আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ছোট গল্প: দেনা পাওনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৮-০৩ ১৮:৪৩:১৫

লিটন সরকার ::  কনের আশীর্বাদ। বাড়ি লোকে লোকারণ্য। কিছুক্ষণ আগে বরের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। গুণে গুণে তিনটে গাড়ি প্রবেশ করেছে। কম করে হলেও ১৫-১৬ জন। কনেকে আজ অনেক বড় পরীক্ষা দিতে হবে তাদের সামনে। এর জন্য প্রিপারেশনও চলছে খুব জোরেশোরে।

যেভাবেই হোক উতরে যাওয়া চাই। বিষয়টা যতটা না প্রাপ্তির তার চেয়ে ও বেশি আত্মসম্মানের। কনেকে ভাল লাগে নাই এমন কথা শুনা যাবে না যে। তার উপর সাতপাকে বাধা পড়ার পথে একটা পরীক্ষা ইতিমধ্যে কনে উতরেও গেছে। হেড এক্সামিনারের কাছে যে পাশ করা হয়ে গেছে তার। মানে যে বিয়ে করবে তার কনে পছন্দ করা হয়ে গেছে। তারপরও প্রেমের বিয়েতো নয় সেটেল ম্যারেজ বলে কথা! সবার পছন্দ না হলে তো আর সিঁদুর পড়া হবে না।
আগত অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ আগেই কনেকে দেখে ফেলেছে আবার কেউ কেউ দেখে নাই। যারা দেখতে পারেনি তারা কানাঘুষা করছে।

কেমন দেখতে কনে?
আমাদের দিপুর সাথে মানাবে তো?
অবশ্য আমাদের দিপুর পছন্দ ভাল। অনেকের বৌ ঠিক করে দিয়েছে সে।আর তার নিজের বৌ পছন্দ করতে পারবে না এটা কি হয়!
কেউ আবার গায়ের রঙ নিয়ে চিন্তিত। আচ্ছা মেয়ের গায়ের রঙ কি চাপা নাকি দুধেআলতা?
আমাদের দিপু তো কালো।বর কনে দুজনেই কালো হলে তো বংশের সবাই হবে নাইজেরিয়ান।আরেকজন উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাখ গায়ের রঙ।গায়ের রঙ দিয়ে কি হবে!!
টাকা পয়সা কেমন আছে?দিপু দাকে গাড়ি টারি দিবে তো!!
একটা লেটেস্ট মডেলের করলা গাড়ি তো দিপুদা পেতেই পারে। উনার মত ছেলে কয়টা আছে!!
তখন আরেকজন বলে উঠল,কনে ও লাখে একটা।
-তুমি আগে দেখেছ নাকি??(পাশ থেকে একজন বলল)
-হে। খুবই সুন্দরী।আশা করি সবারই পছন্দ হবে।
আরেকজন বলে উঠল, থাম তো। তুমি তো বলবেই।শুনেছি এই আলাপ নাকি তুমি এনেছ।তাই নিজ থেকেই ঢোল পিঠাচ্ছ।
-একটু পরেই বুঝবে ঢোল পিটাচ্ছি নাকি সত্য বলছি।।তুই কি বলিস দিপু??
-আমি আর কি বলব।
-আহারে!! বেচারা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।মেয়ে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী।(আরেকজন টিপ্পনি কেটে বলল) 

সবার সাথে দিপু ও  এসেছে।মনে মনে সে ঠিক করে রেখেছে যে কনেকে আংটিটা সেই পড়াবে। যদিও বিষয়টা মুরুব্বি কাউকে জানানো হয়নি।আগে থেকে জানানো হলে ঝামেলা হতে পারে তাই সে এটা গোপন রেখেছে।আর উপস্থিতিতে হঠাৎ করে বললে তখন হয়তোবা সবাই রাজি হয়ে যাবে।কেউ হয়তোবা বলবে নতুন জামাই শখ করেছে কনেকে আংটি পড়াবে পড়াক না।বরের শখ বলে কথা।।শখের দাম এখন কোটি টাকা।আগে লাখ টাকা ছিল।।
সেই শখ পূর্ণ করার জন্য  ব্যাকুল হয়ে বসে আছে দিপু।বার বার পকেটে হাত দিয়ে সে দেখে নিচ্ছে আংটি টা ঠিকটাক মত আছে কিনা।।

সময় ঘনিয়ে আসছে।নাস্তার পর্ব শেষ। কিছুক্ষণের মধ্যে কনেকে নিয়ে আসা হবে।বরের বাবার কাছ থেকে অনুমতিও নেয়া হয়েছে।কনে আসবে।সভার মধ্যমণি হয়ে বসবে।

কিন্তু আশীর্বাদ পর্ব শুরু হবে ঠিক এমন সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে বরের বাবা বলে উঠলেন, দাঁড়ান দাঁড়ান!!
আগে দেনাপাওনার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নেই।
দেনাপাওনা!! কথা শুনে হতভম্ব কনের বাবা।এমন পরিবারের মানুষ দেনাপাওনা নিয়ে কথা বলতে পারে!! তিনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

পাশ থেকে দিপু বলে উঠল,বাবা আগে আংটিটা পড়িয়ে দেই।
-তুই আবার আংটি পড়াবি কি??আংটি পড়াব আমি।

-আমার বিয়ে আমি আংটি পড়াব না!!
-আমার বিয়েতে তোর দাদু আংটি পড়িয়েছিল।তোর বিয়েতে আমি পড়াব।তুই পড়াবি তোর ছেলের বিয়েতে।।

পাশ থেকে বরের কাকা বলল, দাদা দেনাপাওনার বিষয়ে কথা বল।আংটির বিষয়টা পড়ে দেখা যাবে।
কনের বাবা বললেন,তো আপনাদের কি কি দাবিদাওয়া শুনি।

-বরের দিকে ভাল করে তাকান তারপর ভাবুন সে কি কি পাওয়ার যোগ্য।
(বরের কাকা বলল)
কনে পক্ষের একজন টিপ্পনী কেটে বলল, বর কি কোরবানির পশু নাকি তার দামাদামি হচ্ছে।দেখেন দেখেন ভাল করে দেখেন।বেশ রুস্টপুস্টই তো মনে হচ্ছে।।

-কি!!আমাদের দিপু কোরবানির পশু!!  দাদা চলতো আমরা  মেয়ে দেখব না।

পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল।
কথার রাশ টেনে নিয়ে কনের মামা বলে উঠলেন, তো আপনারা কি কি চান বলুন না।না চাইলে বুঝব কেমনে ভাই।।
বরের বাবা বললেন,আপনারা বলেন কি কি দিবেন।
পাশ থেকে আবার টিপ্পনী কাটলো কনের কাকা। বললেন,বরের বাবার ধারণা আমাদের বলার লিস্ট উনাদের চাওয়ার লিস্ট থেকে বড় হবে।তাই আগ থেকে লিস্টটা ছোট করতে চাচ্ছেন না।

সাথে আসা একজন মুরুব্বি এবার সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তোমার বিয়ে। তুমি কি চাও বলতো।

কথাটা শেষ হবার আগেই দিপুর বাবা বললেন,ওর আবার কি চাই।ওতো বিয়ে করে বৌ পাবে।আমি কি পাব??
মুরুব্বি বললেন, আপনি মেয়ে পাবেন।কি! ভুল বললাম।যে বিয়ে করবে সেই ঠিক করুক না তার বিয়েতে দেনাপাওনা থাকবে কি না!!
বল বাবা দিপু, তুমি কি চাও??

দিপু বুঝতে পারল এখন কিছু না বললে তার আর কনের ঐ সুন্দর মুখটি দেখা হবে না।অনেক কষ্টে সে এই সুন্দর মেয়েটিকে খুজে পেয়েছে।মেয়েটা যেমন রুপবতী তেমন গুণবতী।হাসিতে তার মুক্তো ঝড়ে।এমন হাসির জন্য মরেও যাওয়া যায়।তাকে কোনভাবেই হারানো যাবে না।

তাই আর কালবিলম্ব না করে সে বলল,বাবা আমাদের মত শিক্ষিত সচেতন মানুষজন যদি দেনাপাওনা নিয়ে কথা বলি তাহলে এই সমাজটা কেমন করে বদলাবে।আপনি হয়তোবা ভাল মডেলের কোন টিভি নিবেন অথবা ভাল ক্যাপাসিটির ফ্রিজ কিন্তু এগুলাতো একটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে।কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কিংবা শ্বশুর -বৌমা এই সম্পর্কগুলো তো টিকে থাকবে সারাজীবন।আমি এইগুলা কিছুই চাই না। আমি শুধু চাই কনের অনামিকাতে আংটি পড়াতে যা একটি সম্পর্কের সূচনা করবে।।

মুরুব্বি এবার ছেলের বাবাকে বললেন,দেখেন সুব্রত সাহেব,টাকা পয়সা,ধন দৌলত এইগুলা হল তাসের ঘর আজকে আছে তো কালকে নেই কিন্তু সম্পর্কগুলা তো চিরঅটুট থাকে।

বরের বাবা কিছু না বললে ও কাকা কথায় মৌন সম্মতি  জানালেন।

দিপুর মনের ভিতরের সব শঙ্কা চলে যেতে শুরু করল ।সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটি বের করে হাতে রাখলো।যেন সে একটা সিগনালের অপেক্ষায়।

কনে এবার সবার সামনে।ঘোমুট অন্ধকার দূর করে যেন আলোর আভা ছড়িয়ে দিয়েছে সে।তার রূপের ঝলকানি তে কারও চোখের পাতা যে পড়ছে না।কেউ একবার তাকাচ্ছে কনের দিকে আরেকবার তাকাচ্ছে দিপুর দিকে।এই তাকানোয় তারা খুজে নিচ্ছে কম্বিনেশন।
আবার কেউ কেউ দিপুর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। দিপুকে যেন বলতে চাচ্ছে সাব্বাস ব্যাটা!! তোর পছন্দ আছে।

অন্যদিনে কিছু নিন্দুক মানুষ যারা সবসময় ঘিয়ের মধ্যে কাটা বাছেন তারা ফিসফিস করে বলছেন মন্দ নয় তবে আমাদের দিপু ব্যাটার জন্য আরো সুন্দরী বৌ হওয়া উচিত ছিল।।

দিপুর বাবা এবার দিপুকে আংটি পড়াতে বললেন।কথা শেষ হবার আগেই সে উঠে পড়লো।আংটি পড়িয়ে দিল কনের অনামিকায় যেন বিয়ের লগ্নের মত আংটি পড়ানোর লগ্ন ও চলে যাচ্ছে।

সবার মুখে এখন হাসি। রাজ্যের যত গল্প এখন সবার মুখে। বরের কাকা এবার কনের কাকার সাথে কথার নয় গল্পের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।।

সবাই স্থির হলে ও দিপুর অস্থিরতা যেন কমছে না।তার অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে
বিয়ের তারিখ।আগামী ৭ তারিখই যে তার বিয়ে!



লেখক : লিটন সরকার, প্রিন্সিপাল অফিসার (ব্যবস্থাপক) রূপালী ব্যাংক লিঃ সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন