আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সলিমুল্যাহ'র প্রিন্সিপালের অর্থকান্ডে তোলপাড়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-১১ ১২:২০:২৫

সিলেটভিউ ডেস্ক :: ফৌজদারী মামলায় জড়িয়ে পড়ায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এমএলএসএস মো. ফরিদুল ইসলাম। মামলা থেকে অব্যহতি পাওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তার সমুদায় পাওনা পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়।  কিন্তু বাঁধ সাধেন কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. মো. বিল্লাল আলম। পাওনা টাকা নিতে হলে ৪৫ শতাংশ কলেজের উন্নয়নে প্রদানের শর্ত জুড়ে দেন। এভাবে বছরখানেক কেটে যাওয়ার পর বাধ্য হয়ে শর্ত মেন নেন ফরিদ।  নিজের বেতনের ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে দেন প্রিন্সিপালের হাতে।

মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, শুধু এই একটি ঘটনাই নয়। এমন আরও অভিযোগ রয়েছে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে। তিনি এই মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব গ্রহণের পর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন সন্ধানী কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। কলেজের গাড়ি কেনার নামে তিনি সব শিক্ষকদের ৫ হাজার করে টাকা দিতে বাধ্য করেন। এই কাজে শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ১০০ টাকা করে নিতে নির্দেশ দেন। কলেজের যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার বিরুদ্ধাচারণ করলেই শিক্ষকদের বদলী করাসহ নানা ভাবে অপদস্থ করেন। আর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করতে পিছপা হন না। এছাড়া বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া, পছন্দের লোকদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার মতো অভিযোগতো রয়েছেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিকেল কলেজের এমএলএসএস মো. ফরিদুল ইসলাম ১৯৯৯ সালে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। স্থানীয়দের শত্রুতার কারণে ২০০৩ সালে তিনি একটি মামলার আসামী হন। সরকারি কর্মচারী হয়েও ফৌজদারী অপরাধের অভিযুক্ত হওয়ায় ওই সময় তাকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পরে মামলা থেকে অব্যহতি পেলে তিনি চাকরি নিয়মিতকরণসহ বকেয়া বেতনভাতার জন্য আবেদন করেন।

আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৯ নাভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. এহতেশামুল হক দুলাল সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারসহ বরখাস্তকালীন সময় কর্মকাল হিসেবে গণ্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রিন্সিপালকে চিঠি দেন।  এরপর দিন অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর ফরিদ কর্মস্থলে যোগদান করে প্রায় ১২ বছরের বকেয়া বেতনসহ বরখাস্তকালীন সময় নিয়মিত করণে প্রিন্সিúাল বরাবর আবেদন করেন। এরপর অর্ধবছর কেটে গেলেও চাকরি নিয়মিত বা বকেয়া টাকার দেখা পান না ফরিদ।  বকেয়া ফেরত পেতে প্রিন্সিপালকে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন তিনি। ২০১৬ সালের ৩ জুলাই দেয়া ওই মুচলেকায় ফরিদকে দিয়ে লেখানো হয়, ‘আমি সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন সময়ের মোট বেতনের ৪৫ শতাংশ টাকা কলেজের উন্নয়নে প্রদান করবো’।

মো. ফরিদুল ইসলাম জানান, স্থানীয়রা শত্রুতাবশত আমার নামে মাদক মামলা দিলে জীবন থেকে প্রায় বারটি বছর হারিয়ে যায়। নিরাপরাধ প্রমান হওয়ায় মামলা থেকে অব্যহতি পাই। অধিদপ্তর থেকে চাকরি নিয়মিতকরণ ও বকেয়া পরিশোধ করতে নির্দেশ দিলেও প্রিন্সিপাল গড়িমসি করেন। টাকা পেতে হলে বকেয়া টাকার অর্ধেক দিতে শর্ত দেন। একপর্যায়ে আমি জীবন বাঁচাতে ৪৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হই। তিনি এটা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। এমনকি কলেজের ক্যাশিয়ার ইউনুসকে আমার সঙ্গে ব্যাংকে পাঠান। তিনি টাকা তুলে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে বাকী টাকা আমার হাতে তুলে দেন। ফরিদ জানান, এ বিষয়টি কলেজের সব কর্মচারী-কর্মকর্তা জানেন। কিন্তু কেউ তারে পাশে দাড়াননি।

এদিকে ২০১৫ সালে প্রিন্সিপাল হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে যোগদান করেই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন সন্ধানীর কার্যক্রম বন্ধ করে দেন প্রফেসর মো. বিল্লাল আলম। সেই থেকে এ পর্যন্ত সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এটিকে খুলে দেয়ার দাবি জানানো হলেও তা আমলে নেননি তিনি।

সম্প্রতি কলেজের জন্য বাস কিনতে শিক্ষকপ্রতি ৫ হাজার টাকা ধার্য্য করেন প্রিন্সিপাল। কলেজের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি আদায় করেন তিনি। এই টাকা দিয়ে তিনি ৪২ সিটের একটি বাস কেনেন। এই বাস কিনতে শিক্ষর্থীদের কাছ থেকেও ১০০ করে টাকা আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাস কিনতে ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকী টাকার কি হয়েছে কেউ জানে না।

কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ছাত্র সংসদ তিনি খুলে না দিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার নামে একটি সংগঠনের পৃষ্ঠপোশকতা করছেন। ছাত্র সংসদের টাকা সেই সংগঠনের কাজে ব্যয় করছেন। এমনকি চাঁদার টাকায় যে গাড়ি শিক্ষার্থীদের জন্য কেনা হয়েছে সেটিও প্রায় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও প্রিন্সিপালের সঙ্গে মত বিরোধের কারণে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি, এমনকি তার ছাত্রত্ব স্থগিত করে রাখা হয়েছে। অথচ তার শিক্ষা বয়স শেষের দিকে। এখনো যদি তাকে পরীক্ষার সুযোগ দেয়া না হয়, তাহলে কোনদিনই এমবিবিএস পাশ করা হবে না। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, নন অডিটেড ফান্ড, যেমন- ছাত্র সংসদের অর্থ, কল্যান ফান্ডের অর্থ ইত্যাদি তিনি ইচ্ছামতো ব্যয় করেন। কারণ নন অডিটেড ফান্ডের টাকা খরচের কোন জবাবদিহিতা নেই। অথচ কলেজের জন্য মন্ত্রনালয় থেকে বরাদ্ধকৃত অর্থ ফেরত যায়।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. খান মো. আরিফ বলেন, বর্তমান প্রিন্সিপাল একজন আধিপাত্যবাদী মনোভাবা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যেটি করতে চান সেটির বিরুদ্ধে কেউ কোন মত দিলেই তার বিরুদ্ধে তিনি ক্ষেপে যান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে নাজেহাল করেন। তার সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করায় আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনিই সন্ধানীর কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু এ ধরনের সংগঠন কোনদিন বন্ধ হয় শুনিনি। ছাত্র সংসদের টাকা তিনি ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পেছনে ব্যয় করেন। এমনকি কলেজের কোন খাতের টাকা তিনি কিভাবে ব্যয় করেন সেটি তিনি শিক্ষকদের জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না। একজন শিক্ষার্থী তার বিরোধীতা করায় তিনি তার শিক্ষাজীবন ব্যহত করতে পিছপা হননি। যা অত্যন্ত অমানবিক।

কলেজের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, সন্ধানী স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত একটি সংগঠন। আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত এই সংগঠনের কার্যক্রম কোন ভাবেই বন্ধ করা ঠিক হয়নি। বাস ক্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোন ভাবেই চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোন কেনাকাটা করা অনৈতিক। তাছাড়া তিনি কতটাকা চাঁদা তুলেছেন, কত টাকা ব্যয় হয়েছে তার কিছুই শিক্ষকদের জানান নি। এটি কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে প্রফেসর ডা. বিল্লাল আলম বলেন, তার বিরুদ্ধে আনিত এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। তবে এমএলএসএস মো. ফরিদুল ইসলামের পাওনা টাকা কেটে নেয়ার বিষয়ে তিনি ফরিদুলের সাথে এখন কথা বলতে বলেন। একই সঙ্গে তিনি জীবনে কোনদিন হারাম স্পর্শ করেন নি বলেন। সন্ধানী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি নিজেই সন্ধানী করতেন। কলেজের সন্ধানীর কার্যক্রম স্থগিত থাকায় তিনি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু সংগঠনের নেতৃত্বে নিয়ে মারামারি হতে পারে এই আশঙ্কায় এটিকে বন্ধ রাখা হয়েছে। গাড়ি কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেনা হয়েছে।

সৌজন্যে : দৈনিক ইনকিলাব, প্রতিবেদক : হাসান সোহেল

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন