আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

গল্প: মুখোমুখি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৬-২৬ ১৭:৫৫:১৪

লিটন সরকার ::  শৈশব থেকেই পলাশের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।আর তাই ফল প্রকাশের সময় যখন নিজের রোল নাম্বারটা মেরিট লিস্টে খুজে পেয়েছিল তখন ক্ষণিকের জন্য তার মনে হয়েছিল যেন আকাশের তারা হাতে পেয়েছে।
তার মত অজপাড়া গায়ের ছেলের পক্ষে সেটা আকাশের তারা ধরার মত ব্যাপারই ছিল।

দিন মজুর বাবা আর গার্মেন্টস কর্মী মায়ের ছেলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এ পড়াশুনো করবে সেটা কেউ কখনো ভেবে উঠতে পারেনি। আর ভাববেই কেন তার রেজাল্ট যে খুব একটা আহামারি ছিল না।যেখানে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েও ছাত্রছাত্রীরা চান্স পাচ্ছে না,সেখানে এস এস সি এবং এইচ এস সি তে মাত্র ৪.৫ এবং ৪.৭৫ সিজিপিএ পেয়ে সে ঢাবিতে চান্স পেয়ে যাবে সেটা কার ও চিন্তার বলয়ের মধ্যে ও ছিল না।

কিন্তু গরীবের কিছু না থাকলেও অফুরান আশা থাকে।পলাশের ও তাই ছিল।আর সেই আশার ভেলাতে চড়ে পরিশ্রমের উপর ভর করে সে ভর্তি হয় যায় ঢাবিতে।তার গার্মেন্টস কর্মী মায়ের দেশের প্রতি ক্ষুদ্র অবদান ছিল।পলাশ চাইছিল তাদের অবদানটাকে বড় করতে।আর তাই ভর্তি হয় অর্থনীতি বিষয়ে।
ভর্তি হওয়ার পর পলাশ জানতে পারল সে নাকি অধম্য মেধাবী। প্রথমে বিষয়টা বুঝতে না পারলে ও একটা পেপারে যখন " অধম্য মেধাবীদের সাফল্য " শিরোনামে পলাশ সহ কয়েকজনকে নিয়ে রিপোর্ট আসল তখন খুব ভাল করে সেটা বুঝতে পারল।

এই রিপোর্টিং তাকে কার ও কাছে হিরো কার ও কাছে জিরো করে দিয়েছিল।দারিদ্র্যতার গন্ডি পেরিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে পা মাড়ানোতে অনেকে হিরো হিসেবে তাকে বাহবা দিত।আবার ধনি পরিবারের সহপাঠীদের কাছে সে ছিল তাচ্ছিল্যের পাত্র।যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন তাকে জিরো দিয়ে গুণ করলে যেমন শুন্য হয়ে যায় ঠিক তেমনি পলাশ যত মেধাবীই হউক না কেন যেহেতু সে গরিব তাই সে ছিল ভেলুলেস।পলাশ তাই ওদের কাছে শুন্য হিসেবেই ছিল।

গ্রাম থেকে শহরে আসলে সবার ভিতরেই আপনা আপনি একটা পরিবর্তন চলে আসে।চলাফেরা, কথাবার্তায়। চলাফেরার পরিবর্তন ঘটানো পলাশের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।পরিবর্তন আসল কথাবার্তায়।
শুধু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলাতে নয় বাচনভঙ্গিতে ও আসল পরিবর্তন। ভেজাল ঢুকতে শুরু করল পলাশের ভিতর। সাহেব না হয়েও নিজেকে বাবুসাহেব ভাবা, বন্ধুদের কাছ থেকে এটা ওটা ধার করা তার স্বভাবে পরিণত হল।কখনো কার কাছে চেয়ে নিত তার সানগ্লাস কখনো বা তার বাইক।

আর পলাশের এই আমুল পরিবর্তনের মূলে ছিল নন্দিনী।অসাধারণ রুপবতী ছিল মেয়েটি।যে কারো মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত।আর তাই নন্দিনীকে দেখে পলাশের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। সব কিছু ভুলে যেতে শুরু করল সে। ভুলে গেল তার নিজের গোল।তখন যেন একটাই গোল তার - যে কোন উপায়ে নন্দিনীকে পাওয়া।আর তাই বিদ্যাসাগরে এসে সে প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েছিল।

তার এই অবস্থা দেখে একদিন সায়েম পলাশকে বলল,দেখ বন্ধু তেল আর জল কখনো মিশ খায় না।যে নন্দিনী প্রতিদিন বাবার পাজারো গাড়ি করে ভার্সিটি আসে তার সাথে লোকাল বাসের হ্যান্ডেল ঝুলে থাকা তোকে কি মানায়??নন্দিনী কেন তোকে ভালবাসবে?শুধু শুধু সঙ হয়ে তার পিছনে ঘুরিস না।দেখ, অনেক কষ্ট করে এই জায়গাটায় এসেছিস।তোর বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন তোকে ঘিরে।সেটা ভুলে যাস না।
-কেন রে? প্রেম ভালবাসা কি পরিমাপ করে হয় নাকি?
-হ্যা।পরিমাপ করেই হয়।জীবনটা কোন বাংলা সিনেমা না বন্ধু। তুই দেখসিস না কাদের সাথে চলাফেরা নন্দিনীর।
-হ্যা দেখছি।কিন্তু চলাফেরাই তো করছে। প্রেম তো করছে না।
-তোর যা মন চায় কর আমি গেলাম।
এই বলে বন্ধুটি চলে গেল।

তারপর একদিন পলাশ ঠিক করল সে নন্দিনীকে প্রপোজ করবে।কিন্তু সে যে নন্দিনীর কাছে জিরো হিসেবেই ছিল তা বুঝে উঠতে পারেনি।।বুঝল তখন যখন নন্দিনী তাকে বলল,দেখো পলাশ ময়ূরের পেখম গায়ে জড়ালেই মুরগি কখনো ময়ূর হয়ে যায় না।মুরগি মুরগিই থেকে যায়।আর তোমার মা তো একজন গার্মেন্টস কর্মী।তুমি মনে হয় জান না এরকম কয়টা গার্মেন্টস আমার বাবার আছে আর সেটাতে কত সহস্র গার্মেন্টস কর্মী কাজ করে।
-বাহ! বাহ!তোমার কি আছে বলত নন্দিনী ?সবই তো তোমার বাবার।পরনের দামী ফ্রগ,চলনের ঐ গাড়ি, হাতের লেটেস্ট মডেলের মোবাইল কিছুই তো তোমার নয়।তাহলে কিসের এত অহংকার তোমার? হে তুমি ঠিকই বলেছ ময়ূরের পেখম লাগালেই মুরগি কখনো ময়ূর হয়ে যায় না কিন্তু ময়ূর থেকে পেখম খসে পড়লে সেটাকে কিন্তু মুরগি বলেই মনে হয়।তুমি আমাকে ভাল নাই বাসতে পার।কিন্তু তাই বলে আমার মা বাবাকে এভাবে ছোট করাটা তোমার ঠিক হয়নি।

নন্দিনী ঐ দিন পলাশকে শুধু ফিরিয়েই দেয়নি অনেক বড় একটা ধাক্কা দিয়েছিল।অনেক কষ্ট হয়েছিল তার সেই ধাক্কাটা সামলে উঠতে।তার মনে হয়েছিল গরীবের বোধ হয় সত্যিকার অর্থেই ভালবাসার কোন অধিকার নেই।
মনে মনে সে পণ করে অনেক বড় হবে।নন্দিনীর দুঃখে কখনো কখনো তার সস্তা চোখের জল গালে গড়িয়ে পড়ত আবার গালেই শুকিয়ে যেত।দুংখটাকে বড় হতে দেয়নি সে।ধীরে ধীরে পড়াশোনায় নিজেকে ব্যাস্ত করে ফেলল ।আর নন্দিনী জড়িয়ে পড়ে নতুন একটা সম্পর্কে।একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে পলাশ।গ্রামে চলে যায়।অপেক্ষা করতে থাকে অনার্স শেষে দেয়া জীবনের প্রথম বিসিএস এর রেজাল্টের।পাশাপাশি গ্রামের একটা স্কুলে পড়াতে থাকে।

কিছুদিনের ভিতর পলাশ পেয়ে যায় জীবনের সবচেয়ে বড় সুখবরটা।বিসিএস হয়েছে তার। পুলিশ ক্যাডারে মনোনীত হয়েছে।জনগণের সেবা করার সুযোগ মিলেছে তার।যে বাবা মাকে তার বন্ধু বান্ধব ছোট করে দেখত সেই বাবা মায়ের জন্য সে আজ গর্বিত।আজ তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,আমার বাবা একজন দিন মজুর হতে পারে, আমার মা একজন গার্মেন্টস কর্মী হতে পারে কিন্তু আমাকে তারা মানুষ করেছে।ঐ দিন খুব করে মনে পড়ছিল তার নন্দিনীর কথা। তার আজকের এই চাকরির পেছনে যে নন্দিনীরও একটা বড় অবদান রয়েছে।ঐ দিন নন্দিনী যদি তাকে ফিরিয়ে না দিত তাহলে হয়তবা জীবনের গল্পটা অন্য রকম হতে পারত তার।নন্দিনীকে পলাশ এখনো ভুলতে পারেনি।ভুলতে পারেনি বলেই তার প্রতিটি সুখে দুখে ঘুরে ফিরে ঐ নন্দিনীর কথাই মনে আসে।।

তারপর গেজেট হল।পলাশ চাকরিতে জয়েন করল। শত ব্যাস্ততার চাকরি তার।আর তাই এই ব্যাস্ততা তাকে ধীরে ধীরে সব কিছু ভুলিয়ে দিতে শুরু করল।তারপর হঠাৎ একদিন-
আসামীর লিস্টের একটি নামে তার চোখ আটকে গেল। " নন্দিনী "
আচ্ছা নন্দিনী কি জানে আমার পুলিশে চাকরি হয়েছে।ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর যে রিপোর্টটা করা হয়েছিল আমাদের মত গরীব ছাত্রদেরকে অধম্য মেধাবী আখ্যায়িত করে, বিসিএস হবার পর সেরকম আরেকটা রিপোর্ট হয়েছিল।যদি সেটা তার নজরে আসে তাহলে হয়তবা জেনেও থাকতে পারে।সে কি জানে পাজারো চড়ে ভার্সিটিতে আসার সুযোগ আমার হয়নি বটে কিন্তু মাঝে মাঝে চার চাকার সরকারি গাড়ি করে আমি অফিসে আসা যাওয়া করি।পলাশ যখন একমনে এসব ভেবে যাচ্ছে তখন এ এস আই মোস্তাক রুমের ভিতরে ঢুকার পারমিশন নিল।
-স্যার, আমরা গতরাতে রেট দিয়ে যে কয়জনকে ধরেছিলাম তাদের মধ্য থেকে একজন আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাগলামো করছেন।উনি নাকি আপনাকে চিনেন।
- না।কোন আসামির সাথে আমার কোন পরিচয় থাকতে পারে না।তুমি এখন যাও।আর তাদেরকে কোর্টে চালানের ব্যাবস্থা কর।
-জ্বি স্যার।
সাথে সাথে পলাশের তার স্যারের একটা কথা মনে পড়ে গেল।
" কার গায়েই লিখা থাকে না যে,সে আসামি। আসামি তৈরি হয়।কখনো বা সমাজ থেকে কখনো বা নিজ থেকে "
মনে পড়তেই সে কলিং বেলের বাটন প্রেস করল।
-জ্বি স্যার।
-এ এস আই মোস্তাককে বল, আমার সাথে যে দেখা করতে চায় তাকে নিয়ে আসতে।।
-জ্বি স্যার।
কিছুক্ষণ পর পলাশের সাথে দেখা করার জন্য আসামিটি প্রবেশ করল।
একি দেখছে পলাশ। সে যেন নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।তার সামনে নন্দিনী। আসামির বেশে।
যে হাতে মানাত বাহারি রঙের চুরি সেই হাতে এখন হাতকরা।যার কাছে সে একদিন নিজে থেকেই বন্দি হতে গিয়েছিল সেই আজ তার হাতে বন্দি।তার সাথে তো পলাশের এভাবে মুখোমুখি হবার কথা ছিল না।
নন্দিনী বলে উঠল,চাকরি পেয়েছ শুনেছিলাম। কিন্তু আমাদের এখানে পোস্টিং জানতাম না।
-তোমার কথা বল।তোমার এই অবস্থা কেন।
-সবই আমার পাপের শাস্তি। সেদিন যদি তোমাকে ফিরিয়ে না দিতাম আর আদনানের সাথে সম্পর্কে না জড়াতাম তাহলে আজ আমাকে এই দিন দেখতে হত না।
-আমার মত সামান্য গার্মেন্টস কর্মীর ছেলের সাথে কি তোমাকে মানাত!!
-ঠাট্টা করছ!!কর।এখন আমার সব শোনার সময়।আগে অনেক বলেছি।আর এখন শুনছি।
-ঠাট্টা করছি না।যা সত্যি তাই বলছি।আচ্ছা বাদ দাও ওসব কথা।আগে বল তুমি ওখানে কেন?? তোমাদের তো পয়সাকড়ির অভাব থাকার কথা না। সো..
-বল বল। তুমি বাদ যাবে কেন? ফেঁসে গেছি যখন তখন তো সবাইই বলবে।
-ফেঁসে গেছ!!
-একটু খুলে বল তো।
-ওর কাছে আমাদের সম্পর্কের কিছু ক্লোজ ভিডিও ক্লিপস ছিল। সে এইগুলা দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল।
- কে??
-আদনান। আমাকে বলে তার বন্ধুর সাথে ওয়ান নাইট স্পেন্ড করতে হবে।আর যদি তা না করি তাহলে সেগুলা নাকি নেটে ছেড়ে দিবে।কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।শেষ পর্যন্ত নিজের কাজে পরাজিত হয়ে রাজি হয়ে যাই তার কথায়।আর সেই রাতেই তোমরা রেট দিলে।।।
-তুমি আদনানের ঠিকানাটা দাও।আর তোমাকে যে থ্রেট করেছে তার কোন ভয়েস রেকর্ডিং আছে।
-হ্যা আছে।
-তুমি চলে যাও।আমি দেখি কি করা যায়।চিন্তা কর না।
-আরেকটা কথা পলাশ।
-না কেউ জানবে না।চিন্তা কর না।হাত বাড়িয়েছিলাম বন্ধু হওয়ার জন্য।হতে পারিনি তাই বলে শত্রু হব না।ভাল থেক।।
-তুমিও ভাল থেক।।আর শোন..
-কি?
-সেদিন আমি যা করেছিলাম তা ছিল আমার জীবনের চরম ভুল।দোয়া কর আগামীতে যা সঠিক তাই যেন করতে পারি।
-একটা কথা মনে রেখ নন্দিনী,
" Life is a stage but it doesn't have any repeat show "

নন্দিনী চলে গেল।পলাশ বসে বসে ভাবছে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।যে নন্দিনী আমাকে এক সময় অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল সেই নন্দিনীকে আমি আজ অপমানের হাত থেকে বাচিয়ে দিলাম।
যে নন্দিনী আমার মা বাবাকে সম্মানের ছিটেফোঁটা ও দেখায় নি।আমি সেই নন্দিনীর বাবা মা কে অনেক বড় লজ্জার হাত থেকে বাচিয়ে দিলাম।
সময় সত্যিই এক বড় বিচারক।মহান বিচারক।
বেশ কিছুক্ষণ পর পলাশের মোবাইলে তার মার ফোন আসল।
-কি মা? খাইস?
-হ্যা। খাইছি বাবা।একটা মাইয়া আইয়া আমারে তার হাতে খাওয়াইয়া গেছে।আমারে মা বইললা ডাকছে

-কে? নাম কি তার মা?
-নাম কহে নাই বাবা। কইছে আবার আইব।আমি চাইলে বারবার আইব।।

পলাশ ভাবছে, কে এই মেয়েটি?
নন্দিনী? নাকি অন্য কেউ। যদি নন্দিনী হয় তাহলে জীবন কি তার জন্য কোন রিপিট শোর আয়োজন করে রেখেছে!!

লেখক : লিটন সরকার, প্রিন্সিপাল অফিসার (ব্যবস্থাপক) রূপালী ব্যাংক লিঃ ঢাকালেখক : লিটন সরকার, প্রিন্সিপাল অফিসার (ব্যবস্থাপক) রূপালী ব্যাংক লিঃ ঢাকা
লেখক : লিটন সরকার, প্রিন্সিপাল অফিসার (ব্যবস্থাপক) রূপালী ব্যাংক লিঃ ঢাকা

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৬ জুন ২০১৭/এলএস/এসডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন