডন-আমেরিকায় গিয়ে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিবেশের সাথে খুব দ্রুত মানিয়ে নেন সিলেটীরা। এজন্য সিলেটের মতো সেখানেও সমান দাপট সিলেটীদের। বিদেশীদের মেনে নিলেও দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষ নিয়ে আমাদের চরম এলাজি। এজন্যই দেশে আমাদের দাপট শুধু সিলেটের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সিলেট শহরে অন্য অঞ্চলের শতশত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপকরা বাস করেন। বিভিন্ন সমিতিও আছে তাদের। এই যেমন যশোর সমিতি, কুমিল্লা সমিতি, ময়মনসিংহ সমিতি ইত্যাদি। ময়মনসিংহে কি সিলেটী সমিতি আছে? আমার জানা মতে নাই। আর থাকবেই বা কিভাবে। ময়মনসিংহে সিলেটের কয়জন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক কিংবা সিলেটী বাস করেন? খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে, তবে সেটা হাতে গোনা। এর প্রকৃত কারণ আঞ্চলিকা। শিক্ষাদীক্ষা কিংবা যোগ্যতায় তাদের চেয়ে সিলেটের মানুষে পিছিয়ে যে তা নয়। কারণ হলো আঞ্চলিকতার টানে সেখানে যেতে চাইনা আমরা।

আমরা যারা এই জেনারেশনের, আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারি। আসুন দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাই, জীবন পাল্টে যাবে। ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের পুরোটা নিয়ে বাংলাদেশ। সিলেট যেমন আমার। বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, নোয়াখালীও আমার। সবার মুখের ভাষা বাংলা। শুধু অঞ্চল ভেদে ভাষার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

লেখক: রিপোর্টার, সময় টিভি।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৩ জুন ২০১৭/শাদিআচৌ/এমইউএ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন