আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বুলবুলের আঘাতে বহু কৃষকের ‘মাথায় হাত’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-১০ ১৯:২৬:৫২

সিলেটভিউ ডেস্ক :: অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় ‘বুলবুল’ নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, বাস্তবে তার দাপট বাংলাদেশের মানুষ ততোটা অনুভব না করলেও এর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বহু কৃষক, মৎস্য খামারিসহ গ্রামের দরিদ্র লোকজন।

আর কয়েকটা দিন গেলেই ধান কেটে ঘরে আনার আশা করছিলেন কৃষক, জমি লিজ নিয়ে পানের বরজ করেছিলেন অনেকে, কেউ করেছিলেন মাছের খামার- এ রকম বহু মানুষ ঝড়ের তাণ্ডবে দিশেহারা।

রোববার ভোররাত থেকে কয়েক ঘণ্টা এই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৬টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে করতে পারেনি সরকারি কোনো দপ্তর।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ১৬ জেলার দুই লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে রোপা আমন, খেসারি ও পানের বরজসহ রবি শস্য ও শীতকালীন সবজি রয়েছে ।

কী পরিমাণ জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে, তা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক চন্ডী দাস কুন্ডু।

ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।

রোববার ভোর ৫টার দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছায়; শক্তি হারিয়ে সকালে বুলবুল পরিণত হয় গভীর স্থল নিম্নচাপে।

ঝড়ে ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি বহু ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর এসেছে। এখন পর্যন্ত ঝড়ে আটজনের মৃত্যু এসেছে, যদিও সরকারিভাবে দুইজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অফিসিয়ালি দুইজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। একজন দাকোপের প্রমীলা এবং আরেকজন পটুয়াখালীর হামিদ কাজী। এছাড়া ৩০ জনের মতো আহত হয়েছে এবং চার থেকে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।”

সাতক্ষীরা, নড়াইল, বাগেরহাট, খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, ফেনী, পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক চন্ডী দাস কুন্ডু রোববার বিকেলে গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত ১৬ জেলায় দুই লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েছি। তবে ঠিক কী পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়েছে, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে আরও কয়েক দিন লাগবে।”

এ সময়ে মাঠে রয়েছে প্রধানত রোপা আমন ফসল। রোপা আমনের মধ্যেই সাথী ফসল হিসেবে রয়েছে খেসারি। এছাড়াও সরিষা, মাসকালাইসহ কয়েক ধরনের রবি ফসল এবং শীতকালীল সবজি ও পানের বরজ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান চন্ডী দাস।

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে মংলায়, ১৫৯ মিলিমিটার। এছাড়া সাতক্ষীরায় ১৪৪, পটুয়াখালীতে ১৪০ ও খেপুপাড়ায় ১৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

চন্ডী দাস কুন্ডু বলেন, “কোনও কোনও জায়গায় ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে খেসারি মরে যাবে। আবার ছয়-সাত দিন যদি পানি জমে থাকে তাহলে ধান গাছও মরে যাবে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে সারা দেশে এবার ৬৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ঝড়ে আক্রান্ত ১৬ জেলায় চাষ হয়েছে ১৬ লাখ ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে।

চন্ডী দাস কুন্ডু বলেন, ১৬ জেলায় আক্রান্ত হওয়া দুই লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১০ শতাংশ জমির ফসল নষ্ট হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

তবে ধান গাছ যেন নষ্ট না হয় সেজন্য কৃষকদের কয়েকটি ধানগাছ একসঙ্গে গোছা বেঁধে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে। এর পদ্ধতিতে ডুবে যাওয়া ধানগাছ পচন থেকে রক্ষা করা যাবে বলে বলে জানান চন্ডী দাস।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ভাউড়িরচর গ্রামের কৃষক নাজির শেখ জানান, তার পানের বরজে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। লাখ টাকা খাটিয়ে এক বিঘা জমিতে বরজ করেছিলেন, যা সম্পূর্ণ পড়ে গেছে।

একই গ্রামের নেপাল চন্দ্রের ২৬ শতক জমির পানের বরজ এবং মিলন চন্দ্র দাসের ২৪ শতকের মতো বরজের পান শুয়ে পড়েছে। পাশের রায়পুর গ্রামের জাফর গাজীর পানের বরজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ওই এলাকার মাঠের অনেক জমির আমন ধান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রায়পুর গ্রামের শাহাদৎ হোসেন মোল্যা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আর কিছু দিন পরেই আমন ধান কাটা যেত। কিন্তু সকালে ঝড়ের কারণে বহু ধান ক্ষেতে পড়ে গেছে। এখন তো গরিব কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেল।”

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি কর্মকর্তা অরবিন্দ বিশ্বাস জানান, সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই জেলার ২৫ হাজার হেক্টরের আমন ধান, ১২০০ হেক্টরের সবজি, ৫০০ হেক্টরের সরিষা, ২০০ হেক্টর কুল বরই ও ১২০ হেক্টরের জমির পান আক্রান্ত হয়েছে। তবে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে ১৫ হাজার হেক্টরের আমন, ৮৪০ হেক্টরের সবজি, ৫০০ হেক্টরের সরিষা, ৬০ হেক্টরের পান ও ১০০ হেক্টর জমির কুল।

ঝড়ের সময় এই ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন দাঁড়ানো ছিল বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, জেলার কালীগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগরে ৫১৭টি পুকুর-দিঘী, ৪১৪ টন চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের পোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ ১০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কৃষক খলিলুর রহমান জানান, তার পাঁচ বিঘার আমন ক্ষেত পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আর ২০ দিন পর এই ফসল ঘরে তোলা যেত।

একই এলাকার আবুল হোসেন জানান, তার আট বিঘা জমির ধান কাটার পর্যায়ে ছিল। দুয়েক দিনের মধ্যেই এটা ঘরে তোলা যেত। কিন্তু ঝড়ে সব ধান ক্ষেতে শুয়ে পড়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক রমজান আলী বলেন, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক একটা চিত্র পাওয়া গেছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি বলেই মনে হচ্ছে।

“এসব জেলার ১৪ হাজার ৮৫৮টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব খামারের আয়তন ৯৩০০ হেক্টর। খামারের তিন হাজার ২৩৮ টন চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১০৫ কোটি টাকা। আর অবকাঠামো ক্ষতি হয়েছে ১৮ কোটি ছয় লাখ টাকার।”

মৎস্য খামারের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব খামারে লোনা পানি ঢুকে সয়লাব হয়ে গেছে।

সৌজন্যে : বিডিনিউজ২৪
সিলেটভিউ২৪ডটকম/১০ নভেম্বর ২০১৯/জিএসি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন