আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

গুলি ছুড়ে বধূবরণকারী কে এই স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-১৮ ১৮:৩৪:০৬

সিলেটভিউ ডেস্ক :: গুলি ছুড়ে নব বধূবরণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সদ্য ঘোষিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাউন্সিলর হওয়ার পর দ্রুতই নাঈমের পরিবারের আর্থিক উন্নতি হয়েছে। যারা একসময় হাটে সবজি ও মাছ বিক্রি করতেন, তারা এখন বিত্তশালী এবং গাড়ি-বাড়ির মালিক। এর নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ দখলবাণিজ্য।

বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত নাঈমের বিরুদ্ধে রয়েছে জমিদখল, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, অত্যাচার-নির্যাতনের বিস্তর অভিযোগ। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই তিনি সম্পদশালী হয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

রাজধানীর বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী; তারা এলাকায় ‘নাঈম খলিফা’ হিসেবে পরিচিত।

নাঈমের বিরুদ্ধে পাবলিক টয়লেট, বিমানবন্দর মোড়ের মসজিদ কমপ্লেক্স, ফুটপাত, রাস্তা, সাইনবোর্ড, খাসজমি ও সাধারণ মানুষের জমিদখলের অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার আত্মীয় হওয়ায় অপ্রতিরোধ্য নাঈম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক এক মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার সুবাদে ‘তদবির-বাণিজ্য’ করে কাউন্সিলর হওয়ার আগেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন নাঈম। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনি এখন বেশুমার সম্পদের মালিক।

প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র থাকার সময় বিমানবন্দর পাবলিক টয়লেট ফয়েজ নামে এক ব্যক্তিকে ইজারা দেন। তার মৃত্যুর পর ওই টয়লেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পান আবদুল হান্নান ওরফে ‘জাপানি হান্নান’।

তার হয়ে এটি দেখাশোনা করতেন রোকন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডিএনসিসি সেটি দখলমুক্ত করে। মোটর বসিয়ে অবৈধভাবে পানি বিক্রির অভিযোগে রোকনকে তিন মাসের সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

পাশাপাশি ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার টয়লেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেন নজরুল ইসলাম মোহনকে। তিনি উত্তরাপূর্ব থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

কাগজপত্রে টয়লেটটি মোহনের ব্যবস্থাপনায় থাকলেও তাজুল নামে এক ব্যক্তি সেটি দখল করে নিয়েছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাঈমের নির্দেশে তিনি এটি দখল করেন। টয়লেটে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন তাজুল। নাঈমকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটা অর্থ দেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, ‘এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট’ চত্বর ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি হোটেল ও দোকানপাট। এসব দোকানে টয়লেট থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রতিদিন ওই টয়লেট থেকে বিক্রি হয় হাজার হাজার গ্যালন পানি। অসংখ্য মোটরসাইকেল ও গাড়ি ধোয়ার কাজও চলে এ টয়লেট থেকে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হয়। কিছু অংশ সিটি কর্পোরেশনে দেন এবং বাকিটা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নাঈম ও তার পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দর গোলচত্বরের পূর্ব পাশের বাবুস সালাম মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেট দখল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে বিরোধে গত মাসের শুরুর দিকে সেখানে নাঈম বাহিনীর হামলায় তিন নারীসহ চারজন আহত হন।

এ নিয়ে বিমানবন্দর থানায় নাঈমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন হামলায় গুরুতর আহত ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে প্রিন্স।

এজাহারে নাঈমের নেতৃত্বে মার্কেট দখলে নিতে কয়েক দফা হামলার অভিযোগ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

এ ছাড়া মসজিদ কমপ্লেক্স দখল করায় আদালতে মামলা করেছেন বাবুস সালাম ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ মোস্তফা হোসেন। এতে কাউন্সিলর নাঈম ছাড়াও মোতালেব মুন্সী, আনিছুর রহমান ও মামুন সরকারকে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়, কাউন্সিলর নাঈম নিজেকে প্রিন্সিপাল দাবি করে কমপ্লেক্সটি দখল করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দখল ও চাঁদাবাজি করছেন। ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করায় নাঈম ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।

মসজিদ দখল নিয়ে স্থানীয়রা বলছেন, মসজিদে দান ও মার্কেট থেকে মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। নাঈম জোর করে দোকানগুলোর ভাড়া নিয়ে যান। কমপ্লেক্সের টাকা ইচ্ছেমতো ব্যয় করেন। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করেন না।

এদিকে বিমানবন্দর এলাকায় চাঁদাবাজি সম্পর্কিত পুলিশের এক প্রতিবেদনে নিজস্ব লোক দিয়ে নাঈমের চাঁদাবাজির বিষয়টি উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, জনৈক তাজুল ইসলামের মাধ্যমে কসাইবাড়ি পাবলিক টয়লেট থেকে মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাবলিক টয়লেট থেকে দক্ষিণখান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি বাবু ওরফে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, আশিয়ান সিটি হয়ে দক্ষিণখান বাজার-গাওয়াইর রুটে ইজিবাইক থেকে মাসে ১ লাখ টাকা, কাওলা রেলগেট থেকে শিয়ালডাঙ্গা হয়ে দক্ষিণখান বাজার রুটে চলাচল করা অটোরিকশা থেকে জনৈক আজমের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ টাকা, কসাইবাড়ির ছয়টি বাস কাউন্টার থেকে জনৈক জান্নাতের মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, কসাইবাড়ি টায়ারপট্টি ফুটপাত থেকে জনৈক জান্নাত ও আজমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে জনৈক ব্যক্তির মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, আশকোনা রেলগেট থেকে হাজী ক্যাম্প পর্যন্ত ফুটপাতে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা, বাবুস সালাম মসজিদ মার্কেটের দুটি আবাসিক হোটেল থেকে ম্যানেজার মনিরের মাধ্যমে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা করে মাসে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রেলস্টেশন ও রেললাইনের পূর্বপাশে পার্কিংয়ের দোকান (পুকুরপাড়) থেকে জনৈক সাজু ও রুবেলের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, রেললাইনের পশ্চিমপাশে জনৈক শাহীন আক্তারের মাধ্যমে দৈনিক সাড়ে ১০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় করেন কাউন্সিলর নাঈম।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নাঈম ও তার লোকজন কিছু দিন আগে স্থানীয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ও কলেজের পাশের মাঠে তাঁতমেলার নামে মেলা বসিয়ে জুয়ার আসর চালান। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর মেলা বন্ধ করে সেখানে মাছ, সবজি ও ফলের বাজার বসানো হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে ৮-১০ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে দৈনিক হিসেবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তারা আরও জানান, নাঈম ও তার লোকেরা সম্প্রতি আশকোনায় নির্মাণাধীন র্যাব কার্যালয়ের পাশে একটি লেক দখল করতে যান। প্রথমে মাছ চাষের কথা বলে সেখানে ঘর তৈরির চেষ্টা করেন তারা। পরে র্যাবের লোকজন নাঈমকে ডেকে নিয়ে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়।

এলাকাবাসীর দাবি, কাওলা এলাকায় আশিয়ান সিটির প্রবেশমুখের কাছে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করেছেন নাঈম ও তার লোকজন। সেখানে অবৈধ বাস টার্মিনাল ও রিকশা গ্যারেজ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলরের কার্যালয়ও করা হয়েছে সেখানে।

এ ছাড়া কাওলাবাজার এলাকাতেও নাঈমের একটি কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া কাওলা সিভিল এভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টারে সংস্কার-নির্মাণকাজসহ যেকোনো ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাঈম বাহিনী’।

তারা ঢাকা কাস্টম হাউসেরও কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যার থেকে তাদের বিশাল অর্থ আসে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটিতে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ মিথ্যা।’

মসজিদ মার্কেট দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কেন মসজিদের জায়গা দখল করব।’

নববধূকে সামনে রেখে শটগান উঁচিয়ে আকাশে গুলি ছোড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাঈম বলেন, এটা ১০ বছর আগের ভিডিও। এই ভিডিও শতশত মানুষের কাছে আছে। নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এটি ভাইরাল করা হয়েছে।

নববধূর সামনে কেন গুলি ছুড়েছিলেন- এমন প্রশ্নে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এ নেতা বলেন, নতুন বন্দুক কিনেছিলাম। কিন্তু ফায়ার টেস্ট করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই বিয়ের পর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে ফায়ার টেস্ট করি।

তবে লোকাল থানা পুলিশের অনুমিত নিয়েই ওই দিন ফাঁকা গুলি করেছিলাম বলে দাবি করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণখান থানার এক এসআই গণমাধ্যমকে বলেন, কাউন্সিলর নাঈমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরাও শুনেছি। কিন্তু এত অভিযোগের পরও থানায় এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।

সৌজন্যে :: যুগান্তর
সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৮ নভেম্বর ২০১৯/জিএসি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন