আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ইসলামের দৃষ্টিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার কি বৈধ?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২৫ ২২:১৬:১৭

সিলেটভিউ ডেস্ক :: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আতঙ্কিত মানুষ। নিরব এই মরণব্যাধি থেকে নিরাপদে থাকতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে নানা দিক-নির্দেশনা। যার মধ্যে অন্যতম হলো, সার্বক্ষণিক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। ঘন ঘন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। তাদের এই দিক-নির্দেশনা পেয়ে দেশব্যাপী হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে। প্রতিটি অফিস আদালতে প্রবেশের আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হচ্ছে। বাজারে তৈরি হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সঙ্কট। তাই বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে তৈরি করা হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার।

বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে ঘরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করার কলা কৌশল। সেখান থেকে জনগণ জানতে পেরেছে যে এর অন্যতম উপাদান অ্যালকোহল। যা সচেতন মুসলিমদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সবার মনে প্রশ্ন জাগছে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে কি হাত ধোয়া জায়েজ হবে? কারণ এতে তো অ্যালকোহল আছে। প্রথমেই আমাদের জানা উচিত যে অ্যালকোহলের ব্যাপারে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

বর্তমান সময়ে প্রায় সকল ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে তৈরি বিভিন্ন ওষুধে অ্যালকোহলের ব্যবহার একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা যাবে কি না-এ বিষয়ে বিজ্ঞজনদের সংশয়ে থাকতে দেখা যায়। অ্যালকোহল মিশ্রিত ওষুধ ব্যবহারের শরয়ি বিধান জানতে হলে আমাদের অ্যালকোহলের প্রকারভেদ সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।

ইসলামী আইনবিদরা অ্যালকোহলকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :

১. আঙ্গুর, কিসমিস ও খেজুরের মদ-শরাব থেকে সংগৃহীত।

২. উল্লিখিত ফলাদি ব্যতীত অন্য যেকোনো ফল/বস্তুর শরাব থেকে সংগৃহীত যেমন-জব, গম, আলু, মধু ইত্যাদি।

৩. কোনো প্রকার শরাব থেকে নয় বরং সরাসরি যেকোনো ধরনের ফলমূল, সবজি ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত। প্রথম প্রকারের অ্যালকোহল সম্পূর্ণ নাপাক এবং এটির ব্যবহারও হারাম। তবে একেবারে নিরূপায় অবস্থায় যেমন এটি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ না থাকলে তখন প্রয়োজন পরিমাণ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। (আল বাহরুর রায়েক : ১/১২২)

দ্বিতীয় প্রকারের অ্যালকোহলের ব্যাপারে ফুকাহাদের মতভেদ রয়েছে। যেমন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতে এ ধরনের অ্যালকোহল পাক এবং এই পরিমাণ ব্যবহার যার দ্বারা নেশা হয় না, বৈধ। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মতে, এ ধরনের অ্যালকোহলেও নাপাক এবং এর সামান্য পরিমাণ ব্যবহারও হারাম। স্বাভাবিক অবস্থায় ফাতওয়া ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মতের ভিত্তিতেই দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ব্যাপক হারে যখন এর ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতের ওপরও আমল করার সুযোগ রয়েছে। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতা হলো ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মতের ওপর আমল করা। (নাওয়াদেরুল ফিকহ : ২/৩৭১)

তৃতীয় প্রকার অ্যালকোহল সম্পূর্ণ পবিত্র ও হালাল যদি এতে নেশা না হয়। উল্লেখ্য, ওষুধে মিশ্রিত অ্যালকোহল কোনো প্রকারের তা জানা সম্ভব না হলে শুধুমাত্র ধারণাপ্রসূত কারণে এটিকে নাজায়েজ বলা যাবে না। বরং এটি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।

মোদ্দা কথা হলো, ওষুধে ব্যবহৃত অ্যালকোহলে কোন ধরনের তা নিশ্চিতভাবে জানা যাবে অথবা যাবে না। যদি জানা যায় তখন ওপরে বর্ণিত হুকুম মতে আমল করতে হবে। আর যদি জানা না যায় তখন অহেতুক সন্দেহ সংশয়ে না পড়ে তা ব্যবহার করা যাবে। (বুহুছ ফি কজায়া ফিকহিয়্যাহ : ১/৩৪০)

হ্যান্ড স্যানিটাইজারে যে ধরনের অ্যালকোহল ব্যবহারা করা হয়
হ্যান্ড স্যানিটাইজারে যে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয় তার নাম হলো, ইথানল। যা ইথাইল অ্যালকোহল নামেও পরিচিত, এক প্রকারের অ্যালকোহল। ইথাইল শব্দটি ফরাসি শব্দ ইথার এবং গ্রিক শব্দ হাইল সমন্বয়ে গঠিত। ফরাসি ভাষায় ইথার বলতে সেই পদার্থকে বোঝায় যা কক্ষ তাপমাত্রায় বাষ্পীভূত হয় এবং গ্রিক ভাষায় হাইল অর্থ বস্তু বা পদার্থ। এটি দাহ্য, স্বাদবিহীন, বর্ণহীন, সামান্য বিষাক্ত ও বিশিষ্ট গন্ধযুক্ত, এবং অধিকাংশ মদ এর প্রধান উপাদান। এতে ৯৯% বিশুদ্ধ অ্যালকোহল থাকে।

এই অ্যালকোহল তৈরির উৎস কী?
ইস্টের মেটাবলিক প্রোসেসে উপজাত হিসেবে ইথানল পাওয়া যায়। তাই যেখানে ইস্ট পাওয়া যাবে সেখানে ইথানল অবশ্যই পাওয়া যাবে। সাধারনত অতিরিক্ত পাকা ফলে ইথানল পাওয়া যায়। বারটাম পাম ফুলে সিমবায়োটিক ইস্ট ইথানল উৎপাদন করে। প্রাকৃতিক অ্যানারোবায়োসিসের ফলাফল হিসেবে অনেক উদ্ভিদ ইথানল উৎপন্ন করে। মহাশূন্যেও ইথানলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন ফসল যেমন ভুট্টা, গম ও বার্লি স্টার্চ ধারণ করে যা সহজেই চিনিতে রূপান্তরিত হতে পারে, তারপর ইথানল তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ইথানলের উৎপাদন স্টার্চ থেকে, এবং মধ্যপশ্চিম রাজ্যে উত্থিত শস্য থেকে প্রায় সব স্টার্ভ ভিত্তিক ইথানল তৈরি করা হয়।

গাছ এবং ঘাসগুলি বেশিরভাগ সুগারকে সেলুলোজ নামক একটি ফাইবারের পদার্থে লক করে রাখে, যা শর্করাতে বিভক্ত এবং তা দিয়ে ইথানলে তৈরি করা যায়। ফসলের অবশিষ্টাংশগুলিও ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন ভুট্টা, ভুট্টা পাতা, বা চাল ডাল কিছু ফসল বিশেষ করে সেলুলোসিক ইথানল তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে ঘাসের উপর নির্ভর করে।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ব্যবহৃত অ্যালকোহল আঙ্গুল কিংবা খেজুর থেকে তৈরি অ্যালকোহল নয়। বরং তা চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদি তৈরি। কেউ কেউ ঘাস ইত্যাদি দিয়েও তৈরি করে। সে হিসেবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) এর মতানুযায়ী ঔষধ হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার পবিত্র, নেশা না সৃষ্টি করলে তা ব্যবহার করা জায়েজ। কিন্তু যে হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ব্যবহৃত ইথানল জব, গম, আলু, মধু ইত্যাদি থেকে তৈরি করা হয়েছে, তা পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মদ রহ. এর দ্বিমত রয়েছে। তাই সতর্কতা বশত খাবার গ্রহণ ও নামাজের সময় ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

তা ছাড়া বাজারের কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ট্রাইক্লোসেন ব্যবহার করা হয়, যা খাবারের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। ২০১০ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ট্রাইক্লোসেনকে খাবারে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিছু কিছু গবেষকের দাবি, ট্রাইক্লোসেন থেকে ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি হতে পারে। এটি অপরিপক্ব শিশু জন্মের জন্য দায়ি এবং হাড়ের বৃদ্ধিতে সমস্যা করতে পারে। (সূত্র : shorturl.at/wJKY9 )

তাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৫ মার্চ ২০২০/জিএসি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন